আইনের শাসন বনাম প্রধান বিচারপতির আক্ষেপ – তৈমূর আলম খন্দকার

আপডেট: এপ্রিল ১৩, ২০২১
0

এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার

জনগণের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘদিন যাবৎই বলে আসছেন যে, দেশে আইনের শাসন নাই। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে আইন ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হয় দূর্বলের উপর। সচরাচর ক্ষমতাসীনদের উপর আইন প্রয়োগ হয় না। বাংলাদেশে স্পষ্টই আইনের প্রয়োগ দু’ভাগে হচ্ছে। ক্ষমতাহীনদের প্রতি আইন কঠোর হলেও ক্ষমতাসীনদের প্রতি আইন প্রয়োগকারীগণ সম্পূর্ণভাবে উদাসীন। যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, যাদের হাতে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন, লোভনীয় পদে পোষ্টিং দেয়ার ক্ষমতা ও যাদের অর্থ সম্পদ রয়েছে তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা খুবই আজ্ঞাবহ এবং এদের (ক্ষমতাসীন/ধনী) কোন অপরাধই অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম কিছু হয়, কোথাও কোথাও আইন প্রয়োগ হতে দেখা যায় যদি সংগঠিত ঘটনা মিডিয়াতে ব্যাপক হারে প্রকাশিত হয়। তখন সরকার নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য লোক দেখানো কিছু উদ্দ্যেগ গ্রহণ করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সংখ্যায় যা অত্যান্ত অপ্রতুল। নারায়নগঞ্জের ৭ খুনের মামলায় প্রধান আসামী ছিল ক্ষমতাধর এক মন্ত্রীর জামাতা যিনি কর্ণেল এবং অনেকগুলি ক্রস ফায়ারের হোতা এবং র‌্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার। ৭ খুনের একজন ভিকটিম যদি আইনজীবী না হতো তাহলে মিডিয়াতে এতো আলোরন হতো না। তখন সন্ত্রাসীরা এনকাউন্টার বা ক্রস ফায়ারে মৃত্যু হয়েছে বলে র‌্যাব প্রেস ব্রিফিং করে সরকার ও জনতার বাহাবা নিতো। মিডিয়াতে যখন সরকারী আমলা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনবিরোধী ও বেআইনী কর্মকান্ড ফলাও করে প্রকাশ করে তখনই সরকারের কান গরম হয়ে কিছু কার্যক্রম শুরু হয়, নতুবা এগুলি ঢাকা পরে যায় অতল গহব্বরে। পুলিশ ও র‌্যাব একটি ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারী এজেন্সী, তাদের মধ্যে একটি অংশ বিভিন্ন অপরাধসহ অপহরন, মাদক কারবারে জড়িত। ক্রস ফায়ার দেয়ায় নাম করে তারা লক্ষ কোটি টাকা জনগণের নিকট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। টাকা না পেলে মাদক বা অস্ত্র পাওয়ার অভিযোগে কোর্টে চালান করে দেয়।

গোষ্টি/ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আইনের শাসন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সুপ্রীম কোর্টের আদেশ আমলারা কার্যকর করে না। ফলে কোর্টের আদেশ পেয়েও ভুক্ত ভোগী জনগন প্রতিকার পাচ্ছে না। দুইজন সম্মানিত বিচারপতির (জনাব বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং জনাব বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম) লিখিত দুইটি বইয়ের মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে ১০/০৪/২০২১ ইং তারিখে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব বিচারপতি মাহম্মুদ হোসেন বলেছেন যে, “রাষ্ট্রের সবার দায়িত্ব সুপ্রীম কোর্টের রায় কার্যকর করা। আমরা কনটেম্পর্ট (আদালত অবমাননা) করে হয়রান। কনটেম্পর্ট করেও যথাযথ ভাবে রায় কার্যকর হচ্ছে না। এটা এখন দু:ক্ষের বিষয়” বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির এই দু:ক্ষ বা আক্ষেপ গোটা দেশ ও জাতির অন্তরের অন্তস্থলের বক্তব্যের প্রতিফলন। মাননীয় প্রধান বিচারপতির এ আক্ষেপ গোটা দেশবাসীর। মাননীয় বিচারপতিগণ ২/৩ পক্ষের (বাদী, বিবাদী ও রাষ্ট্র পক্ষ) বক্তব্য গভীর মনোযোগের সাথে শ্রবন করত: পরিশ্রম করে যে রায় প্রদান করেন তা কার্যকর না হওয়ায় দ্বায় দায়িত্ব মাননীয় প্রধান বিচারপতি এড়াতে পারেন কি? তারপরও একটি কঠিন সত্যেকে উপলব্দি করতে পারায় প্রধান বিচারপতিকে অন্তরে অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা এবং দেশবাসীও তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি আইনের ধারক ও বাহক। তিনি সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছেন। অন্যান্য মাননীয় বিচারপতিগণসহ তিনি যে শপথ বাক্য পাঠ করেছেন তাতে উল্লেখ রয়েছে যে, “আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত পোষন করিবো”, “আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষন, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিবো” এবং “আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরন করিবো।” প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ১১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাই কোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রীম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয়।” অনুচ্ছেদ-১১২’তে বলা হয়েছে যে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অর্ন্তভুক্ত সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রীম কোর্টের সহায়তা করিবেন।”

মাননীয় সকল বিচারপতিসহ প্রধান বিচারপতির শপথ ও সংবিধান তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে সে মোতাবেক কনটেম্পট করেও যদি বিচার বিভাগীয় আদেশ কার্যকর না হয় সংবিধান অনুযায়ী এ জন্য দায়ী কে? রায় কার্যকর না হওয়ার কারণে জনগণের যে ভোগান্তি হচ্ছে এ দ্বায়িত্ব কে বহন করবে? বিষয়টি জনগণের নিকট পরিষ্কার হওয়া দরকার। কারণ সাংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭(১) মোতাবেক জনগণই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক।

আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসনের কোন প্রকার অনুমতি ব্যতিরেখে বসুন্ধরা, ইষ্ট ওয়েষ্ট, ধানসিড়ি, পুলিশ হাউজিংসহ বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানী আবাসিক প্রকল্প করার জন্য নারায়নগঞ্জ জেলাধীন রূপগঞ্জ উপজেলার খাল, বিল, নদী নালা, পুকুর, গোরস্তান, তিন ফসলী জমি ভরাট করে ফেলেছে। এসব ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসী রীট পিটিশন করার পর শুনানীয়ন্তে অবৈধভাবে বালু ভরাট বন্ধ করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, নারায়নগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতি হাই কোর্ট নির্দেশ প্রদান করলেও উপরোক্ত কর্মকর্তাগণ হাই কোটের রায় কার্যকর করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই। উচ্চ আদালতের নির্দেশ যে রাষ্ট্রীয় কর্মচারী অর্থাৎ আমলারা কার্যকর করে না, এটাই তার অন্যতম প্রমাণ।

দেশের বিজ্ঞশালী লোকেরা মনে করে যে, রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রশাসনিক যন্ত্রের মতো দেশের আইন আদালত তাদের পকেটস্থ হয়ে পড়েছে। ফলে কোর্টের আদেশ বিত্তশালীদের একটি বাতুলতা মাত্র। কারণ বিজ্ঞশালীরা জানে যে, আমলা, পুলিশ ও প্রশাসন দ্বারা কোর্টের রায় কার্যকর হয়। ফলে আদালতের রায় কার্যকর কারিরা যদি বিত্তশালীদের পকেটে চলে যায় যেখানে আদালতের রায়ের তোয়াক্কা তারা করবে কেন? আদালতের রায় যার বিরুদ্ধে যায় সেতো স্বাভাবিক কারণেই রায় মানতে চায় না, আইনের শাসন কায়েম করার জন্য রায় মানাতে হয়। গ্রাম এলাকায় গ্রাম্যশালিশ প্রধানগণ অনেক বিষয়ে আদালতে বিচারাধীন বিরোধ আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেন। গ্রাম্য শালিশদের প্রদত্ব রায় তারাই কার্যকর করে যারা রায় প্রদান করেন।

রায়/আদেশ না কার্যকর হওয়ার বিষয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির উদ্দ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং তার সরল স্বীকারোক্তি প্রশংসার দাবী রাখে। তবে তার উদ্দ্যেগকে শুধুমাত্র আবেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, জনস্বার্থে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য তাকেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের প্রচলিত আইন এবং সংবিধান তাকে সে ক্ষমতা অর্পন করেছে, তিনি যদি তার ক্ষমতাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করেন তবে এমন কোন শক্তি নাই যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় নিজের মন মানসিকতা থেকে। অন্যদিকে পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ ক্ষমতাসীন দলের প্রাক্তন এম.পি’কে জামিন না দেয়ায় জজ সাহেবকে ঐদিনই বদলী করে আর একজন জজ বসিয়ে জামিন করানো হয়েছে, ফলে বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত বিচারকগণ সে অদৃশ্য শক্তিকে কেন ভয় পাবে না? সাবেক প্রধান বিচারপতি এস.কে. সিনহার বিদায়ের নাটক বিচার বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মনে কেন আতঙ্ক সৃষ্টি করবে না? এটাও একটি পর্যালোচনার বিষয়।

আদালত অবমাননা করে সাধারনত: বিত্তশালীরা। কনটেম্পট বা আদালত অবমাননার শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা বিচারপতিদের হাতেই। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী মোজাম্মেল হক ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের আদালত অবমাননায় জরিমানা হয়েছে বটে, কিন্তু মোটা দাগে আদালত অবমাননার জন্য শাস্তির পরিমাণ চোখে পড়ার মত নহে। এখনো এ ধরনের অনেক মামলা উচ্চ আদালতে পেন্ডিং আছে, এ মামলাগুলি দ্রুত নিষ্পত্তি হলে আদালত অবমাননাকারীদের হয়তো হুশ হতে পারে, তবে এজন্য আদালত থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সত্য প্রকাশ করতে সর্বোচ্চ বিচারালয়ের যে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে, তা জাতির জন্য একটি অশ্বনি সংকেত। সর্বোচ্চ আদালতের রায়/আদেশ অমান্যকারীরাই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে যা স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, “আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সফল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকসাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” সংবিধানের প্রস্তাবনা মোতাবেক সফল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিকসাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের কোন দায় দায়িত্ব আছে কি? বিষয়টি কি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির বিবেচনার দাবী রাখে?

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)

মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬