আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন আইনের শক্তিশালী প্রয়োগ

আপডেট: মে ৩১, ২০২৩
0


এমরানা আহমেদ

আজ বুধবার ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ বছর ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলাদেশ দিবসটি পালন করবে। বিকল্প খাদ্য ফসল উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই ও পুষ্টিকর ফসল চাষে তামাক চাষিদের উৎসাহিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘গ্রো ফুড, নট টোব্যাকো’। একইসাথে তামাক উৎপাদনে কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচনও এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। পৃথিবীর ১২৫টিরও বেশি দেশে প্রায় ৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়অ এবং শীর্ষ তামাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ভুক্ত, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
বাংলাদেশ বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম তামাক ব্যবহারকারী দেশ। দেশের ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি, ২০১৯ এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
লালমনিরহাটে তামাক চাষের কারণে প্রতি হেক্টর জমি থেকে ধানের ফলন প্রায় ৩০ মণ কম পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
লালমনির হাট প্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটে তামাক চাষের কারণে প্রতি হেক্টর জমি থেকে ধানের ফলন প্রায় ৩০ মণ কম পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। চাষিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর লালমনিরহাটে ১৮-১৯ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়। যদিও কৃষি বিভাগের দাবি, তামাক চাষের জমির পরিমাণ ৮-৯ হাজার হেক্টর।
আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর গ্রামের রায়হান উদ্দিন (৫০) জানান, তামাক চাষের জমি থেকে বিঘা প্রতি ৫-৬ মণ ধান কম পেয়েছেন। তিনি ৮ বিঘা জমিতে আমন ধান লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে তামাক চাষের জন্য ব্যবহৃত ৫ বিঘা জমি থেকে তিনি ৪৬ মণ ধান পেয়েছেন। বাকি ৩ বিঘা জমি থেকে পেয়েছেন ৪৪ মণ ধান। কৃষক রায়হান উদ্দিন দু:খ প্রকাশ করে আরো বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে প্রতি বছর ৫ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করি। এসব জমিতে অন্য ফসল উৎপন্ন হয় তবে ফসলের উৎপাদন তুলনামূলক কম। তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণে সার প্রয়োজন হয়। এ কারণে মাটি কিছুটা পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে এবং তা অন্য ফসল উৎপাদনে ক্ষতির কারণ হয়।’
একই এলাকার ইমন শেখ (৩৫) ১৫ বছর ধরে ৮ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন। তিনি জানান, ‘তামাক চাষের জমিতে ধানের উৎপাদন বিঘা প্রতি ৫-৬ মণ কম হয়। তামাক চাষ করা হয় না, এমন জমি থেকে বিঘা প্রতি ১৪-১৬ মণ আমন ধান উৎপাদিত হয়। আমার তামাক চাষের জমি থেকে ধান উৎপাদিত হয় ৮-১০ মণ। কৃষকরা তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানান, তামাক গাছের শিকড়গুলো মাটির গভীরে চলে যায়। এ কারণে তামাক গাছ প্রচুর পরিমাণে মাটির পুষ্টিগুণ শোষণ করে নেয়। তামাক উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে সারের ব্যবহার করতে হয়। এ কারণে তামাক চাষের জমিতে ধানসহ অন্য ফসলের উৎপাদন তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। মুঠো ফোনে তারপরেও কেন তামাক চাষ করেন জানাতে চাইলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রত্যেকেই জানান, ‘তারপরও আমরা তামাক চাষ করি, কারণ তামাক কোম্পানিগুলো নির্ধারিত মূল্যে তামাক কেনে, আর একসঙ্গে টাকা পরিশোধ করে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, ‘একই জমিতে বারবার তামাক চাষের কারণে মাটির পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে এসব জমিতে ধানসহ অন্য ফসলের উৎপাদন আশানুরূপ পাওয়া যায় না। কৃষকরা সাময়িক লাভের আশায় তামাক চাষ করে মাটির পুষ্টিগুণকে নষ্ট করছে।’ তামাক চাষের জমিতে ধানের উৎপাদন ৫-৬ মণ কম হয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করছি। তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে তাদের সচেতন করছেন বলেও জানান, হামিদুর রহমান।
সর্বশেষ কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ- ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণ ৯৯,৬০০.২৪ একর। তামাকের পরিবর্তে এই পরিমাণ জমিতে বোরো ধান আবাদ করলে ১,৬৭,৪২৮ মেট্রিক টন বোরো এবং গম বা আলু করলে ১,৩২,৯৬৬ মেট্রিক টন গম বা ৮,৫০,৩৮৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন করা সম্ভব হতো। উল্লেখ্য, ২০২১ রবি মৌসুমে বোরো, গম এবং আলুর একর প্রতি গড় উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১,৬৮১ কেজি, ১,৩৩৫ কেজি এবং ৮,৫৩৮ কেজি।
জলবায়ূ পরিবর্তন, যুদ্ধ এবং নানাবিধ বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে বাংলাদেশের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমশ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এরকম পরিস্থিতিতে তামাকের মত একটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী ফসল উৎপাদনের বিপরীতে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য হারানোর ক্ষতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন সূত্রে জানা যায়, তামাক চাষের ক্ষতি আড়াল করতে কোম্পানিগুলো তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচিকে (সিএসআর) প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, “তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধসহ একটি খসড়া সংশোধনী কেবিনেটের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খসড়াটি যত দ্রুত চূড়ান্ত হবে, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ ততই ত্বরান্বিত হবে।”
###