‘হিজড়া এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠীকে পরিবারেই পুনর্বাসন করতে হবে’

আপডেট: জুন ২৭, ২০২২
0

হিজড়া এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠী জন্মের পর পরিবারেই প্রথম বৈষম্যের শিকার হন। সামাজিক নানান চাপে বাবা-মা তাঁদের পরিবার থেকে বের করে দিতে বাধ্য হন। এই জনগোষ্ঠী উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। বাবা-মা যাতে এই ধরনের সন্তানকে পরিবার থেকে বের করে না দেন এবং উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না করেন সে জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।

রোববার রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে ‘হিজড়া এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্য জনগোষ্ঠীর আইনগত সুরক্ষা: বর্তমান অবস্থা ও করণীয়’ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় আলোচকেরা এসব কথা বলেছেন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এলইজিডি প্রকল্পের আওতায় এ সভার আয়োজন করে।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সভায় খুলনা, রাজশাহী, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে হিজড়া এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠীরা অংশ নেন। সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, এই ধরনের জনগোষ্ঠীর সমস্যার শুরু হয় জন্মের পর থেকেই । বাবা-মা বাড়ি থেকে বের করে দিতে বাধ্য হন। বাবা-মা হিজড়াসহ এই জনগোষ্ঠীকে ভরণপোষণ করতে বাধ্য-এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে।

বিচারপতি মো. নিজামুল হক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দেওয়া বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা হিজড়ারা চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হলে তাঁদের আইনের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে বলেছেন। তবে চাঁদাবাজি কেন করতে বাধ্য হচ্ছেন তা আগে বের করতে হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে তাঁদের খাওয়া-পরার বন্দোবস্ত করতে হবে। আর এটা করতে পারলে তাঁরাও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

অনলাইনে আলোচনায় যুক্ত হয়ে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, হিজড়াসহ এই জনগোষ্ঠীর প্রতি মানুষের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। সংসদীয় কমিটির বেশ কয়েকটি সভাতেও হিজড়ারা ‘উপদ্রব সৃষ্টিকারী’, তারা মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে এই জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, এই জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে পরিবারকে উদ্যোগ নিতে হবে। উত্তরাধিকার আইনে ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ কে কতটুকু সম্পত্তি পাবে তার উল্লেখ আছে। তাই এই জনগোষ্ঠীর আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি প্রয়োজন। হিজড়াসহ ট্রান্সজেন্ডার বা কোনো ব্যক্তি যে পরিচয়ে পরিচিত হতে ইচ্ছুক তার সংজ্ঞা সুস্পষ্ট করাও জরুরি।

পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জিহাদুল কবির জানান, তাঁর নিজেরও হিজড়াদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছিল। তবে এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ধারণা পাল্টে গেছে। এ সময় থানায় গেলে পুলিশ এই জনগোষ্ঠীকে হেনস্তা করে না তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিনও সংজ্ঞা সুস্পষ্ট করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা এই জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকি হিসেবে কাজ করছে। বিভিন্ন আইনেও এই জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। আর শুধু নীতি বা আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, তা বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দও রাখতে হবে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) কামরুল ইসলাম চৌধুরী হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া ভাতাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন। হিজড়াদের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করতে হলে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান এই জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান থাকা জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আলাদা করে নয়, অন্য সবার সঙ্গেই এই জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে, তাহলে সমাজের মূলস্রোতধারায় তাদের অংশগ্রহণ সহজ হবে।

হিজড়া ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর জীবন-মান উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ এবং সামাজিক ও আইনি সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রথম অধিবেশন থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো পড়ে শোনান ব্লাস্টের গবেষণা বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আনবার আনান তিতির। তিনি জানান, ২০১৪ সালে সরকার হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এখনো এ জনগোষ্ঠী উন্নয়নের অংশীদার হতে পারেনি। ট্রান্সজেন্ডার বা যে নারী বা পুরুষ লিঙ্গের ভিত্তিতে পরিচয় দিতে ইচ্ছুক নন এমন মানুষগুলোও স্বীকৃতির বাইরে রয়ে গেছে। তবে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে, সম্প্রতি জনশুমারি এবং গৃহগণনায় হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ব্লাস্টের উপদেষ্টা তাজুল ইসলাম মতবিনিময় সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন।