এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার
কাতার ভিত্তিক টেলিভিশন মিডিয়া আল-জাজিরায় সম্প্রতি সেনা প্রধানকে কেন্দ্র করে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তা এখন সকলের মোবাইলে, যা নিয়ে রাস্তা ঘাটে মাঠে ময়দানে প্রায়সই আলোচনা হচ্ছে।
আলোচনার বিষয়বস্তু সকলেই জেনেছেন, তবে সরকারী দল আল-জাজিরায় প্রকাশিত রিপোটিংকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করছেন। সরকারী ঘরনার বুদ্দিজীবীরা আল-জাজিরায় প্রকাশিত সংবাদকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন। আল-জাজিরায় মিডিয়ায় সম্প্রসারন বন্ধ করার জন্য হাই কোর্টে রীট হয়েছে। সরকার বিরোধীরা সংগত কারণেই আলোচনার বিষয়বস্তু খুজে পেয়েছেন। সরকারের অন্যতম সমালোচক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরউল্ল্যাহ বলেছেন “রিপোর্ট নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কেন না এ বয়সে আমার জেলে যাওয়ার শখ নেই।” ৬ই ফেব্রুয়ারি/২০২১ ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে সাউথ এশিয়ান ষ্টাডিজ: বাংলাদেশ আয়োজিত” সম্প্রতিক কাশ্মীর পরিস্থিতি এবং দক্ষিন এশিয়ার স্থিতিশীলতা” শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন যে, “বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ বলেছেন যে, ইসরায়েলের সঙ্গে কোন সম্পর্ক হলে বাংলাদেশে মুক্তির আন্দোলন হবে না, সব আরব দেশ বাংলাদেশের বিপক্ষে যাবে। কিন্তু আমরা কখন কি করছি, তা এখন ইসরায়েলি যন্ত্রের মাধ্যমে পৌছে যাচ্ছে” (সূত্র: জাতীয় পত্রিকা, তাং-০৭/০২/২০২১ ইং)।
সরকারের অন্যতম সমালোচক ডা. জাফরউল্ল্যাহ চৌধুরী যখন আল-জাজিরাকে নিয়ে কথা বলতে জেলের ভয় করছেন সে যেহেতু সংগত কারণেই আল-জাজিরায় প্রকাশিত রিপোটিং এর সত্যতা যাচাই বাছাই করে পত্রিকায় কলাম লিখাও অনেকটা ঝুকি পূর্ণ। তাছাড়া মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশে কতটুক বিদ্যমান তাহাও মাথায় রেখেই কলম ধরা যুক্তিসংগত।
আল-জাজিরা নিয়ে আলোচককে মধ্যে আলোচনা সমালোচনা যাহাই হউক না কেন সরকার এর দায় দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কারণ রিপোর্টটি সত্য কি মিথ্যা বা কতটুকু সত্য বা কতটুকু মিথ্যা তার প্রমাণ পত্র দাখিল করে জনগণের নিকট প্রকাশ করার দায় দায়িত্ব সরকারের। সরকারী ঘরনা থেকে বলা হয়েছিল যে, বিষয়টির উপর মামলা করার জন্য সরকারের প্রস্তুতি চলছে। মামলা করলেও সরকারকে তথ্য উপাত্ত দিয়েই মামলা করতে হবে এবং আল-জাজিরায় রিপোটিং যে মিথ্যা তারও প্রমানাদি সরকারকে পেশ করতে হবে। সেনা প্রধানের পরিবারকে নিয়েও আল-জাজিরায় (তাদের মতে) জোড়ালো বক্তব্য রেখেছে, এ সম্পর্কেও সরকারকেই বিষয়টি জনসম্মূখে প্রকাশ করে পরিষ্কার করতে হবে।
নতুবা এ আলোচনা সমালোচনার দ্বার বন্ধ হবে না বরং বাড়তেই থাকবে, ফলে জেল জরিমানার ভয়ে কতক্ষন মানুষ মূখ বন্ধ রাখবে, আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই কত জনের মুখ বন্ধ রাখতে পারবেন? করোনার টিকা নেয়ার বিষয়ে পাল্টা পাল্টি বক্তব্য চলছে। সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা করোনা টিকা নিজেরা তো নিয়েছেন এবং এ টিকা নেয়ার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করছেন। বিরোধী দল থেকে কিছু বক্তব্য দেয়া হচ্ছে, এ বক্তব্যকে প্রতিহত করার জন্যই সরকারী দলের এ উত্তেজনা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, নির্বাচনী উৎসবের মতো টিকা নেয়ার উৎসব চলছে, এমনটাই ছিল তার বক্তব্য। যিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সার্কাস মার্কা নির্বাচন দিয়ে জাতির সাথে তামাশা করেছেন তার মূখে যদি টিকা উৎসবের বানী দেশবাসীকে শুনানো হয় তবে এটার মর্মার্থ যাহাই হউক না কেন জাতির নিকট এটা হাস্যাস পদ।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যে, ভেজাল মদ খেয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, মদ খোর মদ খেয়ে মরে যাবে এতে খুব হতাশ হওয়ার কিছুই নাই, কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন একটি পরিবারের সম্পদ, একটি সমাজের সদস্য তখন তার মৃত্যুও পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
এ ছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৮(১) এ বলা হয়েছে যে, “জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যোর উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত: আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় স্বাস্থ্যহানির ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধ করনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।” অথচ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা স্বত্বেও মদ বিক্রি, মদ তৈয়ার প্রভৃতি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জ্ঞাত সারেই হচ্ছে।
মদ খেয়ে জেলায় জেলায় মানুষ মরা যখন শুরু হয়েছে তখন পুলিশ ও র্যাবের টনক লড়েছে, শুরু হয়েছে ধরপাকড়। মদের দোকান, মদের বার বা মদ প্রস্তুত করা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি। তারপরও সরকার বিভিন্ন স্থানে মদ তৈয়রী ও ব্যবসা করার অনুমতি দিচ্ছে এবং এই সুবাদে ভেজাল মদ তৈয়রীও হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। ভেজাল মদ তৈয়রীর কারখানার খবর সরকারের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানেনা এটা বিশ্বাস করতে কষ্ঠ হয়। মদ ও নেশার প্রভাবে যুব সমাজ সহ সমাজের উচু তলায় একটি অংশ ডুবে রয়েছে। শুধু তাই নয় অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছে সমাজের উচ্চ বিত্ত, শিক্ষিত ও সম্ভান্ত পরিবারের সন্তানেরা। বিশেষ করে মেয়েরা।
ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত ক্লাব সহ তিন তারা থেকে পাঁচ তারা হোটেলে ডিজে পার্টী হয় এবং সে পার্টীগুলিতে প্রধান আকর্ষণ হলো যৌন উম্মদনা। এ যৌন উম্মদনার কারণে পারিবারিক জীবনে অশান্তি নেমে এসেছে যার পরিনতি হয় খুনের মাধ্যমে নতুবা আতœহত্যার মধ্য দিয়ে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা দিলেও ব্যর্থতার দ্বায় নিয়েই সরকারকে চলতে হচ্ছে। সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদ মোতাবেক বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। কোন প্রকার নেশা করা যেমন- ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংবিধানে নেশা বা মদ তৈরী/বিক্রি বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষনা দিলেও এখানেও সরকারের ব্যর্থতার দ্বায় নিয়ে চলতে হচ্ছে। সবচেয়ে দু:ক্ষজনক বিষয় এই যে, পুলিশের দায়িত্ব মাদক প্রতিরোধ করা, সেখানে পুলিশের একটি অংশ মাদকের সাথে জড়িত বলে পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশ পাচ্ছে। পুলিশের একটি অংশ মাদক ছাড়াও নানাবিধ অপরাধে জড়িত।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য পরিচয়ে একজনকে তুলে নেয়ার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ৬ পুলিশ সদস্যকে ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। ৬ জন পুলিশ কনস্টেবলই চট্টগ্রাম মেট্রো পলিটন পুলিশে কর্মরত (সূত্র: জাতীয় পত্রিকা, তাং-১০/০২/২০২১ ইং)। চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল্ল্যাহ কায়সার উক্ত ৬ জন পুলিশকে দু দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাদের বিরুদ্ধে চাদাবাজীর জন্য অপহরনের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ চাদাবাজী করে, মাদক ব্যবসা করে এ কোন নতুন সংবাদ নয়।
তবে কেন পুলিশ দিন দিন বেপোয়ারা হচ্ছে? অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, নির্বাচনে কারচুপি ও বিরোধী দলকে আন্দোলন সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার জন্য মিথ্যা মামলা দেওয়ায় প্রধান হাতিয়ার হলো পুলিশ। পুলিশ মনে করে যে, তারাই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। ফলে তাদের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে টু-পাইস কমিয়ে নেয়ার প্রবনতাই দিনে দিনে পুলিশের একটিকে বেপরোয়া করে তুলেছে।
চারিদিক থেকে সমাজের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়নের কথা বলে সমাজের অবক্ষয় দূর করা যাবে না। উন্নয়ন মনে প্রশান্তি বা পরিবারে সম্মৃদ্ধি আনে না।
কেবলমাত্র ইট সিমেন্টের উন্নয়ন জনগণের কাম্য নহে, মানুষ সূখে শান্তিতে এবং নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে চায়। ০৯/০২/২০২১ ইং তারিখে একই দড়িতে মা মেয়ের আতœহত্যা কিসের আলামত বহন করে? দেশের আপামর জনগণ সার্বিক ভাবে কি ভালো বা স্বস্থিতে আছে? প্রশ্নগুলির জবাব বা ব্যাখ্যা সরকার দিবে এটাইতো জবাবদিহিতা। কিন্তু রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা নাই বলে জনগণকে একতরফাভাবে রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্রের একমূখী প্রচার শুনতে হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের মুদ্রার মত ভিন্ন পিঠ থাকার কথা গণমানুষ উপলব্দি করলেও রাষ্ট্রযন্ত্র তা উপলব্দি করছে কি না তা আঁচ করা যাচ্ছে না।
লেখক
রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)
মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬