এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার
“আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে” ইহা একটি বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত বেদ বাক্য, কিন্তু অন্যান্য অনেক বেদবাক্যের মত “আইন নিজস্ব গতিতে চলার” উক্তিটি মিথ্যা ও বানোয়াট; সুবিধাভোগী মহল আইন নিজস্ব চলার গতি আছে মর্মে প্রচারের মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হচ্ছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অসহায় মানুষ যাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা মামা বা টাকার জোড় নাই, রয়েছে শুধু বুক ফাটা কান্না এবং চোখে মুখে হতাশা। “আইন” একটি নির্জিব পদার্থ। তবে প্রয়োগের মাধ্যমে এর সরব গতি ফিরে আসে। আইন নিজস্ব গতিতে নয়, বরং আইন যারা প্রয়োগ করে তাদের গতিতেই আইন চলমান হয় এবং আইন প্রয়োগকারীর প্রয়োগ করার ইচ্ছা শক্তির উপরই নির্ভর করে আইনের গতি কতটুকু চলমান।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, ২৮/০৪/২০২১ ইং তারিখে গুলশান থানাধীন অভিজাত ফ্লাটে নিহত কলেজ ছাত্রী মোসারত জাহান মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়ার অভিযোগ তার ছোট বোন মুনিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু দেশবাসী দেখলো যে, গুলশান থানায় মামলা রেকর্ড করা হয়ে দন্ডবিধির ৩০৬ ধারায়, (সূত্র: গুলমান থানা মামলা নং-২৭(৪)২০১১ ধারা ৩০৬ দ:বি:)। অর্থাৎ মামলাটি রুজু করা হয়েছে “আত্নহত্যার প্ররোচনা দেওয়া।” পোষ্ট মার্টম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত হত্যা না আত্নহত্যার অজুহাত পুলিশ দেখাতে পারে, কিন্তু বাস্তব অবস্থা কি সেটাই পর্যালোচনার বিষয়। ইতোপূর্বে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিক আহম্মদ আকবর ছোবহানের এক পুত্র সাব্বির হত্যার আসামী হয়ে ছিল, সে মামলার ফলাফল কি হয়েছে দেশবাসী এখনো তা জানতে পারে নাই। মামলাটি এখন ড্রীপ ফ্রিজে। মুনিয়ার এ মামলা কখন কোথায় হারিয়ে যাবে তাহাও আঁচ করা যাচ্ছে না। আইন কখনো কখনো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে এবং কোন কোন সময় তা কর্পুরের মত বাতাশের সাথে মিশে যায়। তবে আইন কখন কোন মুর্তি ধারন করবে তা নির্ভর করে ভিটামিনের উপর। ভিটামিন (টাকা) যে যত ঢালতে পারে সে আইনের মজা তত লুটতে পারে, পূবেই বলেছি যে, আইন একটি নির্জিব জড় পদার্থের মত, যে ভাবে খুশী এর প্রয়োগ করে, তবে এ ক্ষেত্রে “সরকারী দল” এবং “ভিটামিন” যদি একত্রিত হয়, তবে হয়ে যায় ষোল করা পূর্ণ।
কোন ঘটনা ঘটলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেতুমন্ত্রী বলে থাকেন যে, “কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।” কিন্তু ছাড়তো তারা দিয়ে দিয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশ ঘটনার দুই দিনের মধ্যে প্রধান আসামী বসুন্ধরা গ্রুপের এম.ডি সায়েম সোবহান তানভীর ও তার পরিবারের মোট ৮ (আট) জন সদস্য বিশেষ চাটার্ড বিমানে দুবাই চলে গেছেন। যেমন ঘটেছিল শিকদার গ্রুপের দুই পুত্রধনদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পরও বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন, দেশে ফিরেছেন পিতার মৃত্যুর পর। দেশে ফিরেই আবার জামিনও পেয়ে গেছেন। কারণ তারা বাংলাদেশের অন্যতম ধনী। ফলে এটাই বলা বাহুল্য যে, আইন কখনো কখনো কচু পাতার পানিতে পরিনত হয়। এ জন্য প্রয়োজন শুধু ভিটামিন অর্থাৎ টাকা এবং টাকা এবং টাকা, যা প্রতিরোধে কোবিড-১৯ এর মত কোন বিকল্প পন্থা এখনো আবিষ্কার হয় নাই, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড় না দিলে আসামীদের নিয়ে বিমান আকাশে উড়লো কি ভাবে? এর পরও “ছাড়” না দেয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হামকি ধমকি কোথায় থাকে? এগুলি লোকদেখানো বুলি মাত্র।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী উপজেলা রূপগঞ্জে আহম্মদ আকবর সোবহান একটি আতঙ্কের নাম। তার হাউজিং কোম্পানী বসুন্ধরার সাইনবোর্ড এখন রূপগঞ্জের আনাচে কানাচে সর্বত্র। খাল বিল নদী নালা তিন ফসলী জমি গোরস্তান, ঈদগাহ, মসজীদ, স্কুল সবই এখন বসুন্ধরা বালু দ্বারা ভরাট করে ফেলছে। বাধা দিতে যেয়ে গুম হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। কৃষকদের নিকট থেকে জমি ক্রয় না করে ভরাট করে ফেলায় হাই কোর্টে গ্রামবাসী রিট করে দীর্ঘ শুনানীর পর হাই কোর্ট বালু ভরাট বন্ধ রাখার জন্য বসুন্ধারার মালিক আহম্মদ আকবর সোবহানকে নির্দেশ প্রদান করলেও হাই কোর্টের আদেশ কার্যকরী হয় নাই বরং জমি ভরাটের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু আক্ষেপ করে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন আমরা কনটেম্পট করতে করতে হয়রান। এতেই প্রতিয়মান হয় যে, আইন কখনো কখনো কচুপাতার পানিতে পরিনত হয়, যার প্রতি বিচার বিভাগের অবদান কম নহে। বসুন্ধরার আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এলাকাবাসী বহুবার মানববন্ধন করেছে, প্রশাসনের নিকট স্বারক লিপি দিয়েছে, কিন্তু নারায়নগঞ্জের ডি.সি, এম.পি, টি.এন.ও এর নিকট ধর্না দিয়েও কোন প্রতিকার পায় নাই। দৃশ্যত মনে হয় রাষ্ট্র যেন বসুন্ধরা বা তাদের মত ধনী লোকদের পকেটে চলে গেছে।
এ দিকে নিহত মুনিয়ার ভাই সরকার দলীয় হুইপ ও চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য শামছুল হক চৌধুরীর পুত্র নাজমুল চৌধুরী শারুনের বিরুদ্ধে বোনের হত্যাকারী হিসাবে অভিযুক্ত করে ঢাকা মূখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেছেন। ম্যাজিস্টেট্রেট মহোদয় বলেছেন তিনি “নথি দেখে আদেশ” দিবেন। ধনী বা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হলেই “নথি দেখে আদেশ” দেয়ার প্রশ্ন উঠে। ফলে উপরের নির্দেশই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে মামলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তবে এ মর্মে আইনী বিধান নিম্নে উল্লেখ করা হলো। ফৌজদারী কার্যবিধির ২০৫(ঘ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে যা নিম্নরূপ :-
“ (১) পুলিশ রিপোর্ট ছাড়া অন্য প্রকারে দায়েরকৃত মোকদ্দমার (অতঃপর নালিশী মামলা বলিয়া উল্লিখিত) অনুসন্ধান বা বিচার চলাকালে যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দৃষ্টিগোচর করা হয় যে, তাহার আদালতে অনুসন্ধান বা বিচারাধীন অপরাধটি সম্পর্কে একটি পুলিশী তদন্ত চলিতেছে, তখন উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট তাহার দ্বারা পরিচালিত অনুসন্ধান বা বিচার কার্য স্থগিত রাখিবেন এবং উক্ত বিষয় সম্পর্কে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার রিপোর্ট তলব করিবেন।
(২) যদি তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ধারা ১৭৩ এর অধীন রিপোর্ট পেশ করেন এবং এইরূপ রিপোর্টের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট যে ব্যক্তি নালিশী মোকদ্দমার আসামী তাহার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেন, তাহা হইলে ম্যাজিস্ট্রেট নালিশী মামলা এবং পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়েরকৃত মোকদ্দমা একই সাথে অনুসন্ধান বা বিচার করিতে পারিবেন যেন উভয় মামলাই পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ের হইয়াছে।
(৩) পুলিশ রিপোর্ট যদি নালিশী মোকদ্দমার কোন আসামী জড়িত না হয়, বা পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট যদি কোন অপরাধ আমলে গ্রহণ করেন, তাহা হইলে তিনি যে অনুসন্ধান বা বিচার স্থগিত রাখিয়াছিলেন, অত্র কার্যবিধির বিধান অনুসারে সেই অনুসন্ধান বা বিচার কার্যে অগ্রসর হইবেন।”
যাদের ক্ষমতা ও টাকা আছে তাদের নিকট “আইন” কচু পাতার পানির মতই মনে হয়। হত্যার মত ঘটনা ঘটলেও তারা থাকে ধরা ছোয়ার বাহিরে। হুইপ পুত্র শারনের প্রথম স্ত্রী শারুনের অত্যাচারে তাকে তালাক দিয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। মেয়েটি যদি নারী নির্যাতনের জন্য হুইপ পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা করতো তবে হয়তো “নথি দেখে আদেশ” দেয়ার মন্তব্য করে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে নেমে পড়তেন। তালাক দেয়া প্রথম স্ত্রী জানিয়েছে যে, তাকে দেন মোহরানার টাকা পর্যন্ত দেয়া হয় নাই। প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেয় না এমন বহু প্রমাণ আছে। দৃশ্যত মনে হয় পুলিশ ও ধনী ব্যক্তিদের জন্যই যেন দেশটি স্বাধীন হয়েছিল, কারণ এ দুটো শ্রেণীই সূখে ও নিরাপদে আছে, বাকী জনগণ রয়েছে জিম্বী অবস্থানে।
“আইনের” দুমূখী আচরনের কারণে আইনের প্রতি গণমানুষ আস্থা হারিয়েছে। ফলে “আইন” কাউকে সুফল দিতে পারছে না, যারা সুফল ভোগ করছেন তারা আইনের বাম হাতকে (খবভঃ ঐধহফ ড়ভ ঃযব খধ)ি ব্যবহার করেই আইনী সুবিধা ভোগ করছেন। এ মর্মে বসুর হাট পৌরসভার মেয়র আঃ কাদের মির্জা (যিনি সেতু মন্ত্রীর ছোট ভাই হয়েও মন্ত্রীর প্রতিপক্ষ) আইন কি ভাবে দুমূখী আচরন করে তার একটি নমুনা উল্লেখ করেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন যে, “আমার নেতাকর্মীদের জামিন চাইলে এক সপ্তাহ পর পর শুনানীর তারিখ দেয়া হয়, কিন্তু জামিন হয় না। অন্যদিকে বাদলের (সেতু মন্ত্রী অনুগত) মামলা শুনানী ২৫ মার্চ নির্ধারণ করা হলেও এক ঘন্টা পর দুইটি মামলায় জামিন হয়।” এ মর্মে মেয়র প্রধান বিচারপতির কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, “এটি কেমন বিচার ব্যবস্থা?”
প্রধান বিচারপতির নিকট কাদের মির্জা যে প্রশ্ন রেখেছেন এ প্রশ্ন আজ স্বাধীন বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনগণ যারা আইনের যাতাকলে আইন প্রয়োগকারীদের দুমূখো আচরনের শিকার। মাননীয় প্রধান বিচারপতির এহেন সরল স্বীকারোক্তি প্রশংসার দাবী রাখে বটে, কিন্তু দায়িত্বের ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন কি? বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আইন প্রয়োগে হয়রান হয়ে থাকেন তবে ভুক্তভোগী জনগণের অবস্থা কি দাড়ায়। স্বাধীনতার সুফল সার্বিক ভাবে দেশের গোটা জনগণ ভোগ করতে পারছে না, মুষ্টিমেয় সরকারী দল ছাড়া। খেয়ে দেয়ে যাদের পেট মোটা হয়ে গেছে, সে পেট আরো মোটা করার জন্য প্রতি জেলায় চলছে সরকারী দলে ভাগ বাটোয়ারার লড়াই, সে লড়াইকে সরকার বন্ধ করতে পারছে না। শুধু বুলি আওয়াছে “কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।”
লেখক
রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)
মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬