প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে সৃষ্ট অন্তঃকলহ স্বাধীনতার প্রশ্নে ভুলে যান জাতীয় চার নেতা!

আপডেট: এপ্রিল ১৭, ২০২১
0

সোহেল সানি

মুজিবনগর সরকার গঠন ও পদপদবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পাঁচ সদস্যের ‘হাইকমান্ড’ জড়িয়ে পড়েছিল অন্তঃকলহে। প্রকটরূপ ধারণের আগেই দেশমাতৃকার স্বার্থে মুহূর্তে তা ভুলে গিয়েছিল হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে হাইকমান্ড নামে পরিচিত ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংসদীয় দলের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা এম মনসুর আলী, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান, পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল হোসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাইকমান্ড বলতে পাঁচ নেতাকেই বোঝাত। অন্তঃকলহের সূত্রপাত ঘটে একাত্তরের আট এপ্রিল সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগেই হাইকমান্ডভুক্ত নেতাদের না জানিয়ে তাজউদ্দীন আহমেদ দিল্লিতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়ায়। এতে কলকাতার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে উপস্থিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের পাশাপাশি যুবনেতাদের মধ্যেও চরম বাকবিতণ্ডায় এক তিক্তকর পরিস্থিতির উদ্রেক করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক সদস্যদের মধ্য থেকে জোরেশোরে দাবি করা প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা এম মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করার। আর দ্বিতীয় দাবিদার হতে পারেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান।

প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে পরিচয় দান নিয়ে। উল্লেখ্য একাত্তরের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে রাত একটায় পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো গ্রুপ কর্তৃক গ্রেপ্তারের প্রাক্কালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপায়নের অবশ্যকীয় শর্ত-সরকার গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় তাঁর অবর্তমানে সরকারকাঠামোর প্রকৃতি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রশ্ন ওঠে, তাজউদ্দীন আহমেদের নীতি নৈতিকতা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে মতভেদ থাকলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে যে চার নেতাই ছিলেন যে বঙ্গবন্ধু অন্তঃপ্রাণ তার প্রমাণ তারা রেখেছেন। এম মনসুর আলী তাজউদ্দীনের প্রতি সদয় হয়ে সেদিন যে উদারতা প্রদর্শন করেন তা বিরল। তিনি অস্থিরতাহীন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীশক্তি দ্বারা অসীম নৈব্যর্ত্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিকতা নিয়ে কটাক্ষ করলেও বলেন, তিনি এটা ঠিক করেননি, তবুও বিরাজমান অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীরূপে তাজউদ্দীন আহমেদকে মেনে নেয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। বস্তুত মনসুর আলীই প্রথমে কামরুজ্জামানকে এবং পরবর্তীতে ১১ এপ্রিল আলাপ-আলোচনা করে খন্দকার মোশতাককে দিল্লিতে পেশকৃত সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে ‘জায়েজ’ করাতে সমর্থ হয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রিত্ব দাবি করায় সমস্যায় পড়েন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। এ মন্ত্রণালয়টি নিজের হাতেই রাখতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু মোশতাক তখন তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানবেন জানিয়ে দেন। বেকায়দায় পড়ে মোশতাকের হাতে ছাড়তে হয় পররাষ্ট্র দপ্তর। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করার চাল চালেন মোশতাক। এবং সে অনুযায়ী আপোষ করতে হয় তাজউদ্দীনকে। তারপর ঘোষণা করা হয় যে, ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আত্মপ্রকাশ করবে। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যে স্বল্পতম সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটায় তা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। খন্দকার মোশতাক বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের চক্রান্তে পা দিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারান। পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের মাধ্য ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলে ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার রাজধানী কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করে বঙ্গভবনে এসে ওঠেন।

মোশতাক চলে যান তার আগামসি হলেনস্থ বাড়িতে। ২২ তারিখ তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নতুন করে শপথ নিয়ে নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। খন্দকার মোশতাকের স্থলে আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। আইনমন্ত্রী হিসেবে মোশতাককে শপথ গ্রহণের আহবান জানালেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফেরেন। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদগ্রহণ করলে তাজউদ্দীন মন্ত্রিপরিষদ বিলুপ্তি ঘটে। নতুন মন্ত্রিসভায় মোশতাক বিদ্যুৎ ও সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যার পর বিশ্বাসঘাতক মোশতাক রাষ্ট্রপতি হন। ৮১ দিনের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে তিনি জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিরাই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে হত্যার আগে কারাগারে পাঠান। চারনেতা খন্দকার মোশতাকের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে প্রমাণ করেন যে, তাঁরা যথার্থ অর্থেই বঙ্গবন্ধুর যোগ্যতম সহচর ও উত্তরাধিকারী ছিলেন।-

উল্লেখ্য, ইয়াহিয়ার অধীনে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর সকল প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করেই ঘনিয়ে এলো মহা বিপর্যয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ শুধু পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদেই নয়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় পাকিস্তানের এ রাজনৈতিক সংকটের কারণ। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে নব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের ব্যতিক্রমী এক গণশপথ গ্রহণ করিয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন,”কেউ বেঈমানী করলে তাকে জ্যান্ত কবর দেবেন।” বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা হিসাবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (ন্যাশনাল এসেম্বলি) নেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা নির্বাচিত হন।

পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন এম মনসুর আলী। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলি এবং হুইপ করা হয় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে। অচিরেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির আলোকে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির পক্ষে একটি সাব-কমিটি গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ওই সাব-কমিটির পদবী ক্রমানুসারে সদস্যরা হলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেউ নির্বাচনে জয়ী না হওয়ায় সাব-কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী জাতীয় পরিষদে বিরোধী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশকারী পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলি ভুট্টো শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। ভুট্টোর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি দলের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে শাসনতন্ত্র রচনা নিয়ে বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। বৈঠকে ভুট্টোর একটি চমকপ্রদ উক্তি “ডোন্ট ফরগেট শেখ মুজিব, দ্যাট আই গট লারজেক্ট নাম্বার অব ভোটস ইন দি ক্যান্টনমেন্ট’। সামরিকজান্তা ইয়াহিয়ার গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়ে ভুট্টো কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা সকলেই বুঝতে সক্ষম হন। ৩১ জানুয়ারি ভুট্টো সদলবলে ঢাকা থেকে করাচী উড়াল দেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। পহেলা মার্চের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বৈঠকে পাঞ্জাবের মালিক সফররাজ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা যোগ দেন। সর্বসম্মতিক্রমে খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন লাভ করলেও তা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ক্ষমতাদান করা হয় পার্লামেন্টারী পার্টিকে দেয়া হয়।

পূর্বানী হোটেলে বঙ্গবন্ধু যখন অনুমোদিত শাসনতন্ত্রের খুটিনাটি নিয়ে বৈঠকরত তখনই ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। মূহুর্তে ছাত্র-জনতার ঢলে ঢাকার রাস্তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ‘৬ দফা না এক দফা – এক দফা, এক দফা’ শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পল্টনে বিরাট জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব ও জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন। নেতৃবৃন্দ হোটেল পূর্বাণীতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বেলা সাড়ে চার টায় জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, আমরা যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।

২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে পূর্ণ হরতাল পালনের আহবান জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে ভবিষ্যত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ওদিন একটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী হাইকমান্ড গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও যাতে নেতৃত্ব পরিচালিত হয় সেজন্যই ওই হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তাজউদ্দীন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেনকে নিয়ে সেই হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের লাইব্রেরির কক্ষটিকে “কন্ট্রোল রুম” হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ছিলেন নেতৃবৃন্দকে সহায়তা করার দায়িত্বে। ২ মার্চ ছাত্রলীগ আয়োজিত জনসমুদ্রে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব। পরদিন ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় ছাত্রলীগের আয়োজিত জনসমাবেশ থেকে সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরের বাসভবনটি ছিল সংগ্রামের সুতিকাগার। সকালে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা ভীড় জমান ওখানে। বক্তৃতা করেন। পার্লামেন্টারী পার্টির হুইপ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায়, ইতিমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করলাম, “বঙ্গবন্ধু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। সারাদেশের মানুষের ভালোবাসা তাঁকে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথাই যেন বাঙালীর প্রাণের কথা। বঙ্গবন্ধুর মনের কথা যেন তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন। ইঙ্গিতই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ মুষ্টিবদ্ধ হাত মুখে রেখে বঙ্গবন্ধুর কথা কান পেতে শুনতেন। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর একটি খসড়া তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি করে দেয়া হলেও সর্বময় ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ওপরই ন্যস্ত করা হয়। ৭ মার্চ অপরাহ্নে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে তাঁর ভাষণ শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম। ভাষণের প্রতিটি শব্দ, ভাষা ও ভঙ্গির মধ্যে তিনি একটি ইতিহাস আবৃত্তি করলেন। আবেগময়ী সেই ভাষণে বাঙালী জাতিকে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আহবান জানিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির বানী শোনালেন। সেই ভাষণ ছিল একদিকে জ্বালাময়ী অপরদিকে নির্ভুল যুক্তি ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ী। বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষে বাড়িতে ফিরে সমবেত সহকর্মীদের বললেন, স্বাধীনতা ঘোষণা

করে আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম। এখন দেশবাসীর দায়িত্ব হলো হানাদার বাহিনীকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করা।” ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। ওই নির্দেশের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্মদিনে সকালেই আওয়ামী লীগের সভা ডাকেন। বৈঠকে সবাই মত দেন যে সশস্ত্র পন্থায়ই পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য সমর্থন নিয়েও আলোচনা হয় সভায়। তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের সংগ্রামকে গণনভিত্তিক সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করতে হবে। সবশেষে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য সকলকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারাদেশে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ বাংলাদেশের সর্বত্র উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

ওদিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের হাতে বৈঠককালে বঙ্গবন্ধু একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। ইয়াহিয়া খান বলেন পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। কিন্তু ২৪ মার্চও তিনি নীরব থাকেন। উল্টো সামরিক বাহিনীর লোকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের দাবি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে ” সোয়াত জাহাজে” করে অস্ত্র আসছে। বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে একটি নির্দেশ পাঠান। কিন্তু জিয়ার কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ২৪ মার্চ এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সকলকে ঢাকা ছেড়ে যাবার জন্য নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু বাসভবনের পেছনে গিয়ে এক মিনিট করে উপস্থিত সকল নেতার সঙ্গে কথা বলেন। বিকেল থেকেই বাসভবনে থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। বিকেল থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ, অন্যতম হুইপ আব্দুল মান্নান, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামসহ নেতাদের প্রায় সকলে বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনের জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আমার আত্মগোপন সম্ভব নয়, আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।” ২৫ মার্চ বিকেলে পুনরায় তাজউদ্দীন আহমদ, ডঃ কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম আত্মগোপনের প্রশ্ন তুলেছিলেন। রাত সাড়ে আটটায় সাংবাদিকদের কাছে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায়, রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হাজির হন ডঃ কামাল হোসেন ও আমীর উল ইসলাম।

বঙ্গবন্ধুকে তাঁরা আবার আত্মগোপনের কথা বললে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমরা ওয়াদা করেছো, আমি যা নির্দেশ করবো তাই শুনবে। এই মূহুর্তে আমার বাসভবন ছেড়ে তোমরা চলে যাও। শহরের সব খবর আমার কাছে আছে। ইয়াহিয়া ঢাকা ছাড়ার পরপরই আক্রমণ শুরু হবে। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে ঢাকার সকল লোককে ওরা হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক এটা আমি চাইনা। ওখান থেকে আমি এবং ডঃ কামাল হোসেন তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে যাই। বিডিআরের একজন হাবিলদার এসে বললেন, পাকবাহিনী হামলা করছে। শয়ন কক্ষ থেকে লুঙ্গি ও গায়ে পাঞ্জাবি পরিহিত তাজউদ্দীন আহমদ কাঁধে একটি ব্যাগ ও ঘাড়ে একটি রাইফেল ঝুলিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি ডঃ কামাল হোসেন নেমে গেলেন। তাজউদ্দীন আহমদ লালমাটিয়ার রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল গফুরের বাসায় গেলেন। গফুরের বাড়ির অসম্পূর্ণ ছাদের ইট-সুরকীর ওপর বসে পাক সৈন্যদের হামলার মুখে ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার শুনছিলাম। মধ্য রাতে ব্রাশফায়ার ও বিকট শব্দ শুনে তাজউদ্দীন আহমদ কেঁদে উঠলেন। বললেন এবার দস্যুরা ৩২ নাম্বার বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করছে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিষোদগার করেন। নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ৯৭ ভাগ ভোট পাওয়া আওয়ামী লীগকে। সুতীব্র ক্রোধ বেরিয়ে আসে ইয়াহিয়ার ভাষণে। ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর ভারত বা বিশ্বের কোন গণমাধ্যমে প্রচার না হলেও ২৬ মার্চের রাতে অষ্ট্রেলিয়া বেতার এ হত্যার খবর প্রচার করে। এদিকে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নদী পার হয়ে জিনজিরার দিকে চলে যান। শেখ কামাল ও শেখ জামাল বাড়ি থেকে আগেই বেরিয়ে পড়েছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান কোন খবর পাওয়া যায়নি। তাজউদ্দীন আহমদ নদী পার হয়ে ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে নবাবগঞ্জ চলে যান। এক যুবক পরিচয় দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে মোটরসাইকেল করে তার গ্রামে। পরে মোটরসাইকেলেই ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকেও যুবকটি নিয়ে যায়। সুবেদ আলী টিপু এমপিএ বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। ওখান থেকে আশরাফ চৌধুরী এমপিএ এর বাড়িতে। পদ্মার তীরে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ফরিদপুরে পৌঁছা। শেষে ইমাম উদ্দিন এমপিএ এর বাড়িতে। তাজউদ্দীন সেখানে বসে রাজবাড়ীর মহাকুমা প্রশাসক শাহ ফরিদের কাছ থেকে শুনতে পান কিছু খবর। শাহ ফরিদ চুয়াডাঙ্গায় যোগাযোগ করতে জানতে পারেন যে, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক এলাহী চৌধুরী চুয়াডাঙ্গার পুলিশ ও বিডিআরের সঙ্গে যোগোযোগ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়ার জনগন পাক সেনার বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু শাহ ফরিদ পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। অনেক রাতে তাজউদ্দীন আহমদ মাগুরায় গিয়ে দেখলেন মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরি করে ফেলেছেন। সেখানে সোহরাব হোসেন এমএনএ সংগ্রাম করছেন। সেখান থেকে সোহরাব হোসেন তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে জীপে করে ঝিনাইদহ পৌঁছেন। আব্দুল আজিজের বাসায় গিয়ে ওঠেন। সেখানে বসে এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে খবর পাঠানো হয়। যশোর সেনানিবাস জনগন ও মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছে। চুয়াডাঙ্গা মহাকুমা প্রশাসক অবাঙালি হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়। কুষ্টিয়ার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসকও বন্দী। মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্ব করেন। বেলা তিনটার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ সীমান্তের পথে রওয়ানা হন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম, তাওফিক এলাহি, মাহবুব উদ্দিন তার সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নেন ভারতে যাওয়ার। ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো

বেলা তিনটার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে সঙ্গে সীমান্তের পথে রওয়ানা হলেন। এর আগে তিনি ডাঃ আসহাবুল হক এমপিএ, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহি, মেজর ওসমান ও পুলিশের মাহবুব উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গায় বৈঠক করেন। সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে খালের ওপর একটি বৃটিশ আমলের তৈরি কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন বসে থাকলেন। প্রতিনিধি হিসেবে ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে পাঠালেন তৌফিক এলাহি ও মাহবুব উদ্দিনকে। কিছুক্ষণ পর একজন ভারতীয় সামরিক অফিসার জানালেন আপনাদের আগমনের খবর ইতিমধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। রাত আটটার দিকে বিএসএফ এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদকে জানান, তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশেই তিনি এসেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তির সংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সাহায্যের আবেদন জানালে গোলক মজুমদার বলেন, কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীজী এবিষয়ে বলবেন। দিল্লীর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয় জানিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে আশ্বস্ত করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিবেন। মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে দমদম বিমান বন্দরে নিয়ে যান। সেখানে বিএসএফ এর প্রধান ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিরাপত্তা প্রধান রুস্তমজীর সঙ্গে পরিচয় হলো তাজউদ্দীনের। বিএসএফ প্রধান তাঁর গাড়িতে চড়িয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে প্রথমেই প্রশ্ন করেন, আপনাদের নেতা শেখ মুজিব কোথায়? উত্তরে বলা হলো তিনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নির্দেশেই আমি এসেছি। এরপর ‘আসাম হাউজ’ নামে একটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। রুস্তমজী অতিরিক্ত কোন পোশাকআশাক না দেখে তাঁর পায়জামা ও কোর্তা দিলেন। ছয় ফুট লম্বা বিএসএফ প্রধানের কোর্তা তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সামাল দেয়া কষ্টকর হলো। বিএসএফ এর বিভিন্ন প্রধানরা গভীর রাতে জড়ো হলে বাড়িটিতে। আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএ সহ ছাত্র ও যুবনেতাদের তালিকা তৈরি করা হলো। যোগাযোগের জন্য বিএসএফ দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাজউদ্দীন তাদের জানান ইতিমধ্যে যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ, কুষ্টিয়া সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, চুয়াডাঙ্গা শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সাহায্য দিতে বিএসএফ রাজী হলো। পরদিন সকালে বিএসএফ নিজস্ব রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যার কথা প্রচার করা হয়। প্রথমে চুয়াডাঙ্গাকে বিপ্লবী সরকারের রাজধানী করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর মধ্যে সরকার গঠন পরিকল্পনা করা হয়। চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলে মেজর ওসমানের সঙ্গে তার তেজস্বী স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য ৬ নভেম্বর রাতে পাক বাহিনীর হাতে বেগম ওসমান নিহত হন। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তাজউদ্দীন আহমদ। সঙ্গে বিএসএফ প্রধান গোলক মজুমদার।সরজিৎ চট্টোপাধ্যায় পরিধেয় কাপড়চোপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্যুটকেসের ভেতর নিয়ে আসেন। ওখান থেকে রাত ১০ টার দিকে জীপে করে একটি মিলিটারি মালবাহী বিমানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাজউদ্দীনকে। এই মালবাহী বিমানে নেয়ার কারণ ছিল বিষয়টি গোপন রাখা। ভোরে পৌঁছার পর প্রতিরক্ষা কলোনীর একটি বাড়িতে রাখা হলো। রেহমান সোবহান, ডঃ আনিসুর রহমান, এম আর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া ও ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি আব্দুর রউফ তখন দিল্লীতেই অবস্থান করছিলেন। এম আর সিদ্দিকী কাছ থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর খবরাখবর পান তাজউদ্দীন। চট্রগ্রামে কালুরঘাট বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ও ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের কথা জানতে পারেন। এমআর সিদ্দিকী আগরতলা ও আবদুর রউফকে রংপুর পাঠিয়ে দেন তাজউদ্দীন। ময়মনসিংহ থেকে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও সৈয়দ সুলতান চিঠি হস্তগত হয় তাজউদ্দীনের। বিএসএফ প্রধান গোলক মজুমদারের মাধ্যমে ৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন আহমদকে প্রথম প্রশ্ন করেন,”হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না হলেও আমাদের বিশ্বাস তিনি তাঁর স্থান থেকে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোন মূল্যে আমাদের বিজয়ী হতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দরকার। ভারতের গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা চাই। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায় তাজউদ্দীন আহমদ নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেম ও মুজিব প্রেমে উদ্ধুদ্ধ এক সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। বেশি কাজ করেও কৃতিত্বের দাবি করতেন না। আমি যখন বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রস্তাব করি তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বুঝবেন না। ঠিক করলেন তাজউদ্দীন নিজেই দেশের নাম হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। একটি মনোগ্রাম চারপাশে গোলাকৃতি লাল এর মাঝখানে সোনালী রঙের মানচিত্র। রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান এলেন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বললেন রেহমান সোবহান। তিনি তাজউদ্দীনের ভাষণে এই কথাটি লিখলেন “Pakistan is dead and burried under mountain of Corpses ( পর্বত প্রমাণ লাশের নীচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে) এর সঙ্গে আমীর উল ইসলাম যোগ করেন, ” আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছেলেদের রক্ত ও ঘামে মিশে জন্ম নিচ্ছে নতুন বাংলাদেশের। ” ৫ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয় বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় দেন। ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই প্রথম তাজউদ্দীন শুনতে পান যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। যাবতীয় সহায়তা দেয়া হবে। ইন্দিরা গান্ধী অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল

নগেন্দ্র সিং দিলেন। একটি ছোট বিমানও দেয়া হলো। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় আসেন। গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে এইচ এম কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী ছিলেন। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদও ছিলেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, সরকার গঠনের প্রশ্নে পরিষদ সদস্যরা খুশি নন। তারা প্রিন্সেস স্ট্রিটের এমএলএ হোস্টেলে আছেন। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বুঝতে পারলাম। কামরুজ্জামানকে নিয়ে পরিষদ সদস্যরা একটি বৈঠকও করলেন। মিজানুর রহমান চৌধুরীও দ্বন্দ্বে ছিলেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রোডে বৈঠক বসলো। শেখ মনি তাঁর বক্তৃতায় বললেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী, বাংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে। এখন কোন মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মন্ত্রী মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে। বৈঠকে প্রায় সকলেই একই সুর। কামরুজ্জামান ছিলেন প্রাণখোলা সরল মানুষ। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে তিনি আর দ্বিধা করলেন না। ১০ এপ্রিল বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ মনসুর আলী, শেখ মনি ও তোফায়েল আহমেদ লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দর চলে যান আগরতলায় যাওয়ার জন্য। প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে মনসুর আলীর প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হলেও তাজউদ্দীন আহমদকে মেনে নিলেন। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ সম্প্রচারিত হলো ভারত রেডিও থেকে। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের কন্ঠে বলা হলো এখন ভাষণদান করবেন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। গোলক মজুমদারকে ১০ এপ্রিল এ ভাষণ সম্প্রচার করতে মানা করলেও তা প্রচার হয়ে যায়। সারা বিশ্ব জেনে গেলো সরকার গঠনের খবর। তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণের পর রাতে কর্নেল নুরুজ্জামান ও আব্দুর রউফ আসেন। খুঁজে পাওয়া গেলো সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নানকে। ওখান থেকে আগরতলা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান তিনি ডাঃ আলীম চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেই বাসা হতে পরচুলা ও মেয়েদের শাড়ি পরে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। কর্নেল ওসমানীও আগরতলায়।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা সেই গোঁফ আর নেই। খন্দকার মোশতাককে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন ডঃ টি হোসেন। সিলেট থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ ও চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরীও এসেছেন। তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুবুল হক চাষী আগেই আসেন। আগরতলার সার্কিট হাউজে বসে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হতে অনুরোধ করা হলো। খন্দকার মোশতাক খুবই মন খারাপ করে আছেন। বললেন তাকে যেন মক্কা পাঠিয়ে দেয়া হয়। টি হোসেনের ভাষ্যমতে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন।