আলোর পিপাসা

আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২১
0

মাহমুদা ডলি

জৈষ্ঠ মাস ঘিরে রেখেছে মাঠ-প্রান্তর ,দূর- দিগন্ত। শেষ বিকেলেও সূর্য রশ্মি শুষে নিচ্ছে যেন সব সবুজদের। প্রায় নির্জনতা ভেঙ্গে দিয়ে স্তিমিত পায়ে এসে ঘরের সামনে দাড়ায় শাওলি। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী । আজ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। বাবা-মা হারা মেয়েটা মামার বাড়ি বড় হচ্ছে। হঠাৎ কেউ কথা বলে উঠলো পেছন থেকে। দেখে পাশের বাড়ির নানা সম্পর্কের বুড়ো আয়নাল। হাসতে হাসতে বলল,‘ ইস! দ্যাহো, চাইয়া দ্যাহো। কি অবস্থা! মাগী ভালো একটা ভাতার পাওয়ার আশায় কি কষ্টই না করছে! রদ্দুরে পুইড়্যা গাল খান কেমন লাল টকটক বানাইছে। আহারে কষ্টবে ! আর বেশি দিন নাই। কষ্ট শ্যাষ । বুঝলা মাগী তোমার লাইগ্যা এইবার ভালো সম্নন্ধ পাইছি।

শাওলির বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। এই শেষ ! এই পর্যন্তই তার লেখাপড়া শেষ! কথার মাঝে কত শ্লেষ আর অবহেলা মিশ্রিত। বুকে দাহ নিয়ে ঘরে ছুটে যায়। কান পেতে শোনে শাওলি। আয়নাল মামীর সাথে কথা বলে,‘ নাহ! এইবার , তোমার ঘার থেইক্কা আপদ বিদায় অইবে তাহলে। বোজজো বউ,কতা পাকাপাকি’। আগামি শ্রাবনের প্রথম দিকেই । এহন তুমি আমাগো পোলার লগে কতা কও। হেরপর দিন-ক্ষণ ঠিক করে দাও। পান চিবোতে চিবোতে বলতে লাগলো আয়নাল।

মামী বলল,‘‘ হ বোঝেনই তো । অভাবের সংসারে হের ওপর আবার আরেকটা বোঝা ,তা আবার আপনাগো পোলার খামখেয়ালিপনা। হে কয়, না আজ-কাইল মাইয়া মানুষের লেহাপড়াডা জরুরি। কোনভাবে অইলেও করতে হইবে। এহন আবার কয় ডিগ্রিতে ভর্তি করবে। বয়স তো কম অয় নাই। বিয়া দিমু । পরের বাড়ি যাইয়া বাকী লেহাপড়া করুক’’।

সেই ছোট বেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ার পর । দুই বোন জয়িতা আর শাওলিকে নিয়ে আসে মামা বাড়ি। দুই বোনই নরম স্বভাবের। জয়িতা তখন অদ্ষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী আর শাওলি প্রাথমিকের ছাত্রী। মামীর তখন কি রাগ। মাত্র বিয়ে করলো মামা। আর এখনই এভাবে দায়িত্ব নেয়াটা পছন্দ করলো না মামী। কিন্তু দিনের পর দিন কামাই করতে করতে শেষ পর্যন্ত আর স্কুলে যাওয়া হলো না । মিয়া বাড়ির মেয়ে মামী পায়ের ওপর পা তুলে খাচ্ছে। রীতিমতো সংসারের সব কাজ জয়িতার হাতে। বছর দুয়েক চলে গেল্ । একদিন রাতে ঘুমানোর সময় জয়িতা বলল-যদি হারিয়ে যাই , কেউ না খুজলেও তুই আমায় ভুলে যাস না। আমার তো কেউ নাই তুই ছাড়া।সেদিন বোনের এ কথার মানে বোঝেনি শাওলি । কিন্তু মন খারাপ করে গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমায় । সকাল থেকে কোথাও পাওয়া যাযনি। কয়েক মাস পরে চিঠি এলো জয়িতা একজনের হাত ধরে চলে গেছে। এ বয়সেও খারাপ লাগেনি শাওলির । ভালোই হয়েছে। নিজের তো একটা সংসার হলো। কিন্তু শাওলি বোনের মতো ভুল করে না। কোনো কাজের জন্য আটকে রাখতে চাইলে শাসায় মামীকে ,‘মামাকে বলে দেবো । এ জন্যই বুবু চলে গেছে। তোমরটা তো খাই না। মামারটা খাই। মামা কামাই করে। তুমি তোমার বাপের বাড়িটা খাওয়াচ্ছো না। আমি স্কুলে যাবোই’। প্রতিনিয়ত ঝগড়া বিবাদের মধ্যেই গড়িয়ে যায় দিন। আর ঝগড়াটা বাধে কেবল পড়ালেখা নিয়েই। খেতে ডাকলে যায়। না ডাকলে না খেয়ে ঘুমায়। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। লেখাপড়াটা বুঝি আর হচ্ছে না। শাওলির মনে হলো সংসারের চোখে এ এক ধুলো খেলা।

বষার্টা মনে হয় একটু আগেই নেমেছে। চারদিন ধরে ক্রমাগত বৃস্টি। বৃস্টির সাথে এলোমেলো দাপুটে বাতাস। মামী বলল-বিয়ের সময়টাও রেহাই নাই। এ অলুক্ষণে ,অপয়া বল্লাই তো এমন অইলো। বৃষ্টির মধ্যেই অবশেষে বিয়েটা সম্পন্ন হলো।

ছেলের নাম সোহেল। বয়স চৌত্রিশ ছুঁয়েছে। দীর্ঘদিন দুবাইয়ে ছিল। এখন দেশে ফিরে এসেছে।কোনোভাবে অস্টম শ্রেনী ডিঙ্গিয়েছিল। এখন গ্রামে তার বসত বাড়ি তৈরী হয়েছে। নতুনভাবে দালানকোঠা , আর তার ভেতরে ও জৌলুস ছড়ায়। এলাকায় কাঠ চেরাইয়ের কারখানা, বরফকল, ট্রান্সর্পোটের ব্যবসা। এলাকায় বড় নেতা ও পুলিশের সঙ্গে ঢালাও ওঠা বসা। বিয়ের আড়াই মাস পরেই রেজাল্ট আউট হলো। শ্বশুর বাড়ির সবার মুখের পানে তাকায় শাওলি। নাহ! লেখাপড়া নিয়ে কারো কোনো কথা নাই। ভালো ফলাফল নিয়েও কেউ কথা বলছে না।

রাতে ঘুমানোর সময় সাহস করে স্বামীকে বলে ফেললো, ভর্তি হবো কলেজে। এতো ভালো রেজাল্ট! লেখাপড়াটা শেষ করি। কথা শুনে চোখ রক্তবর্ণ করে সোহেল মুখ ভেংচি দিয়ে খেকিয়ে ওঠে,‘ এইডাই তো কতা। কলেজে যাবা আর নতুন নতুন পোলাপানের লগে ঢলাঢলি করবা তাই না? বিয়াডা তো অইছে আর কি দরকার আছে লেখাপড়ার? নাকি বুইনের মতো কারো হাত ধইরা পলাইন্যার শখ আছে! তোমগো তো আবার বংশে এই সুনাম আছে। ’ কান চেপে ধরে শাওলি আর শুনতে পারছে না। কাদঁতে থাকে পাশ ফিরে। সোহেল হ্যাচকা টান মারে হাত দিয়ে,‘ এ দিকে আইসো, ওদিক কি ? কার কথা ভাবছো? কথা কইলে গাযে খুব লাগে না? শাওলির শরীরের কাপড় টেনে নেয়। টানতে গিয়ে মাথার কাপড় গলায় প্যাচ লাগে। শাওলি ওঠে পড়ে দ্রুত । নিজেই টান দিয়ে কাপড় সোহেলের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয। এরপর নিজের আচ্ছাদন নিজেই খুলে দেয়। পাছে আবার বিবাদ লেগে না যায়। খোলা শরীর দেখে নখ-দন্ত বুনো জানোয়ারের মতো ঝাপিয়ে পড়ে শাওলির ওপর।

কার্তিক মাস শেষ। মেঘ মুক্ত নির্মল আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা। দুপুরে দক্ষিণের জানালা দিয়ে নিম গাছের ফোকর গলে দেখা যায় আগেকার মতোই আকাশটা নিল। মনটা ছুটে যায় দূর দিগন্তে। মনে মনে ভাবে। আজ তো শুক্লপক্ষ। সন্ধ্যায আবার ছুটে যায় জানালার কাছে। আকাশে চাদঁ ওঠেছে। পূব আকাশের চাঁদটা আজ লাল টকটকে একটা থালার মতো। মাথায় শ্যাম্পু করেছে। শুকিয়ে যাওয়ায় ওর চুলের গন্ধ রুম জুড়ে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। ও নিজেই সেই সৌরভের স্বাদ পায়। সদ্য ভালআ হওয়া ঋতুবতী শাওলির মনটা আনচান করে ওঠে। কি চায় ওর মন? ও নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে লেখাপড়া? নাকি একটি সন্তান? হ্যা একটার পাঠ তো চুকে বুকে গেছে। এখন একটা সন্তান চাই। ভেবেছিল বিয়ের পর আর কেউ না হোক স্বামীটা তার একান্ত জন হবে। কিন্তু তাও হয়নি। সারাদিন সংসারের পাচঁ রকমের কাজ সামলাতে হয়। নব দম্পত্তি । বিয়ের আগে কত শুনেছে, বিয়ের পর ছেলেরা বউ পেলে ঘর থেকে বের হয় না। কিন্তু সোহেল ! সেই সকালে চা নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে যায়। আসে রাতে সারাদিন ব্যবসার পেছনে থাকে। বিয়ের পর দিনের বেলা কোনদিন পায়নি সে স্বামীর সোহাগ। রাতে ফিরেও তার তাড়াহুড়ো । কথাও খুব কম বলে। কোন ভাবে যেন ঘুমাতে পারলেই বাঁচে। অথচ আগে মাঝে মধ্যেই স্বপ্নে দেখতো কেউ শাওলির হাত ধরে চাদেঁর জ্যোৎস্না গায়ে মাখছে, নদীর তীরে ছুটে বেরাচ্ছে। চারদিকে পাহার মাঝখানে ওরা দুজন। বিয়ের পর ভেবেছে সেই মুখটা হয়তো সোহেলেরই। কিন্তু আশ্চর্য ! এখনো সেই স্বপ্নরা ছুটে আসছে। কিন্তু কেন? চাঁদটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিজের প্রতি বিদ্রুপের হাসি হেসে ওঠে । এ হাসিটা ওর কাছে কান্নার চেয়ে নিদারুণ,কান্নার চেয়ে যেন বেশি হƒদয় নিংড়ানো।ক্ষুদ্র সংকির্ণ অপরিসর হক্রদয়টুকু নিয়ে সুরভিভারাচ্ছান্ন ঘরে বসে আছে তিক্ত বিরক্ত মুখ নিয়ে।

ভারবাহী লরীর মতো জীবন টেনে চলছে শাওলি। জীবনের ওপর দিয়ে মেঘ আর সরে না। তবুও অসার কল্পনা আর স্বপ্নের মাঝে বেঁচে আছে। বছর দুয়েক হলো বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোনো সন্তান আসেনি শাওলি-সোহেলের। এ নিয়ে নিজের সংসারে, ঘরে-বাইরে নিত্য দিনের বঞ্চনা, অপমান সঙ্গি হয়ে আছে। ইদানিং ঘর থেকেও বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে অনেকটা। সারাদির গতর খাটে। আর নিজের শোয়ার ঘরে পড়ে থাকে। সেখানেও স্বামীর কাছ থেকে কোন আশা-ভরশা , ভালো মন্দ একটা কথা পায় না। অবলা মেয়ের জীবনে এত মানুষের মধ্যে আর যে-ই থাকুক, খুটি একটাই থাকে। সেটি যত মজবুত হয়,নারীর নিরাপত্তাবোধ তত নিশ্চিত হয়। স্বামীই তার সেই খুটিঁ। কিন্তু শাওলির জীবনের সেই খুটিটা বড্ড নড়বড়ে। এই তো সেদিন এ বাড়ির মুরব্বি আমিনুল হাটে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলো। শাওলি বাইরে ছিল। আমিনুলের বউ ঘরের মধ্য থেকে ডাক দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। আমিনুলের বউ চেচিয়েই বলল, অনেকটা ওরে শুনিয়েই বলল,‘ এট্টু পর যাও। বাজা মাইয়া মানুষের মুখ দেইখ্যা গেলে হাটের যাত্রা আর শুভ অইবে না।’সোহেলের মা ও সেদিন বলল,‘ পোড়া কপাল মোর বাজা মাইয়া মানুষ ঘরের মধ্যে থাকলে ব্যবসা তো মন্দা যাইবেই। ’ মায়ের কথার কোনো প্রতিবাদ করে না সোহেল। শাওলি বলে, চলো আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। সোহেল বলল,‘ হইলে এম্নেই হইবে। ডাক্তার-ফাক্তার দেখানোর দরকার নাই। শাওলির ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। মুখে অস্থিরতা আর বিপন্নতা । কারন যে বাড়িটা তার নিজের, যে মানুষগুলোকে সে আপন করে নিলো। তাদের কাছ থেকে এমন ধরনের ক্ষোভের ভাষা -আচরন ভাবতেই পারেনা।

সেদিন সন্ধ্যায় শাওলির শ্বশ্বুর কুলের সবাই বসলো। শাওলির মামাও এলো। মামার মুখটা কালো মেঘ যেন ঢেকে দিয়েছে। সবাই তার সঙ্গে কথা বলছে, না যেন প্রতিটি কথার সঙ্গে ঢিল ছুড়ে মারছে। তবুও মামা নির্বিকার। হয়তো ভাবছেন,‘ যে কোনোভাবে যে কোনো উপয়েই হোক ,ওর সংসারটা টিকে থাকুক। শাওলি নিজের শোয়ার রুমে গিয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ। তারপর হাত মুখ ধুয়ে কান্নাটাকে আড়াল করার জন্য মুখে পাউডার মেখে এসে দাড়ালো পর্দার আড়ালে। নাহ! শাওলির জন্য মামাকে কিছু বললে চুপ থাকবে না।

আমিনুল আর তার বউও এসেছে। সোহেলের মা বলল,‘ আপনার ভাগ্নির তো মাইয়া-পোলা কিছুই অয় না। আপনিই কন কি করা উচিত? মামা কিছু বলার আগেই পর্দা সরিয়ে শাওলি বলল,‘ আমার দোষ তা আপনি কি করে বললেন মা? কোনো ডাক্তারই তো দেখালাম না। আমিনুল খেকিয়ে ওঠে,‘ বউ তুমি অইলা মাইয়া মানুষ। তোমার এতো কতা কওনের দরকারডা কি? শাওলি আরো একধাপ জ্বলে উঠলো,‘ চাচা সমস্যা আমারে নিয়া, আমি কথা কমু না কেন? এই বার আমিনুলের বউ বলল,‘ দ্যাখ দ্যাখ সোহেলের মা শিতি বউ আনছো এহন কেমন টিয়া পাখির মতো কতা কয়? ওগো ওই মাইয়া মাইনষের লগে তোমার কতা কওয়া লাগবে না। তোমার কি নিজের মান সম্মান নাই? কোতায় তুমি আর কোতায় ও । শাওলি কাঁদবে না হাসবে বুঝে ওঠতে পারে না। এবার সবার সামনে বেরিয়ে এলো। শ্বাশুড়িকে বলল- মা এতো বৈঠকের দরকার নাই। আর এতো শালিসের ও দরকার নাই। মামা আছে, আপনারা সবাই আছেন। আমিই সমাধান দিচ্ছি। আপনার ছেলের আর আমার দুজনেরই পরীক্ষা হবে । দুজনকেই আপনাদের পরীক্ষা করাতে হবে! কাল দুজনেই ডাক্তারের কাছে যাবো। সমস্যাটা যদি আমার হয় । তাহলে এই আমি সবার সামনে কথা দিলাম ,আমি চলে যাবো। আপনারা অপনাদের ছেলের আবার বিয়ে দেন। এবার মামাও কথা বলে উঠলো। বললেন,‘ হ্যা ভাগ্নি তো ঠিকই কইছে। তাই করেন। আমিও নিয়া যামু আমার ভাগ্নিরে। মামা আর কথা বলতে চাননি। ওই ভাগ্নির কথাতেই তার কথা। মামা যাওয়ার সময় শাওলির মুখের দিকে তাকালো। শাওলি কাঁদছে। মামা বলল,‘ আরে ওই মা তুই কানতেছো কেন? আমি তো অহনো মইরা যাই নাই । আমি এক মুঠ খাইতে পারলে তোরেও খাওয়ামু। তোরে আবার লেখাপড়া করামু। মামা নিজেকে সামলাতে পারে না। হুহু করে কেঁদে ওঠে। কারো দিকে না তাকিয়েই বের হয়ে যান।

সোহেলকে এক প্রকার জোড় করেই নিতে হলো শহরে ডাক্তারের কাছে। সে না যাওয়ার জন্য জিদ ধরে বসেছিল। শাওলির জিদের কাছে হার মানতে হলো। শ্বাশুড়িই পাঠালো ছেলেকে। এখন যে কোনোভাবেই হোক তারা বাজা মেয়েকে রাখবে না। তাই এ টুকু কষ্ট করলেই বা কি যায আসে তাতে। তিন দিন পর শহর থেকে ডাক্তারের কাগজপত্র নিয়ে এলেন মামা । ডাক্তার বলেছে,‘ সমস্যাটা সোহেলের। সে দুবাইয়ে থাকা অবস্থায় চিকিৎসা নিয়ে এসেছে। তার ডিম্বানু নষ্ট। কিন্তু এ কথা সে কাউকে বলেনি।

শাওলির মাথা থেকে যেন আগুনের ফুলকি ঝড়ছে। সব প্রতারক। উল্টো এ দুইটা বছরে তার যত অপমান, লাঞ্চনা ,গঞ্জনা। হাতে চায়ের ট্রে ছিলো॥ এবার আর কাউকে তোয়াক্কা করলো না। রাগে, দু:খে অপমানে চায়ের ট্রে ফেলে দিয়ে কাদতেঁ কাঁদতে নিজের শোওয়ার ঘরে গেল। মামাও আর দাড়ালো না। যেন সিদ্ধান্তটা এখন শুধুই তার ভাগ্নির ওপর নির্ভর করছে।

রাতে পিন পতনের নিরবতা শোয়ার ঘরে। স্বামীর মুখটা আনত। দুজনেই নিস্তব্ধ। শাওলি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্বামীর মুখের দিকে। এক অসহ্য বেদনা, করুণার দৃস্টি, ক্ষমার নয় একরাশ ঘৃনা জড়ানো।

পূব আকাশে ক্ষীণ আলোর আভাস। আলোকরশ্মি উকি মারতে ঢের দেরী। একবার্ এ ঘরের চারদিকে তাকায়। কোন কিছু তার আপন কিনা! কিন্তু তা নয়। এ কোনো কিছুই তার নিজের নয়।

নিস্তব্ধ পায়ে বেরিয়ে গেল বাসি কাপড়েই। হাটা নয়, যেন ঘোড়ার গতিতে ছুটছে। পিতৃ-মাতৃহীন অভিশপ্ত কণ্যাটি একবার মায়ের কবরের কাছে যেতে চায়। বিয়ের ও ছয় মাস আগে একবার গিয়েছিল। এত দিন একবারের জন্যও যেতে পারেনি। আজ আবার যাবে। এরপর বেরিয়ে পড়বে অজানার পথে। যে পথের হয়তো শেষ নাই। আবার সে মুক্ত। এবার চেষ্টা করবে নিজের ডানায় ভর করে উড়তে শেখার।নিজের বাড়িতে মা- বাবার কবরের কাছে যেতে যেতে আলো ফুটে উঠলো। শিশুদের জন্য ভিটামিন ডি‘র আলো এটা। তেজ নেই। চারদিকে হালকা কুয়াশারা ছুটোছুটি করছে পালানোর জন্য। কবরের কাছে যেতেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো॥ কেউ একজন মায়ের কবরে পাযের কাছে দাড়ানো। অল্প বয়সী নারী। ব্যকুল কন্ঠে ডাক দিলো। কে? কে ওখানে? ফিরে তাকায় । মুখটা শাওলির চেনা চেনা লাগছে। জয়িতা ! শাওলি আর এগোয় না। বসে পড়ে। জয়িতা ছুটে যায় বোনের কাছে। শাওলি ভালোভাবে বোনের দিকে তাকায় সেদিনে সেই বোনটা কেমন একজন পূর্ণ বযসী নারীর মতো দেখায়। বোঝা যাচ্ছে সুখে আছে সে, ভালো আছে। কেঁদে ওঠে শাওলি। জয়িতা কাছে আসতেই ধরে এলোমেলো ভাবে মারে জয়িতাকে। চুল টান দেয কষ্টে, রাগে কাপড় ধরে ছিড়ে ফেলে। জয়িতা থামানোর চেষ্ঠা করে ,এটা সম্পূর্ণ অভিমান বুঝতে পেরে বোনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। দু‘বোন কাঁদে। কিছুক্ষণ কোনো কথা, কোনো ভাষা ছাড়াই। এরপর শাওলির মুখটা নিজের হাতের তলায় তুলে ধরে। ‘‘ বাহ! আমার বোনটা এতো সুন্দর! এতো লাবন্য ! এতোটা উজ্জ্বল ! কি রুপ রে তোর ! কিসের জন্য এত রুপ ! হ্যারে , এ রুপ কি বেচেঁ থাকার জন্য ,নাকি মরে যাবি ! না না তুই বাঁচবি। কিন্তু চোখের নিচে কালি ফেলে দিয়েছিস যে? আর ভয় নেই, আমি আর তোকে ছেড়ে হারিয়ে যাবো না। আমি তোরে আমার বুকের মধ্যেই আগলে রাখবো। আমি সব জানি। আবার তুই লেখাপড়া করবি। আমি তোরে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। দেখবি তোর মনেই হবে না। যে তুই কিছু হারিয়েছিস।’’ বোনকে টেনে তুলে নেয ছোট শিশুদের মতো খুব আহলাদের সাথে। শাওলির কান্না থামেনা। সে শিশুদের মতো ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। অনেক দিনের জমানো কষ্ট ,যন্ত্রণা মেঘ হয়ে ঝরে। সেই জমানো মেস আজ কেদেঁ বিদায় করতে চায় শাওলি।

কলেজ থেকে বাসায় ফেরার জন্যে স্টেশনে চলে এল। কোন গাড়ি নেই। একটা রিকশা মাত্র। বলল,‘এই রিকশা যাবে? পেছন থেকে একই সগ্ধেগ পুরুষের কণ্ঠ । রিকশা যাবে? শাওলি ফিরে তাকায় পেছনে। একজন ভদ্রলোক। হাতে বড় বড় দুটো ব্যাগ এবং বৃপকেস। বয়স পয়ত্রিশের কাছাকাছি। শাওলি বলল,‘ আমিই আগে বলেছি।’ আমি ও তো বলেছি-বলল লোকটা। কোনো কথা না বলেই লোকটা ওঠে পড়ে। শাওলি ক্ষেপে যায়। ‘এটা কি হলো?’ এবার লোকটা বেশ মজা পায়। বলল,‘ কিছুই হয়নি। তবে আপনাকে লিফট দিতে পারি। ’ শাওলি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,‘ দরকার নাই। আপনি যান’। রিকশা টান মারতেই লোকটা থামিয়ে দেয় রিকশাকে। শাওলিকে বলল,‘ম্যাডাম দুজনের গন্তব্য একই জায়গায, দ্বিধা না করে ওঠে বসুন। শুনসান এলাকা, মেয়ে মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। লিফট দিচ্ছি ,বাসায় চলেন। কথা দিচ্ছি আপনাকে পৌছে দেব আপনার বাসায়। চারদিকে একবার তাকায় । ভর দুপুরে নিরবতা দেখে ভয়ে বুক কেপে ওঠে শাওলির। এরপর ভালোভাবে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকায়। চোখের পলক পড়ে না। ভালোভাবে নোটিস করে । নাহ ওই দৃষ্টিতে খারাপ কিছু নেই। পুরুষের যে চোখের ভাষাকে মেয়েরা ভয় পায় । এ চোখ সে কথা বলেনা। প্রায় কুড়ি মিনিট কথা না বলেই কেটে যায়। লোকটা বলল,‘ কোথায় নামবেন?’ ¯স্টেশনেই-জবাব দেয় শাওলি। স্টেশনে নেমে যায়। ভাড়ার টাকা দিতে দেয় না সে। তবুও শাওলি জোড় করে রিকশাওয়ালাকে দিতে যায। ভদ্রলোক রিকশাওয়ালাকে ধমক দেয় না নেয়ার জন্য। ধমকে শাওলিও মাথা নত করে চলে যায়। শাওলি বাসায় ফিরতেই । আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। জয়িতা ও ছুটে আসে । কিন্তু শাওলি হাত বাড়িয়ে তাকে না করে দিয়ে নিজেই খুলতে যায়। কে এলো ,তা দেখার জন্য জয়িতা দাড়িয়েই থাকে। দরজা খুলতেই শাওলি অবাক। আরে এতো সেই ভদ্রলোক! যার সাথে ও এসেছে। সে নিজেই বলে ওঠলো,‘এ কি আপনি? এ বাসায় কেন? শাওলি জয়িতার দিকে তাকায় অসহায় দৃষ্টিতে। জয়িতা ছুটে যায় কাছে,‘আরে ছোট ভাই যে! আসুন। কোনো খবর না দিয়েই এসেছেন। কি অবাক কান্ড! জয়িতা পরিচয় করিয়ে দেয় ,‘ছোট ভাই মানে স্বামীর ছোট ভাই রবিন। ঢাকা থেকে বদলী হয়ে তোমাদের কলেজে এসেছে। জানো তো অনেক টাকা খরচ হয়েছে বদলীর জন্য। কাল জয়েনিং ডেট। শাওলি ছোট ভাই কিন্তু এখন তোমারও শিক্ষক।” ফ্রেস হয়ে খাবারের পরে আর শাওলি-রবিনের দেখা হয়নি। সন্ধ্যায় রবিন নিজের হাতে গড়া বাগানে গেল। দেখলো শাওলি বসে আছে। শাওলিও ফিরে তাকায় রবিনের দিকে। রবিন মুগ্ধ হয়ে দেখে শাওলিকে। চাদেঁর আলোর সাথে তার মুখের আলো একাকার হয়ে মিশেছে। কি যে সুন্দর! শাওলি কেয়ার করে না। পাশ কাটিয়ে ঘরের ভেতরে যায়।

বছর ঘুরে এলো। রাতে খাবার খেতে বসেছে সবাই। রবিন বলল,‘ শাওলি তোমার রেজাল্ট খুব ভালো। আজ শিক্ষকরা তোমাকে নিয়ে আলোচনা করেছিলেণ। তুমি যদি অর্নাসে ফার্স্ট ক্লাস পাও। তাহলে বিসিএস তো চেষ্টা করবেই। তার আগে আমি তোমাকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জব দেয়ার চেষ্টা করবো। চেষ্টা করবো কি! যে কেউ তোমাকে নিয়ে নিতে চাইবে। হু হা পর্যন্তই করলো শাওলি। কোন কথা বলে না। মাঝে মধ্যে বোনের ছেলের সঙেগ একটু খুনসুটি করে। এর বাইরে তাকে কোথাও আড্ডা কিংবা ঘুরে বেরাতে দেখে না। রবিন মাঝে মধ্যেই খেপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিনিময়ে সে একটু মুচকি হাসি দিয়ে ওঠে যায়। রবিন চায় শাওলি তার খোজ খবর রাখুক । কিন্তু এখনো পর্যন্ত শাওলি রবিনের সামনে কোনো কাজ ছাড়া যায়নি। এক কথায় সুপুরুষ রবিন। নায়কোচিত চেহারা। লম্বা। হ্যান্ডসাম এবং স্মার্ট। খাওয়ার সময় শব্দ করে খায়না। রবিনের সৌর্ন্দযে সে মুগ্ধ। কিন্তু ও আর কিছুই আশা করেনা। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে জীবন-যাপনের স্বপ্ন দেখে না। নিজেকে আশ্চর্য রকমের নির্লিপ্ত করে রেখেছে। তবুও সে রবিনের খোজ খবর রাখে নিজের অজান্তেই। বেশি আগ্রহি হয়ে ওঠে। বাসায় আসতে সন্ধ্যা হলে বাগানে গিয়ে দাড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে কখন আসবে। শুধু কি পুরুষেরাই সৌর্ন্দযে মুগ্ধ হয়, নারীরা হয় না? আর সে নারী যদি হয় সুন্দরী । সে অনায়াসে সোজাসুজি ভালোবেসে বলতে পারে – ভালোবেসে আমি জলপ্রপাতের মতো তোমার বুকে ছড়িয়ে পড়তে পারি। জানি না কেন তোকে আমি এতো বেশি ভালোবাসতে চাই! শাওলি নিজেই টের পায় যে, রবিনকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। আবার নিজেকে নির্লিপ্ত করতে চায়। ফিরে যায় নিজের মনের গহীন কোঠরে।

আজ আকাশের চৈত্র পূর্ণিমার চাদঁ। খুব টলটল করছে। বাগানে বসে সেদিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে নিরবে কাঁদছিল শাওলি। আজও চাদঁ দেখলে আশ্চর্যভাবে ওর মাতৃত্ব জেগে ওঠে। সেই আগেকার মতো। আজই চাঁদের আলো ওর শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারতো। আলোর পিপাসায় কাতর হয় শাওলি। ওই চাঁেদর মতোই হতে পারতো তার ফুটফুটে সন্তান ! দু-হাত মুখ ঢেকে ফোফাতে থাকে শাওলি। রবিনের কানে যায় সে সুর। আজ জয়িতা বাড়ি নেই। রবিন দিশেহারা হয। কিকরবে ভেবে পায় না। ছুটে আসে সে। শাওলরে মাথায় হাত রখখ্।্্এত আরো ভেতরে ভেতরে মুষরে পড়ে শাওলি। শাওলিকে ধরে নিয়ে যায় ভেতরে। রবিনের স্পর্শ পেয়ে কান্নারা হয়ে ওঠে অদম্য । কোনো কিছু মাথায় আসেনা। শাওলি রবিনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। রবিন বুঝে ওঠতে পারে না। এই প্রথম কোনো নারীর স্পর্শ পেল। ভালোভাবে দেখে শাওলিকে। অলংকারছাড়া নাক, গলা, কান। মাথায় এলামেলো চুল থেকে সরাসরি একটা সুগন্ধ নাকে চলে এলো। উতলা হয় রবিন। শাওলি আরো জড়িয়ে ধরে। শার্টের বোতাম ছিড়ে যায়।

শাওলির চোখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দেয়। ঠোঁট নেমে আসে কপালে, ঠোঁটে। শাওলি অস্থির হয়ে ওঠে কেপে কেপেঁ। নদীর বুকে অভিলাষ ফিরে পায় শাওলি। একটু বেচেঁ থাকার আশায় যতটুকু বলিদান দিয়েছে সে এক জীবনে , একজনে তা করতে পারে না। বাসনার রাত জেগে ওঠে। মনে পড়ে সোহাগের সাথে কাটানো রাতগুলোর কথা। সেখানে রক্তাক্ত আর ছিঁড়ে-খুড়ে যাওয়া । আর এমন আদর এমন সোহাগই তো সে চেয়েছিল। হ্যা, এই তো সেই মানুষ , যাকে নিয়ে স্বপ্নের ঘোরে চষে বেড়াতো পৃথিবী। মনে মনে বলে,‘‘ এমনই আমার প্রেম, এমনই আমার জীবন।‘ জল-সমুদ্রে ডুব দেয় শাওলি। সপ্তর্ষী তারারা ফণা তুলে শাওলিকে শাসায়,‘ তোমার এ ভালোবাসা পাপ, এ ভালোবাসা পাপ’। তবুও নিজের শরীরের মধ্যে খুজে বেড়ায় রবিনকে। চাতকের মতো হাহাকার করে ওঠে হ্নদয়। ভালোবাসার খোঁজে ছুটে যায় নীল গ্রহের বুকে।

রবিনই সব গুছিয়ে নেয়। সোহাগের কাছে ডিভোর্সের কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয। শাওলির বিয়ে হয় যখন তখন তার গর্ভে বাস করছে তিন মাসের অংকুর। শাওলির দিন যায আর মাতৃত্বের বেদনা বাড়তে থাকে। ততই শাররীক অবনতিও ঘটে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই রাত দিন কাটে রবিনের। নয় মাস ও অপেক্ষা করেনা সে, পৃথিবীতে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মাকে কষ্ট দেয়,যন্ত্রণায় ছটফটায় শাওলি। হাসপাতালে নেয়ার আগে বোনের হাত ধরে বলে,‘ আপু দেখিস আমার সন্তানকে যেন কেউ অভিশপ্ত বলতে না পারে। তুই ওর মা হবি। আমার সন্তান যেন তার বাবার মতোই প্রফেসর হয। জয়িতা কাঁদে, রবিন কাদেঁ। তোমার কিছু হবে না॥ আমি আছি তো- রবিন শাওলিকে স্বান্তনা দেয়। । অবশেষে নিজের কলঙ্ক মুছে দিয়ে মা হয় শাওলি। কিন্তু যার জন্য এতে কলঙ্ক , এতো অপবাদ ছিল ।তার জন্য আর অপেক্ষা করে না শাওলি। সে পৃথিবীতে এলেও নিজের অপমানের শোধ নিয়ে নিজেই ফিরে গেল সপ্তর্ষী তারার কাছে। যার জন্য এতো ক্লেদ, এতো শ্লেষ মুছে দিয়ে গেল । শুধু নিয়ে গেল দগদগে চিহ্ন ভরা ঘাত-প্রতিঘাতের হৃদয়।