সৈয়দপুরে শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি করা নিয়ে চলছে টাকার খেলা।।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইউপি কার্যালয়ে চরম হয়রানী

আপডেট: জুন ৩, ২০২১
0

শাহজাহান আলী মনন, সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধিঃ নীলফামারীর সৈয়দপুরে শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি করা নিয়ে চলছে টাকার খেলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যের অনলাইন ফরম পূরণে নেয়া হচ্ছে খরচ। আর প্রয়োজনীয় জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে ইউনিয়ন পরিষদে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি টাকা। এসব অর্থের কোন রশিদও দেয়া হচ্ছেনা।

এর সাথে যোগ হয়েছে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের জন্য ডায়াগনোসিস সেন্টারে যাওয়া ও ব্যায়ের ধকল। সেখানেও বাড়ানো হয়েছে ফি।এনিয়ে চরম হয়রানীর শিকার হচ্ছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের স্থায়ী ডাটাবেজ তৈরী করে স্বতন্ত্র ইউনিক আইডি প্রদানের জন্য তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।অনলাইনে এ সংক্রান্ত ফরম পূরণে শিক্ষা অফিস থেকে নির্দেশনা দেয়ার পর থেকে এ নিয়ে চলছে টাকার খেলা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি স্কুলেই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপচেপড়া ভিড়। স্কুল অফিসে অনলাইনের ফরম ডাউনলোড করে দুইপাতার ফটোকপি বিক্রি করা হচ্ছে ১০ থেকে ৩০ টাকায়। করোনার স্বাস্থ্য নির্দেশনা উপেক্ষা করে গায়ে গা ঘেষে চলছে ফরম সংগ্রহ।

আবার একইভাবে চলছে প্রয়োজনীয় কাগজ, ছবি ও তথ্যসহ পূরণকৃত ফরম জমা দেয়ার কাজ। এক্ষেত্রে স্কুলভেদে অনলাইন খরচ বাবদ নেয়া হচ্ছে ১শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা। সরকারী নির্দেশনা না থাকলেও এই টাকা নেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। টাকার বিপরীতে কোন রশিদও দেয়া হচ্ছেনা।

একই দৃশ্য উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদে। সেখানে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা ভিড় করছে জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য। কারণ জন্ম সনদের তথ্যের সাথে মিল রেখেই তৈরী হবে ইউনিক আইডি। তাই অনলাইনে ফরম পূরণের সময় জন্মসনদের স্ক্যান কপি আপলোড করতে হয়।

এই জন্মসনদ নেয়ার ক্ষেত্রে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। যাদের ইতোপূর্বে জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু সনদটি নেয়া হয়নি বা হারিয়ে গেছে। তাদের সনদের হার্ড কপি প্রিন্ট বাবদ নেয়া হচ্ছে ১শ’ থেকে ২ শ’ টাকা। আর একেবারে নতুন করে নিবন্ধন করা ও সনদ প্রিন্টের জন্য দিতে হচ্ছে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা।

এমনকি বাবা মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের পরিবর্তে জন্মসনদের সাথে মিলিয়ে সন্তানের জন্মসনদ তৈরী করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্মসনদও লাগছে। যে অভিভাবকদের জন্মসনদ সংগ্রহে নেই তারাও প্রিন্ট কপি নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাবা মা ও সন্তানের তিনটি জন্মসনদ প্যাকেজ বাবদ নেয়া হচ্ছে ১ হাজার থেকে পনেরশ’ টাকা।

এদিকে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের জন্য কোন কোন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ডায়াগনোসিস সেন্টার ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণেই ক্যাম্পিংয়ের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১শ’ থেকে ১২০ টাকা নিচ্ছে। যদিও খরচ হচ্ছে মাত্র ৪০ থেকে ৬০ টাকা।

যেসব প্রতিষ্ঠান এমন ব্যবস্থা নেয়নি সেগুলোর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ উদ্যোগে ডায়াগনোসিস সেন্টারে গিয়ে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে বাধ্য হচ্ছে। এতে ডায়াগনোসিস সেন্টারগুলোতে ভিড় বাড়ায় গ্রুপ নির্ণয়ের ফি ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১শ’ থেকে দেড়শ’ টাকা করেছে। ফলে যাওয়ার ভোগান্তি সহ বাড়তি খরচ ও হয়রানী হতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা জানায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মোবাইল করে দ্রুত অফিসে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়। অফিসে গেলে প্রথমেই ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকার বিনিময়ে দুইপাতার একটি ফরমের ফটোকপি ধরিয়ে দিচ্ছে। পরে বলা হচ্ছে দুই একদিনের মধ্যে এই ফরম পূরণ করে বাবা মাসহ শিক্ষার্থীর জন্মসনদ, ছবি ও অনলাইন খরচ ১শ’ টাকাসহ জমা দিতে হবে।

এসময় জানানো হয় সরকারী নির্দেশে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর ইউনিক আইডি করার জন্য এটা করা হচ্ছে। এই আইডি না করা হলে আগামী এক বছরের শিক্ষা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে যড দ্রুত সম্ভব ফরম জমা দিতে ব্যস্ত। সে কারণে একযোগে সবাই ছুটছে।

কিন্তু সরবরাহকৃত ফরম পূরণ করতে গিয়ে রক্তের গ্রুপ নিয়ে সমস্যায় পড়েন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। শহর কিংবা গ্রামের সিংহভাগ পরিবারই এব্যাপার বেশ অনভিজ্ঞ। বয়স্ক ও সচেতন কেউ কেউ নিজেরটা জানলেও ছেলে বা মেয়ের রক্তের গ্রুপ জানেননা। ফলে এজন্য ছুটছেন ডায়াগনোসিস সেন্টারে। অনেকের এ ব্যাপারে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ডায়াগনোসিস সেন্টারগুলো ইচ্ছেমত বাড়তি ফি নিচ্ছে।

এরপর জন্মসনদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েও একই পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। কোথাও ইউপি ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা কোথাও স্বয়ং ইউপি সচিব হাতিয়ে নিচ্ছেন অতিরিক্ত টাকা। সেখানে বাড়তি টাকা নেয়ার ব্যাপারে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। কেউ কিছু বললেই তাকে নানা কারণ দেখিয়ে বিলম্বিত করে হয়রানী করা হচ্ছে। ফলে অনেকটা নিরবেই দাবীকৃত টাকা দিয়েই জন্মসনদ সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। এতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে অবৈধ টাকা আদায়ের খেলা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউপি ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা জানান, মূলতঃ নতুন জন্মনিবন্ধন করার ক্ষেত্রে শূন্য থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনামূল্যেই দেয়া হয়। এরপর ৫ বছর বয়স পর্যন্ত করার জন্য ফি হলো ২৫ টাকা, ৫ বছরের পর ৫০ টাকা। জন্মতারিখ সংশোধনের জন্য ফি ১০০ টাকা এবং নাম, পিতার বা মাতার নাম, ঠিকানা সংশোধনের জন্য ৫০ টাকা। এছাড়া সংশোধনকৃত বা আগে থেকে সম্পন্ন জন্মনিবন্ধন সনদের কপি সরবরাহের জন্য কোন ফি নেই। কিন্তু ইউপি সচিব ও উদ্যোক্তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন অতিরিক্ত টাকা।

এই অনিয়ম ও দূর্নীতির ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে মোবাইলে জানানো হলে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু গ্রামের দরিদ্র অসহায় অল্প শিক্ষিত অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চেয়ারম্যান মেম্বারদের বিরুদ্ধে যেতে সম্মত হয়নি। কিন্তু প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন মাধ্যমে এ ব্যাপারে অবগত হলেও নিরব থাকায় ব্যাপকহারে চলছে জন্মনিবন্ধন ও ইউনিক আইডি নিয়ে চলছে প্রকাশ্যে টাকার খেলা।