আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতেই প্রভাবশালী পত্রিকাটিকে আরো কব্জায় নেওয়ার ফন্দি —-এম আবদুল্লাহ

আপডেট: এপ্রিল ১, ২০২৩
0
m abdullah

আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতেই প্রভাবশালী পত্রিকাটিকে আরো কব্জায় নেওয়ার ফন্দি বলে মন্তব্য করেছেন বিএফইউজে সভাপতি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সিটি এডিটর এম আবদুল্লাহ।
তিনি তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে এ নিয়ে একটি স্টাটাস দিন। স্টাটাসটি দেশ জনতা ডটকমের পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হলো—-

প্রথম আলো দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্র- এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমার মত যাদের পত্রিকা পড়ার নেশা আছে, তাদের প্রথম আলো না পড়লে পত্রিকা পড়া সম্পন্ন হয়নি-এমনই মনে হবে। পত্রিকাটির বাম-বন্ধব সেক্যুলার সম্পাদকীয় নীতি এবং ইসলামোফোবিয়ার সঙ্গে আমার ঘোরতর দ্বিমত সত্বেও একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সুসম্পাদিত ও গোছানো সংবাদপত্রকে সমীহ করি। ক্ষমতাসীন সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, অনাচার ও অপশাসনের বিরুদ্ধে পত্রিকাটির ভূমিকা যেমন আছে তেমনি, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে, জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে তাদের আজন্ম নীতিতে কোন পরিবর্তন আমার কখনো নজরে আসেনি।

অবস্থান ধরে রাখতে অনেক সাহসী সংবাদ প্রকাশ করে নিয়মিত বিরতিতে। যে কারণে দৃশ্যত: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের রোষের মুখে থাকতে হয় পত্রিকাটিকে। আবার দৈনিক আমার দেশের মত প্রথম আলো পত্রিকা বা এর সম্পাদকের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সরকারকে হাজার বার ভাবতে হবে। কারণ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ভেতরেই আছে প্রথম আলোর অনেক সুহৃদ ও আদর্শিক মিত্র। সীমানার বাইরেও অভিভাবক অভিন্ন। সেক্যুলার রাজনীতির প্রধান মূখপত্র হিসেবে প্রথম আলোর মত পত্রিকা আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্যেই অপরিহার্য। আরও ডজন ডজন পত্রিকা আওয়ামী লীগ ও সরকারকে নিরন্তর সেবা দিয়ে গেলেও তা খুবই স্থুলভাবে। প্রথম আলো তা করে বেশ কৌশলে, মার্জিত কায়দায়। ফলে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী রাজনীতির উত্থানরোধে প্রথম আলো যে বিকল্পহীন তা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বুঝেন না-এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই।
তার পরও কেন প্রথম আলো এবং এর সাংবাদিকেরা সময়ে সময়ে রোষানলে পড়েন? এর উত্তর হচ্ছে- দেশি-বিদেশী ক্ষমতার নিয়ামক শক্তি ও জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা সংবাদপত্রটিকে চাপে রেখে ফায়দা নেয়ার লক্ষ্যে।
ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে অনেকে আমার দেশ ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বধ করার মিশনে প্রথম আলো এবং স্বগোত্রীয়দের ভূমিকা সামনে আনছেন। এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে লেখার আছে অনেক কিছু। তার উপযুক্ত সময় এখন নয়। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যে কোন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের বিপদের সময়ে পাশে থাকাই কর্তব্য মনে করি। প্রতিবাদে সম্মুখভাগে থাকতে চাই। রোজিনা ইস্যুসহ সব সময় আমরাই প্রতিবাদে সর্বাগ্রে সোচ্চার হয়েছি।
নিয়তির একটা বিধান আছে। যে পত্রিকাটি বিপরীত বিশ্বাসের মানুষদের বিরুদ্ধে হরহামেশা স্বাধীনতার চেতনার কার্ড ব্যবহার করে বড় হয়েছে, সে পত্রিকাটিকে এখন সেই চেতনা বিনাশী ষড়যন্ত্রের তকমা নিতে হয়েছে-এটাই বোধহয় পত্রিকাটির জন্যে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। আমার দেশসহ অন্তত তিনটি পত্রিকায় প্রবাসের একটি সংবাদের সঙ্গে একজন ব্যক্তিকে চেনাতে একটি ফাইল ফটো ব্যবহার করা হয়েছিল, তাকে ইস্যু করে কী না করা হয়েছে! সেটিও সম্পাদকের নজরে আসার পর দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়, ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কলমের জোশ চলে সরকারের মিশন জায়েজ করতে। একই ঘরানার ইংরেজী দৈনিকটি তখন বিশাল অনুসন্ধান চালিয়ে ব্যানার লীড পর্যন্ত করে বসেছিল। মাহমুদুর রহমানকে বধ করতে সরকারে প্রোপাগান্ডায় সহযাত্রী হয়েছিল। এখনও একটি ছবি নিয়ে কথিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হচ্ছে। চলছে নোংরামি। ব্যবধান কেবল সময়ের ২০১৩ থেকে ২০২৩।
মূল প্রসঙ্গে আসি। অনেকের স্মরণ আছে – কিশোর আলোর একটি অনুষ্ঠানে দুর্ঘটনাক্রমে বিদ্যুতায়িত হয়ে কলেজ ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম আলো সম্পাদকের মাথার ওপর অন্যায্য হত্যা মামলা ঝুলছে। চার্জশীট হয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার কাছাকাছি রয়েছে মামলাটি। দৃশ্যতঃ তার পর থেকে পত্রিকাটিকে অনেক আপস করে চলতে হচ্ছে। নিজেদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যর বাইরে গিয়ে ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জন্ম দিনে ৪ পৃষ্ঠার মলাট করে পাঠকদের রীতিমত চমকে দেয়। প্রথম সারির অন্য পত্রিকাগুলোর মত স্থুলভাবে না হলেও নিজেদের মত করে উন্নয়নের জয়গান গাওয়া শুরু করে তখন থেকেই। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে লুটপাটের সংবাদ পত্রিকাটির পাতায় মাঝেমধ্যে তুলে আনা হলেও তা ডাউন প্লে হতে শুরু করে।
একটা সময় শুধু বঙ্গবন্ধুর গুণগান দিয়ে সরকারের প্রভাবশালীদের সামলাতে পারলেও এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পত্রিকাটি সরকার প্রধানের দৈনন্দিন কর্মসূচির খবর দ্বিতীয় বা ভেতরের পৃষ্ঠায় স্থান দেওয়ার নীতি অনুসরণ করলেও খুনের মামলার খড়গ মাথায় ঝুলার পর তা প্রথম পৃষ্ঠায় তুলে আনতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম, মৃত্যু, প্রত্যাবর্তন, ৭ মার্চ এবং প্রধানমন্ত্রীসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্ম-মৃত্যুসহ আওয়ামী লীগের পালন করা অন্যান্য দিনগুলোতে অতীতের চেয়ে অনেক বেশি স্পেস বরাদ্দ করতে হচ্ছে, ওভার প্লে করতে হচ্ছে। তা না হলে খুনের মামলাটি নড়াচড়া দিয়ে উঠছিল।


এবারের ঘটনাটি মূলত আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকাটিকে অধিকতর কব্জায় নেওয়ার ফন্দি বলেই আমি মনে করি। যে গ্রাফিকস কার্ডের ইস্যুতে প্রথম আলোকে বেশ চাপে ফেলার অপচেষ্টা চলছে, সাভারের সাংবাদিককে রাত গভীরে তুলে নেওয়া হয়েছে, তার চেয়েও কঠোর ভাষার কন্টেন্ট এবারের স্বাধীনতা দিবসে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখেছি। কিন্তু প্রথম আলোকে ধরতে হবে- কারণ সামনের দিনগুলোতে বিরোধী দলের সর্বাত্মক আন্দোলন ও আগামী নির্বাচন ঘিরে দেশে যেটুকু সাংবাদিকতা অবশিষ্ট আছে তা স্তব্ধ করার এখনই সময়। এবারের মিশনে প্রথম আলোকে যেমন আরও বশীভূত করা যাবে তেমনি অন্য সংবাদমাধ্যম যারা মাঝে মধ্যে সত্যনিষ্ঠ হতে সচেষ্ট হয়, তাদেরও কঠোর বার্তাটি দিয়ে দেওয়া গেলো।

একটা উদাহরণ দেই। আজ ১ এপ্রিল প্রথম আলোর সেকেণ্ড লীড মেট্রোরেলের সব ক’টি স্টেশন চালু”। উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অবশিষ্ট শেওড়াপাড়া ও উত্তরা সাউথ স্টেশন গতকাল চালু হয়। গতকালই প্রথমবারের মত মেট্রোরেলে চড়েছিলাম। আগারগাঁও থেকে উত্তরা নর্থ স্টেশনে আসতে পুরো ট্রেনটি ছিল ফাঁকা। ধারণ ক্ষমতার দশ শতাংশ যাত্রীও ছিল না। আর গতকাল চালু হওয়া শেওড়াপাড়া স্টেশন থেকে দু’তিনজন যাত্রী বাচ্চাদের নিয়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে উঠতে দেখা গেলেও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনে কোন যাত্রী উঠানামা করেন নি। এমনকি নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া ওই স্টেশনে কোন প্রাণীর উপস্থিতি দেখা যায়নি। কারণ স্টেশনটি জনমানবহীন নির্জন এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে। এমন দু’টি গুরুত্বহীন স্টেশন চালু হওয়ার খবর সেকেন্ড লীড করে প্রথম আলোকে দেখাতে হয়েছে তারা উন্নয়নের সহযাত্রী। প্রথম সারির অন্য কোন পত্রিকা আজ সংবাদটি প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান দেয়নি। যুগান্তর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলামে প্রকাশ করেছে। এভাবে গত এক বছরে বহু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব।

মোট কথা প্রথম আলো ও সরকারের মধ্যে চলমান টাগ অব ওয়ার মুলত পারষ্পরিক বোঝাপড়াটা আরও নিবিড় করার। বিশ্বাস করি, চলমান ইস্যুতে সরকার আর খুব বেশি এগুবে না। কারণ, তাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমলে নিচ্ছে না বলে যতই বাগাড়ম্বর করুক না কেন মধ্যরাতের আটক ও ডিজিটাল মামলাবাজি যে বুমেরাং হয়েছে তা ইতোমধ্যে কুশীলবরা বুঝে যাওয়ার কথা। প্রত্যাশা করি, আগামী দু’একদিনের মধ্যে সম্পাদক মতিউর রহমান উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করবেন। জেলবন্দী শামসুজ্জমান মুক্তি পেতে হয়তো ইস্যুটি চাপা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মাঝে মাঝে ডিজিটাল মামলার অগ্রগতি ঘটবে ফায়দা তুলতে।

পরিশেষে বলে রাখি, উপরের বিশ্লেষণ ও মতামত একান্তই আমার ব্যক্তিগত। কোন সাংগঠনিক পদের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। দাবি জানাই প্রথম আলোর প্রবীণ সম্পাদক মতিউর রহমান, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ, নয়াদিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, যায়যায় দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমানসহ সকল সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের। বন্দী সাংবাদিক শামসুজ্জমান ও সিনিয়র ফটো সাংবাদিক আজিজ ফারুকীর অবিলম্বে মুক্তি চাই।
প্রথম আলোতে কর্মরত আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী আছেন, তাদের কেউ এ পোস্টের সঙ্গে দ্বিমত করে কষ্ট পেলে আগাম দুঃখ প্রকাশ করে রাখছি।