`আর কতদিন নারী আর কন্যাশিশু অপেক্ষা করলে তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে’

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২
0

আর কতদিন নারী আর কন্যাশিশু অপেক্ষা করলে তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে –এমন প্রশ্ন তুলেছেন দেশের নারী নেত্রীরা । বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে জাতিসংঘ সিডও কমিটির সমাপনী মন্তব্য (২০১৬) ঃ বাস্তবায়ন পর্যালোচনা’’ বিষয়ক অনুষ্ঠিত কনসালটেশন সভায় নারী নেত্রীরা এমন মন্তব্য করেন।

আজ ৩ সেপ্টেম্বর বিকালে আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে (বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ১০/বি/১,সেগুনবাগিচা) আন্তর্জাতিক সিডও দিবস পালন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘‘জাতিসংঘ সিডও কমিটির সমাপনী মন্তব্য (২০১৬) ঃ বাস্তবায়ন পর্যালোচনা’’ বিষয়ক এ কনসালটেশন সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ গীতাঞ্জলি সিং।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইউএন সিডও কমিটির প্রাক্তন সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম, দৈনিক সমকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, ব একশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন এন্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক হোমায়রা আজিজ, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা। সভার শুরুতে সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খানের মৃত্যুতে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আজ আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। সিডও সনদ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সম্পূরক হিসেবে স্বীকৃত হলেও এই সনদ বাস্তবায়নে এখনো চ্যালেঞ্জ আছে। সরকার কর্তৃক নারী বানধব নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সিডও সনদের ২নং ধারা অনুমোদনের কোন পদক্ষেপ নেই। সিডও কে এখনো নারীর জন্য কল্যাণমূলক এ্যাপ্রোচ হিসেবেই দেখা হচ্ছে অধিকার হিসেবে নয়। ৫০ বছরে নারীর প্রতি বৈষম্যের মূল কারণ চিহ্নিত করতে পারা একটা অর্জন তিনি এসময় নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা এজেন্সি কে অধিকার হিসেবে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান।

স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারীর মানবাধিকার দলিল হিসেবে সিডও সনদ ১৯৭৯ সালে গ্রহণ করে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সরকার ৪টি ধারারউপর সংরক্ষণ রেখে সিডও সনদ স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে নারী আন্দোলনের ফলে সরকার ২টি ধারার উপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে। সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সত্বেও সিডও প্রতিবেদনে সংরক্ষণ প্রত্যাহারে সরকারের কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। তিনি সনদের সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণ অনুমোদনের জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর জোর দেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউএন সিডও কমিটির প্রাক্তন সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, সিডও সনদের সাথে রাষ্ট্রের সমঝোতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সিডও এর মূলদুটি ধারা ধারা ২ এবং ১৬,১(গ) এর উপর এখনো সংরক্ষণ বহাল রেখেছে। তিনি বলেন সিডও সনদকে আইন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বিগত ৩৭ বছরে সরকারের বিভিন্ন দল দেশ পরিচালনা করছে কিন্তু সিডও সনদ বাস্তবায়নে সংরক্ষণ অব্যাহত রেখেছে, যা নারী পুরুষের সমতা, নারী ক্ষমতায়নের পরিপন্থী । অথচ বিশ্বের আফগানিস্তান, কুয়েত, মালদ্বীপ, মৌরিতানিয়া সহ কয়েকটি দেশ সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করে অগ্রযাত্রার পথ সুগম করতে হলে সিডও সনদ বাস্তবায়ন আজ জরুরী। ।

ইউএনউইমেনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলি সিং বলেন, বিশ্বজুড়ে জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হচেছ। এর ফলে নারীর অগ্রগতি তরান্বিত হচ্ছে। কিন্তু গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুসারে এখনো সমতা প্রতিষ্ঠায় নানা বৈষম্য আছে। সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণবৃদ্ধি, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, বৈষম্যমুক্ত পলিসি, জেন্ডার ডিসএগ্রিডেটেড ডাটা তুলে ধরার বিষয়ে জোর দিতে হবে। এবিষয়গুলো বাস্তবায়নে সিডও কমিটিবারংবার গুরুত্বারোপ করছে , আমাদেরর এবিষয়ে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করে ন্যায্যতা, সমতা প্রতিষ্ঠায় সিডও দলিল হলো একটা ইনস্ট্রুমেন্ট। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে। আইন বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতিবিদদের, সরকারি প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করতে হবে, শিক্ষক, পুলিশ প্রশাসনকে জেন্ডার সেনসিটিভ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে মেধা ও পেশীশক্তি নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।

একশন এইডের কান্ট্রিডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, নারীকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংখ্যা বৃদ্ধি করলে হবে না, গুনগত দিকের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এমন এক সময় সিডও রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে যখন বিশ্বজুড়ে পিতৃতান্ত্রিকতা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য চরমে। সিডও প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে ইউএন সংস্থা গুলোকে কাজ করতে হবে।

কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন এন্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক হোমায়রা আজিজ বলেন, কতদিন নারী আর কন্যাশিশু অপেক্ষা করলে তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। পারিবারিক ক্ষেত্রে কাজের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান চিরাচরিত বৈষম্য আছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ্এর প্রভাব পড়ছে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে দায়িত্বপালন করতে হলে সিডও সনদ বাস্তবায়ন জরুরী।

আন্তর্জাতিক সম্পাদক দেবাহুতি চক্রবর্তী বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নারী বান্ধব নানা আইন থাকলেও এর প্রায়োগিক দিক দূর্বল। ৫০ বছরে এসে নানা অজুহাত দেখিয়ে এই সনদ অনুমোদন না করে । বাংলাদেশ সরকার নবম রিপোর্টে সিডও বাস্তবায়নের ইতিবাচক দিক তুলে ধরবেন এমন প্রত্যাশা করেন

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জমাকৃত সিডও অবজারভেশন রিপোর্টে মানবাধিকারদিকটি উপেক্ষিত হয়েছে। আদিবাসীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে আদিবাসী, প্রতিবন্ধী,দরিদ্র্য নারীসহ সকলের অধিকার নিয়ে কাজ করতে হবে।

দৈনিক সমকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, অনেক উন্নয়ন হচ্ছে কিন্ত ভাব আদর্শ গত দিকে পশ্চাতপদতা আছে। এখানে সচেতনতার লক্ষ্যে শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ নিতে হবে। নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ সক্রিয় শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

সভায় মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, দলিত সম্প্রদায়ের নারী, বিএনএসকে, বিদেশ ফেরত নারী অভিবাসী কর্মী, স্টেপস এর প্রতিনিধিবৃন্দ।

উক্ত কনসালটেশন সভায় ব্লাষ্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন, এডাব, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতি, ওয়াইডব্লিউ সিএ, বিএনএস এল, তরঙ্গ,নাগরিক উদ্যোগ, আইসিসিএডি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ সহ ১০০ জন উপস্থিত ছিলেন ।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম