রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ যা বলেছিলেন

আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৩
0

রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্যটি মৌলিক কোনো রচনা নয় এবং নারী স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে… হুমায়ুন আজাদ
টেনিসনের প্রিন্সেস কাব্যের যে আর্টিয়া, প্রিন্সেস-এর আর্টিয়াটি রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদার মধ্যে নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা বলে একটি কাব্যনাট্যটি তাঁর কোনো মৌলিক রচনা নয় এটাও অন্যের লেখা হতে চুরি করা । এই গ্রন্থে রবীন্দ্র নারী স্বাধীনতার বলেছেন তা প্রকৃত পক্ষে নারীর স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে । হুমায়ুন আজাদ যা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছে যে এটি কত অসাড়!

রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা বলে একটি কাব্যনাট্য রয়েছে। যেটির শেষদিকের কয়েকটি পঙ্‌ক্তিকে অনেকদিন থেকেই নারীরা নারীমুক্তির শ্লোগান বলে মনে করছে। যে, আমি নারী, সামান্য রমণী — দেবী করে মাথায় রাখবে সেটি হবে না। আবার পায়ে রাখবে, তা হবে না। যদি সঙ্গে রাখো…ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা দীর্ঘকাল ধরে নারীদের একটা মূলমন্ত্রই বলা যাক, বলে গণ্য করা হয়েছে। আমি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি যে এটি কত অসাড়! এজন্য যে, এই যে চিত্রাঙ্গদা, যে রাজকন্যা হয়ে রাজপুত্রের ভূমিকা পালন করছিলো। যে রাজা হতো, সে শুধুমাত্র অর্জুনের প্রেমে প’ড়ে সমস্ত ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে দিয়েছে। তারপর সে বলছে, তুমি যদি আমাকে তোমার সঙ্গে রাখো, তুমি যদি তোমার চিন্তার অংশ দাও, তাহলে আমি ধন্য হই। নিজে চিন্তা করবে না, নিজে কাজে এগিয়ে যাবে না। অনেকটা এরকম হবে, স্বামী যদি বিজ্ঞানী হয়, তাহলে সে হয়তো তার টেস্টটিউব এগিয়ে দেবে, স্বামী যদি ডাক্তার হয় সে হয়তো নার্স হবে, স্বামী যদি ঔপন্যাসিক হয়, সে হয়তো পাণ্ডুলিপির কপিয়িস্ট হবে। এ-রকমই একটি অবস্থা!

এই যে চিত্রাঙ্গদা…সে বলছে, তুমি যদি আমাকে তোমার সঙ্গে রাখো, তুমি যদি তোমার চিন্তার অংশ দাও, তাহলে আমি ধন্য হই।…স্বামী যদি বিজ্ঞানী হয়, তাহলে সে হয়তো তার টেস্টটিউব এগিয়ে দেবে, স্বামী যদি ডাক্তার হয় সে হয়তো নার্স হবে, স্বামী যদি ঔপন্যাসিক হয়, সে হয়তো পাণ্ডুলিপির কপিয়িস্ট হবে। এ-রকমই একটি অবস্থা!…রবীন্দ্রনাথ…যে মুক্ত হতে পারতো, তাকে সীমাবদ্ধ, বন্দি করে ফেললেন খুব মধুরভাবে।

রবীন্দ্রনাথ কী করলেন — একটি নারী, যে মুক্ত হতে পারতো, তাকে সীমাবদ্ধ, বন্দি করে ফেললেন খুব মধুরভাবে। এবং সবাই ভাবলো কী মধুর! এবং এই চিত্রাঙ্গদা অবশ্যই মৌলিক নয় কিন্তু। এটি টেনিসনের প্রিন্সেস কাব্যের যে আর্টিয়া, প্রিন্সেস-এর আর্টিয়াটি রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদার মধ্যে নিয়ে এসেছেন। যদিও আমাদের বাংলা সমালোচকেরা কখনোই এ-সংবাদ রাখে না। প্রিন্সেস-এ একটি নারী, রাজকন্যা — যে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো এবং আর বিয়ে করবে না — দেখা গেলো তাকে নানা চক্রান্তের মধ্য দিয়ে ক্রমশ ক্রমশ ক্রমশ…সে ভেবেছিলো একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে…দেখা গেলো শেষে, ওটি বিশ্ববিদ্যালয় না হয়ে একটি হাসপাতালে পরিণত হলো এবং ঐ প্রিন্সেস একটি নার্সে পরিণত হলো! নারীর পক্ষে মুক্তি সম্ভব নয়। এবং রবীন্দ্রনাথ অবিকল সেই কাজ করেছেন।
হুমায়ুন আজাদ-এর সঙ্গে আলাপ (১৯৯৫)
[১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার হুমায়ুন আজাদের নারী বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তার কিছুদিন পরে এ সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। এটি দু পর্বে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার তখনকার সময়ের বিশেষ পাতা ‘সাক্ষাৎকার’-এ ছাপা হয়েছিল। হুমায়ুন আজাদ আরো পরে তাঁর দেয়া সাক্ষাৎকারের একটি সঙ্কলন আততায়ীদের সঙ্গে কথপোকথন প্রকাশ করেন, সেখানে প্রায় সব সাক্ষাৎকার সংযোজিত হলেও এটি তিনি সঙ্কলিত করেন নি। সাক্ষাৎকারে নিষিদ্ধ ঘোষিত বই নারী, তসলিমা নাসরিন, এরশাদ, আল মাহমুদ, সচিব, মন্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ, প্রবচন ইত্যাদি বিবিধ প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন হুমায়ুন আজাদ। উল্লেখ্য ২০০০ সালে হাইকোর্টের রায়ে নারী বইয়ের নিষেধাজ্ঞা বাতিল ঘোষিত হয়। আজাদ সাক্ষাৎকারে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, “এই বই আছে এবং থাকবে, বরং যারা নিষিদ্ধ করেছে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, বাতিল হয়ে যাবে, নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।”
লেখক :
মো.নূরা আলম
প্রাক্তন শিক্ষার্থী ঢাবি