বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিদ্যুত্ খাত

আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০২১
0

প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন

বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ‘রোল মডেল’। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে দেশ আজ বাণিজ্য-বিনিয়োগসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ সব খাতেই এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের দায়িত্ব হবে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে দেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করে জাতির জনকের

সেই স্বপ্ন পূরণ করা

বাংলাদেশ এবং জাতির সবটুকু অর্জনের সঙ্গে মিশে আছে বঙ্গবন্ধু নামটি। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের স্বপ্ন—মোট কথা জাতিসত্তার প্রতিটি কণায় কণায় তার সরব উপস্থিতি বিরাজমান। অথচ ইতিহাসের এই মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে কতিপয় নরঘাতক। জাতির ইতিহাসে অঙ্কিত হয় এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। আগস্ট তাই আমাদের কাছে শোকের মাস, শক্তির মাস। ইতিহাসের চাকাকে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য চালানো হয়েছে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। কিন্তু বাংলার জনগণকে বিস্মৃত করা যায়নি জাতির জনকের আদর্শ থেকে। তারা রুখে দাঁড়িয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, খুনিদের বিচারের দাবিতে রাজপথ রঞ্জিত করেছে। যার ফলে আজ খুনিদের বিচার হয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে আলোকিত অধ্যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ দেশের আপামর জনগণ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয়ের লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করেছিলেন। তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। শুরু হয় যুদ্ধবিদ্ধস্ত ধ্বংস প্রায় দেশ গঠনে জাতির জনকের দূরদর্শী নেতৃত্ব।

একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য তার স্বপ্নটি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে প্রজাতন্ত্রের সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। জাতির জনক বিদ্যুেক অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করে বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে রচিত মহান সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বিদ্যুেক অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে বিদ্যুতের প্রাপ্যতা এ দেশের সব মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার চঙ-৫৯ এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৩১ মে ওয়াপাদা-কে বিভাজন করে বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে বিদ্যুত্ খাতে এক নবদিগন্তের সূচনা করেন। ফলে সমগ্র দেশে বিদ্যুত্ উত্পাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্ব অর্পিত হয় পিডিবির ওপর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারি সিদ্ধান্তে তদানিন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় সিদ্ধিরগঞ্জ, ঘোড়াশাল এবং আশুগঞ্জে পাওয়ার হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। লোড সেন্টার বিবেচনায় উক্ত পাওয়ার হাবসমূহ এখন পর্যন্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনের গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড প্রকৌশলী সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে বলেন যে, ‘বিদ্যুত্ ছাড়া কোনো কাজ হয় না, কিন্তু দেশের জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুত্ সরবরাহের অবস্থা থাকিলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান গ্রামে বিদ্যুত্ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত্ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রাম বাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত্ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানি করিতে হইবে না।’ তারই ফলে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনেতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপরিসীম গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে জাতির পিতার নির্দেশনার আলোকে ১৯৭৭ সালে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গঠিত হয়। যার ফলে তার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে দেশে আজ শতভাগ বিদ্যুতের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।

১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে আহসান মঞ্জিলে জেনারেটরের সহায়তায় বিদ্যুত্ সরবরাহের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বিদ্যুতের যে যাত্রা শুরু হয় তখন থেকে ৭০ বছরে অর্থাত্ ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের স্থাপিত উত্পাদন ক্ষমতা যেখানে ছিল ৫৪৭ মেগাওয়াট, সেখানে জাতির জনকের দূরদর্শী নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাত্র সাড়ে তিন বছরে ২১৯ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত্ সংযোজনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে বিদ্যুতের উত্পাদন ক্ষমতা ৭৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতাবিরোধী সরকার ক্ষমতায় থাকায় পরবর্তীকালে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের আশাব্যঞ্জক কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।

’৭৫-এর পর দীর্ঘ ছয়টি বছর সীমাহীন কষ্টসাধ্য নির্বাসিত জীবন শেষ করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। সুদীর্ঘ ১৫ বছরের সংগ্রামের পর ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার যাত্রা শুরু করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে অনেক বৈপ্লবিক পরির্বতন সাধিত হয়। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে বিদ্যুত্ খাতে এক নবযুগের সূচনা হয়। এই সময়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন ১৬০০ থেকে ৪৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়।

২০০৯ সালে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন দিন বদলের সনদ ‘রূপকল্প-২০২১’। তিনি ঘোষণা দিলেন ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুত্ পৌঁছানো হবে। বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রী জাতিকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। ২০২১ সালের আগেই বিদ্যুত্ এখন প্রায় সবার ঘরে পৌঁছেছে। বঙ্গবন্ধুর পদাংক অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই বিদ্যুত্ খাতে তাত্ক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুত্’—এ স্লোগানকে সামনে রেখে জানুয়ারি ২০০৯ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ২০ হাজার মেগাওয়াটের অধিক বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ২৫ হাজার মেগাওয়াটেরও অধিক—এ উন্নীত হয়েছে যা সরকার গৃহীত লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার পূর্বেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।

আমরা এখন গ্রাহকগণকে নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। উন্নত বিশ্বের ন্যায় আধুনিক সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছি। স্মার্ট গ্রিড, আন্ডার গ্রাউন্ড বিতরণ ব্যবস্থা এবং গ্রাহক সেবা নিশ্চিতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর পথ ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আগামী দিনে দেশের বিদ্যুত্ ব্যবস্থাকে আধুনিক বিশ্বের ন্যায় উন্নত করা হবে ইনশাআল্লাহ।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ‘রোল মডেল’। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে দেশ আজ বাণিজ্য-বিনিয়োগসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ সব খাতেই এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের দায়িত্ব হবে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে দেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করে জাতির জনকের সেই স্বপ্ন পূরণ করা। তাহলেই তার আত্মা শান্তি পাবে এবং আমরা এই মহান নেতার সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবো। আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা এবং ডেলটা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়ন করা। জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক :মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল।

বিদ্যুৎ জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়।

ভাইস প্রেসিডেন্ট (একাডেমিক ও ইন্টারন্যাশনাল) আইইবি।

উপদেষ্টামন্ডলীর অন্যতম সদস্য,

চাঁদপুর জেলা আওয়ামীলীগ