ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় ভয়াবহ উৎপাদন বিপর্যয়

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
0

স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহঃ

ঝিনাইদহের ৬ উপজেলায় এক’শ কোটি টাকার গ্রামীন পাকা রাস্তা এই মৌসুমে ধ্বংস করা হয়েছে ইটভাটার জন্য ।ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে বিক্রি করতে ভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে আবাদি জমির পুষ্টি উপাদান কমে কৃষিপণ্যের ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। কিন্তু জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা লিজা জানান “সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা প্রদান করা হবে। এছাড়াও এ বিষয়ে জনসচেতনতা মূলক প্রচারনার ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে“।

ঝিনাইদহ কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ অঞ্চলে তিন ফসলি আবাদি জমি রয়েছে। এসব জমিতে ধান, পাট, পেঁয়াজ, গম, ভুট্টা, সরিষা, মরিচ, বেগুন, ডালসহ বিভিন্ন জাতের কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে সরকারি নিয়ম অমান্য করে এসব আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইট তৈরি করছেন ইটভাটার মালিকেরা। ফসল উৎপাদনের জন্য শতকরা ৫ ভাগ যে জৈব উপাদান দরকার, তা সাধারণত মাটির ওপর থেকে ৮ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত থাকে। কিন্তু ইটভাটার মালিকেরা মাটির উপরিভাগের এক থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত কেটে নিচ্ছেন। এতে কেঁচোসহ উপকারী পোকামাকড় নষ্ট হচ্ছে। ঝিনাইদহ জেলায় ১২৯টি ইটভাটা রয়েছে। অনুমতি না থাকায় কিছুদিন আগে পরিবেশ অধিদপ্তর ১৮ টি ইটভাটা গুড়িয়ে দিলেও সেগুলো বিশেষ রফার মাধমে পুনরায় চালু করা হয়েছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে জেলায় মাত্র ৭টি ইটভাটার পুরোপুরি কাগজপত্র আছে।

সরকারি বিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ সাড়ে চার বিঘা অকৃষি জমিতে একটি ইটভাটা নির্মাণের নিয়ম থাকলেও ঝিনাইদহের ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ ইটভাটা তৈরি করা হয়েছে জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। পৌরসভার মধ্যেও ইটভাটা স্থাপনের নজীর রয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে ইটভাটা গুলোতে কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে হাজার হাজার মণ কাঠ। সবচে বেশি ক্ষতি করছে পাকা রাস্তার। এলজিইডি, জেলা পরিষদ এবং ত্রান ও পুনর্বাসন বিভাগের কোটি কোটি টাকার রাস্তা ভারি গাড়ি চলাচল করে নষ্ট করছে। ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালের বিল্ডিং কনষ্ট্রাকশন এ্যক্টের ৩ ধারা মতে একটি পরিপত্র জারী করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগের (উন্নয়ন-২) উপ-সচিব জেসমিন পারভিন। গ্রামাঞ্চলে এলজিইডির রাস্তা রক্ষায় এই নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই পরিপত্র জারির পর থেকে রাস্তার ধারে বা যে কোন স্থানে সরকারের পুর্বানুমতি ব্যতিত কেও পুকুর, কুপ, জলাশয়, সেচনালা খনন করতে পারবে না। জারিকৃত পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যদি কেও এমন ভাবে পুকুর বা সেচ নালা খনন করে যার ফলে ভুমি, সড়ক বা পথের প্রতিবন্ধকতা বা ক্ষতি সাধন করে তবে তা ১৫ দিনে মধ্যে স্থানীয় জেলা প্রশাসক অপসারণ, খনন বা পুনঃখনন বন্ধ বা ভরাট করার আদেশ দিতে পারেন।

এই আদেশ পালনে ব্যার্থ হলে বিল্ডিং কনষ্ট্রাকশন এ্যক্টের ১২ ধারা মোতাবেক দুই বছরের জেল, অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ওই পরিপত্রে আরো বলা হয়েছে, পুকুর খনন করলে নিজ জমির ১০ ফুট অভ্যন্তরে জলাশয় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সরকারী রাস্তার কিনারা থেকে ১০ ফুট দুরত্বে ও ৪৫ ডিগ্রি ঢালের পাড় রেখে পুকুর বা জলাশয় খনন করতে হবে। দন্ডবিধির ১৮৬০ এর ধারা ৪৩১ মোতাবেক সরকারী রাস্তার ক্ষতি সাধন ফৌজদারী দন্ডনীয় অপরাধ। এই আইনে ৫ বছরের কারাদন্ড, জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। ফলে সরকারী রাস্তার ক্ষতি সাধন হয় এমন কাজ করা যাবে না।

কিন্তু ঝিনাইদহে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই রাস্তার ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। ইউনিয়ন ভুমি কর্মকর্তাদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে ভাটা মালিকরা জমির মাটি কেটে গ্রামীন সড়ক দিয়ে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘেœ। অথচ ইউনিয়ন ভুমি কর্মকর্তাদের কোন সরকারী রাস্তা বা জমির ক্ষতি সাধন হচ্ছে কিনা তা জানানোর জন্য জেলা প্রশাসন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একজন ইটভাটা মালিক জানান, প্রতিটি ভাটায় বছরে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ ইট তৈরি হয়। প্রতি হাজার ইট তৈরি করতে প্রায় ৮৮ ঘনফুট মাটি প্রয়োজন। সেই হিসাবে একটি ইটভাটায় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ঘনফুট মাটি দরকার হচ্ছে। মালিকেরা এক হাজার ঘনফুট মাটি মাত্র ৫০০-৭০০ টাকায় কৃষকের জমি থেকে কেনেন।

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক্টর, নসিমন, নাটাহাম্বারে মাটি পরিবহন করা হয়। এতে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। মাটি পরিবহনে মানা হয়না কোন নিয়ম কানুন। পাকা রাস্তায় মাটি পড়ে তা পথচারীদের বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। আর বারোটা বাজায় কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত সরকারী রাস্তার।

শৈলকুপার বড়–লিয়া গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, ‘টাকার লোভে জমির মাটি বিক্রি করি। কিন্তু মাটিকাটা জমিতে ফসলের এতো বড় ক্ষতি হয়, তা জানতাম না। ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা নিয়ে শৈলকুপা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আক্রাম হোসেন বলেন, ‘কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়ায় পুষ্টি উপাদান কমে গিয়ে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে কৃষি বিভাগ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।