অতি ভদ্রলোকেরা দুষিত নারীর সঙ্গে কথা বলতেই বেশি পছন্দ করেন : শুধু সুযোগের অপেক্ষায়

আপডেট: মে ৪, ২০২১
0

সোহেল সানি

এককালে পরিবার নিয়ে বিদেশ গমনের প্রথা প্রচলিত ছিল না। পরস্ত্রীগমন নিন্দিত থাকাতে, প্রায় সকল আমলা, উকিল- মোক্তারের এক একটি উপপত্নী অত্যাবশকীয় ছিল। সুতরাং তাঁদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে সংস্থাপিত হতো গণিকালয়। গ্রীসদেশে প্রাচীণকালে যেমন বুদ্ধিজীবী পন্ডিতরা বেশ্যালয়ে একাট্টা হয়ে সদালাপী হয়ে উঠতেন, সেইরূপ প্রথা এদেশেও প্রচলিত ছিলো। যাঁরা ইন্দ্রিয়াসক্ত নন, তাঁরাও পরস্পর আমোদের গা ভাসাতে গণিকালয়ে যেতেন। সন্ধ্যা থেকে রাত প্রহর পর্যন্ত বেশ্যালয়ে লোকপূর্ণ থাকত।

লোকে পুজার রাতে যেমন প্রতীমা দর্শন করে বেড়াতেন, বিজয়ার রাতেও তেমনি বেশ্যা দেখে বেড়াতেন। এমন বিবরণ উদ্ধৃত করতেও লজ্জাবোধ হচ্ছে। কিন্তু লজ্জাবোধ করে প্রকৃত অবস্থার প্রতি চোখ মুদিয়ে থাকলে কী চলে? তদনুরূপ অবস্থা তখন এদেশের অনেক নগরেই বিরাজমান ছিল। যশোহরে পদস্থ আমলা উকিলরা কোন নবাগত ভদ্রলোকের কাছে পরস্পরের পরিচয় পর্বে -“ইনি তাঁর রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকাবাড়ি করে দিয়েছেন”, এই বলে জাহির করতেন। পাকাবাড়ি করে দেয়া যেন একটা মানসম্ভ্রমের ব্যাপার ছিলো। যশোর শুধু নয়, বঙ্গদেশের ভদ্রসন্তানেরাও প্রকাশ্যে দূষিত-চরিত্রের নারীদের সঙ্গে মিশতে লজ্জাবোধ করতো না। এখনকার চিত্রটা তারই উত্তরাধিকার।

এখন অপ্রকাশ্য রঙ্গভূমিতে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতার ন্যায় স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরীর ভদ্রলোকেরা মদ্যপ অবস্থায় ওই শ্রেণির স্ত্রীলোকদের সান্নিধ্যে নৃত্যগীতে শামিল হচ্ছেন। তাঁরা সর্বাঙ্গে টাকা ছিটিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে চলেন। কারাবন্দী পাপিয়ার মতো এমন স্ত্রীলোকও থাকে, নামে তারা বিবাহিতা, কিন্তু আসলে তারা বিগহির্ত উপায়ে অর্থোপার্জনে লিপ্ত যৌনকর্মী। তাদের সামাজিক অবস্থা প্রকাশ্যে উন্নত হওয়ায় অসংকোচে ভদ্রবেশীদের মাঝে অবাধ যাতায়াতও রয়েছে। তিনতারা, পাঁচতারা রেস্তোরাঁয় এমনকি গুলশান বনানীর বিভিন্ন বাড়িতে মহোৎসবে নৃত্যগীত করে এবং ভদ্রকুলকামিনীদের অপেক্ষা অধিক সমাদরলাভ করে।

ঢাকার ক্যাসিনো ও পাপিয়া কাহিনী প্রকাশ তার প্রমাণ। পিতামাতা, ভাইবোন দেখছেন যে, তাঁদের সহস্র সতর্কতা সত্ত্বেও সন্তানরা ওসব কর্মে ভিড়ে যাচ্ছে। অর্থলিপ্সু কোন কোন পরিবারের মদদেও কোমলমতি মেয়েরা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকের আত্মাহুতির ঘটনা ঘটছে, যা গণমাধ্যমের নজর ছাপিয়ে ধামাচাপা পরে যায়। মোছারাত জাহান মুনিয়ার আত্মাহুতিও ঘটনা বিশেষ মাত্রা যোগ হবার মূলে কি কারণ রয়েছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নোংরা সমালোচনায় যারা নিমগ্ন তাদের অধিকাংশের উদ্দেশ্যে বলবো, বুকে হাত রেখে বলুন তো আপনারা সুযোগের অভাবে চরিত্রবান কিনা? নাম নিয়ে বলতে চাইনা মৃত্যুবরণকারী মুনিয়ার পরিবার থানায় রুজুকৃত মামলায় বললো এটি আত্মহত্যা, আর তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট প্রকাশের আগেই সমালোচনাকারীরা বলছেন পরিকল্পিত হত্যা! সুবিচারের দাবি শুভানুধ্যায়ীদের মুখে উচ্চারিত হবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এটাকে পূঁজি করে স্বনামধন্য ব্যক্তি-বিশেষের বিরুদ্ধে যে বিষোদগার করা জঘন্যরকম অবিচার শুধু নয় অপরাধও। আইনের পরিভাষা এমন যে, বাকস্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তার মানে এই নয় যে, আপনি সেই অধিকার প্রয়োগ করে অন্যের অধিকার হরণ করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট প্রতিষ্ঠাতা প্রধানবিচারপতি জন মার্শাল মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত একটি রায়ে বলেন,”কোন ব্যক্তির ওপর অধিকার প্রয়োগের আগে সতর্ক থাকতে হবে যে, অধিকার প্রয়োগের দোহাই দিয়ে কেউ যেন প্রতিপক্ষ ব্যক্তির অধিকার হরণ না করেন।” এ কারণেই মানহানি মামলার উৎপত্তি।

স্যাটেলাইটের সুযোগের সন্তানরা এমন অনেক বিষয় শিক্ষা নিচ্ছে যা তাঁদের জানা উচিত নয়। মায়ের অবিশ্রান্ত যত্ন ও বিরামহীন পরিশ্রমের গুণে এ অধঃপতন থেকে রক্ষা করার চেষ্টা কতটাই বা ফলপ্রসূ হয়? অতীতে অজ্ঞ অশিক্ষিতদের প্রবঞ্চনা করে পাপকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করত। এখন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা স্বপ্রনোদিত হয়েও পাপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে।বলা বাহুল্য, মদ্যপায়ীরা গীতিবাদ্যের অনুরাগী হয়। রাজাদের যুগের একটি বর্ণনা করছি, উৎসুক শ্রোতারা রাজাদের ন্যায় নিজেদেরও রাজা ভেবে সুগায়ক- সুগায়িকাদের গীতবাদ্য শুনছেন।

হঠাৎ একজনের মন কেড়ে নিল অল্পবয়স্কা কোনো এক বালিকা। একপ্রকার বালিকাটিকে সে কিনেই নিল। লোকটির প্রাসাদোপম বাড়িতে বালিকাটি নিয়মিত দাসী দলের মধ্যে পরিগণিতা হয়ে থাকলো। লোকটির মনোরঞ্জনে বালিকাটি নৃত্যগীত পরিবেশন করত। ক্রমে তার বয়স ১৮/১৯ বছর হল। একদিন গৃহিণী বললেন,” এ বালিকা এখন বয়ঃপ্রাপ্ত হতে চলেছে, তাকে সবার অলক্ষ্যে রাখা উচিত।” কিন্তু কর্ণপাত করলো না লোকটা। তৎপরে তাকে সুরাপান করিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতে বাধ্য করলেন। একরাতে নিজের বাড়িতেই আসর বসালেন।

অপূর্ব রূপসী ও অসাধারণ সুকন্ঠীর নৃত্যগীতে সবাই বিমোহিত হল। একজন বললো সে কেন নগ্ন নৃত্য করছে না। সুরাপানে তখন সবার মনপ্রাণ প্রফুল্ল। আদেশ অনুযায়ী সুন্দরী তরুণী একখানা কালাপেড়ে সূক্ষ্মধূতি পরে আসলো সবার সম্মুখে, যেন স্বর্গবিদ্যাধরী অবতীর্ণা হলেন। শ্রোতাদের ঢুলুঢুলু নয়নে এরূপ দৃষ্ট হলো। বিমোহিত হয়ে কেউ কেউ আপন আপন চরণ নিজ বশে রাখতে পারলেন না। প্রথমাবধি এক রাষ্ট্রবিজ্ঞবর ভাবগম্ভীর ছিলেন। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারলেন না। নাচানোর ছলে নিজেই নাচতে শুরু করলেন।

যে সমাজে সমাজপতি একটা দাসীশ্রেণীস্থ তরুণীদের সুরাপান করিয়ে তার সঙ্গে হাস্য পরিহাস করতে লজ্জাবোধ করেন না, যে সমাজে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিজ বাড়িতেও নিমন্ত্রিত ভদ্রমন্ডলীর মধ্যে এরূপ আমোদপ্রমোদ চলতে পারে, সে সমাজে সাধারণের নীতির অবস্থাটা কিরূপ আশা করা যায়? আমরা তো সেই সমাজেরই উত্তরাধিকার। যারা সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষোদগারে লিপ্ত, তারা অনেকেই ঢাকার অভিজাত হোটেলে সূরাপানরত অবস্থায় নৃত্যগীতে ঢুলতে দেখা। বিবেকের কাছে নিজেকে বিচার করুন, সুযোগ পেলে কি করতেন? দেখবেন সুযোগের অভাবে চরিত্রবান আপনি-আমি প্রায় সকলে এবং তা অর্থবিত্ত বিনোদনসহ সর্বক্ষেত্রে।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশ্লেষক।