ব্যক্তির পরিচয়ে ‘নাগরিকত্ব’ ও ‘জাতীয়তা’ গুলিয়ে ফেলা হয়েছে!

আপডেট: মে ২৫, ২০২১
0

সোহেল সানি

ব্যক্তির পরিচয়ে জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব-কে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতি পুর্নবহাল হলেও জনগণের জীবনবৃত্তান্তে নাগরিকত্বের পরিচয়কে ‘জাতীয়তা’ বলে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ, নাগরিকত্ব শব্দটি স্থাপন করে বাংলাদেশী লেখার প্রচলন করা যেতো। অথবা জাতীয়তাঃ বাঙালি ও নাগরিকত্বঃ বাংলাদেশী দুটি অপশন ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু জন্মনিবন্ধন, ভোটারনিবন্ধন, আইডিকার্ড, পাসপোর্টসহ ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্তে জাতীয়তা বাংলাদেশী লেখা হচ্ছে। যা স্পষ্টতই সংবিধান পরিপন্থী।

যদিও বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলে পরিচিতি হবেন মর্মে সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহাসিক সাংবিধানিক নির্দেশনা রয়েছে।
জাতীয়তা প্রশ্নে সরকারের উচিৎ ছিল এ সম্পর্কিত একটি সার্কুলার জারি করা।
কেননা বিদ্যমান সংবিধানে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ৭[ ৬। (২)-এ বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবে।
৭[৬।(১) -এ বলা আছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে।
সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন পাস হয় এবং ৩ জুলাই থেকে তা কার্যকর হয়।

জাতীয়তাবাদ কি?
জাতীয়তাবাদঃ সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে দফা ৯-এ বলা হয় যে, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সঙ্কল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।
১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিলে পাস হওয়া সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন ১৯৭৯ সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়। যাতে জাতীয়তাবাদ পুনর্বহাল হয়। ওই রায়ে বাহাত্তরের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতি পুনর্বহাল করার আদেশ দেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হবার পর অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি হওয়া খন্দকার মোশতাক কর্তৃক তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান হন। অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানের নানা ঘটনাপ্রবাহে মোশতাক – সায়েমের পর জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতিগুলো হত্যা করেন বিভিন্ন সামরিক ফরমান ও অধ্যাদেশ জারী করে। তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদ এর স্থলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দর্শন নিয়ে রাজনীতির ময়দানে আবির্ভূত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডকে বৈধতা দান করা হয়েছিল সংবিধান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। তৎকালীন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের উত্থাপিত পঞ্চম সংশোধনী বিল ২৪১-০ ভোটে পাস হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের প্রস্তাবনা, মূলনীতি পূনর্বহাল করেন।

ফলে সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা পুনর্বহাল হয়। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধনী আইন জাতীয় সংসদে পাস করে। কিন্তু ব্যক্তির পরিচয়ে জাতীয়তা বাংলাদেশী রয়ে যায়। অথচ সংবিধানে নাগরিকত্ব বাংলাদেশী বলা হয়েছে। বিষয়টিতে সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি বলেই মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।