জানালা দিয়ে পরশীর বাড়ির রেডিও থেকে নিজের ছেলের গাওয়া গান প্রথমবার শুনেছিলেন তার মা। মা চেয়েছিলেন ছেলে মস্ত বড় অফিসার হবে লেখাপড়া শিখে। কোনভাবেই গানকে সর্মথন করেন নি। পালিয়ে -লুকিয়ে চুরিয়ে গান গাইতেন ছেলেটি। কিন্তু নিজের ছেলের গান কানে শুনে আর ছেলেকে কিছু বলতে পারলেন না। কি জাদু তার সেই সুরে !! কি অসাধারণ সুর আর স্নিগ্ধ ও মোহনীয় কণ্ঠের ছোঁয়া ।
সেই ছেলেটি কেউ নয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । তিনি বাংলা সঙ্গীতভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, হয়ে উঠেন সঙ্গীতের বরপুত্র, হয়ে আছেন সুরের জাদুকর। আজ ৫ অক্টোবর তার মৃত্যুবার্ষিকী । বাংলা সঙ্গীত জগতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক কালজয়ী নাম। গুণী এই শিল্পীর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই মহান শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। কালজয়ী এই সঙ্গীতব্যক্তিত্ব সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতানুরাগীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে আছেন। শিল্পীসত্তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে কি করে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায়, সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা যায়- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনজুড়েই তার উদাহরণ রয়েছে। আজও তিনি সুরের জাদুকর হয়েই বেঁচে আছেন বাঙালির মানবস্রোতে।
ভারতের কাশীর বেনারসে ১৯২০ সালের ১৬ জুন মামাবাড়িতে জন্মেছিলেন বাংলা গানের এই প্রথিতযশা শিল্পী। তার সুরেলা কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর আধুনিক গান আজও গেঁথে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। তিনি হিন্দি সঙ্গীত জগতে হেমন্ত কুমার নামে প্রসিদ্ধ। পঞ্চাশ-ষাটের দশককে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় আধুনিক গানের প্রবাদ পুরুষ।
তার আদি নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। তার ছেলেবেলা কেটেছে জয়নগরের বহেডু গ্রামে তিন ভাই আর একমাত্র বোন নীলিমার সাথে। বাবা ছোট চাকরি করতেন। মা হাসিমুখে চার ছেলেকে নিয়ে সামলাতেন সংসার। চব্বিশ পরগনা থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। বড় ভাই তারাজ্যোতি ছোটগল্প লিখতেন। হেমন্ত মেজো। হেমন্তের ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় গান করতেন। কিছু বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন এবং ১৯৬০-এর দশকে কিছু গানও গেয়েছিলেন।
ছয় ফুট দেড়ইঞ্চি লম্বা হেমন্ত কখনও ওস্তাদের কাছে গান শিখেননি। লোকমুখে শুনে শুনে গান তুলে নিতেন গলায়। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের ক্লাসরুমে বসে গান গাইতেন। একবার সেই গান শুনে ফেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। স্কুল থেকে প্রায় বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। পরে বাবা গিয়ে অনেক অনুরোধ করে সামাল দেন।
শিক্ষাজীবনে হেমন্ত ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে ছিলেন। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। হেমন্তকে রেডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। শৈলেশ দাসগুপ্তর সহায়তায় ১৯৩৫ সালে ১৪ বছর বয়সে রেডিওতে প্রথম গান গাইলেন হেমন্ত। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লেখা ও কমল দাশগুপ্তর সুরে গানটি ছিল ‘আমার গানেতে এলে, নবরূপ চিরন্তনী’।
এ গানটি খুব একটা জনপ্রিয়তা না পেলেও ১৯৩৭ থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে সঙ্গীতজগতে প্রবেশ করেন। এ বছরই ম্যাট্রিক পাস করেন হেমন্ত। এরপর গ্রামোফোন রেকর্ড Columbia লেবেলে নরেশ ভট্টাচার্যের লেখা ও শৈলেশ দাসগুপ্তর সুর করা ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো বলো মোরে’ গান দুটি ধারণ করেন।
সেই থেকে প্রতি বছর তিনি গ্রামোফোন কঃ অব ইন্ডিয়ার জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। কিন্তু তিনি সঙ্গীতের নেশায় আপন শিক্ষা ত্যাগ করেন। তার সাহিত্যিক হবার ইচ্ছে ছিল। কিছুদিন তিনি দেশ পত্রিকায়ও লেখেন। ১৯৪০ সালে সঙ্গীত পরিচালক কমল দাসগুপ্ত হেমন্তকে দিয়ে ফাইয়াজ হাস্মির কথায় ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ ও ‘ও প্রীত নিভানেভালি’ গাওয়ান। তিনি প্রথম ছায়াছবির গান গেয়েছেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবির জন্যে।
১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর সাড়া জাগানো ছবি- শাপমোচন, নীল আকাশের নিচে, হারানো সুর সহ অনেক বিখ্যাত ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তার গাওয়া অসংখ্য বিখ্যাত গানের মধ্যে ‘রানার’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা’, ‘ঝড় উঠেছে’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’, ‘আমার গানের স্বরলিপি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
হেমন্তকে বাদ দিয়ে আধুনিক বাংলা গানের কথা ভাবাই যায় না। আধুনিক গান ছাড়াও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্র সংগীত ও রজনীকান্তের গান গেয়েছেন। বেশ কিছু চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো’, ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা, ও বাতাস আঁখি মেলোনা’, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি’, ‘এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার…শুধু দুজনে’, ‘মেঘ কালো, আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো’ এবং ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার-সম্মাননার পাশাপাশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডি.লিট।