আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা মুমিনের বৈশিষ্ট্য

আপডেট: মার্চ ১১, ২০২২
0

আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা মানে আল্লাহকে নিজের অভিভাবক নিযুক্ত করা এবং তাঁর ওপর পূর্ণভাবে ভরসা করা। অভিভাবক তাকেই বলে যিনি তার অধীনস্থ লোকের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন এবং অকল্যাণ হতে বাঁচিয়ে রাখেন। হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকার নাম আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) নয়, বরং আল্লাহর দেয়া সুযোগ সুবিধা ও উপায় উপকরণগুলো কাজে লাগিয়ে ফলাফলের জন্য তাঁর ওপর নির্ভর করার নামই হচ্ছে তাওয়াক্কুল।

তাওয়াক্কুল দুই প্রকারের-

১. এমন বিষয়ে তাওয়াক্কুল করা- যে ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো ক্ষমতা নেই।

২. বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ও বস্তুর ওপর ভরসা করা।

বৈধ ভরসা হলো- একজন মানুষ অপরজনকে তার পক্ষ থেকে কোনো কাজ আদায় করার দায়িত্ব দেয়া। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ওই বিষয়ে সামর্থ্য রাখবে। এ ক্ষেত্রেও সে ব্যক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করবে না। বরং উক্ত বিষয় বাস্তবায়নের জন্য সে নিজে এবং ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করবে।

তাওয়াক্কুলের বাস্তবায়ন এবং বৈধ উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার সাথে সাথে হৃদয়কে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য এ উদাহরণটি উল্লেখযোগ্য-ি রাসূলুল্লাহ সা: হিজরতের সময় মদিনার দিকে যাওয়ার জন্য মক্কা রওনা হন। পরে ‘সওর’ নামক গুহায় আত্মগোপন করেন। হজরত আবু বকর রা: নবী করিম সা:-এর হিজরতের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা যখন ‘গারে সওরে’ ছিলাম তখন আমি ওপর দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম মুশরেকদের পা আমাদের মাথার ঠিক উপরে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি নিজের পায়ের দিকে তাকায় তা হলেই আমাদের দেখতে পাবে। তখন তিনি আমাকে বললেন, আমাদের দু’জন সম্পর্কে তোমার ধারণা কী হে আবু বকর! আল্লাহ আমাদের তৃতীয় জন; অর্থাৎ আমাদের সাহায্যকারী। (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)

ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন, ‘তাওয়াক্কুল হলো ঈমানের অর্ধেক। আর দ্বিতীয় অর্ধেক হলো, আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য শরিয়ত সমর্থিত বৈধ উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়।’ তাই জীবনে চলার পথে আমাদের যেমন বৈধ উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে হবে। তেমনি আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থাও রাখতে হবে। এই দুই জিনিসের সংমিশ্রণেই সফলতা অর্জন সম্ভব।

ওমর রা: বলেন, ‘বান্দা এবং তার রিজিকের মধ্যে একটি পর্দা রয়েছে। সে যদি অল্পে তুষ্ট হয় এবং তার আত্মা সন্তুষ্ট হয় তবে তার রিজিক তার কাছে সহজে আগমন করবে। আর যদি সীমা লঙ্ঘন করে এবং ওই পর্দাকে ফেড়ে ফেলে, তবে তার নির্দিষ্ট রিজিকের অতিরিক্ত কোনো কিছু তার কাছে পৌঁছাবে না।’
জনৈক বিদ্বান বলেন, ‘তুমি আল্লাহর ওপর ভরসা করো, রিজিক তোমার কাছে ক্লান্তি ও অতিরিক্ত কষ্ট ছাড়া সহজেই এসে যাবে।’

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর ওপর ভরসার সাথে আবশ্যক হলো, জীবিকার উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করা ও কাজ করা, আল্লাহর প্রতি ভরসা ভরসা করে বসে না থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আর মুমিনরা যেন আল্লাহর ওপরই ভরসা করে।’ (সূরা মায়েদা-১১)
এখানে ভরসা করার সাথে সাথে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলা হয়েছে। আর তা নির্দেশিত যাবতীয় বিষয়ের উপকরণকে শামিল করছে। সুতরাং নির্দেশিত উপকরণ অবলম্বন না করে বা কাজ না করে শুধু ভরসা করে বসে থাকা বিরাট ধরনের অপারগতা। যদিও এতে তাওয়াক্কুল পাওয়া যায়। সুতরাং কোনো বান্দার জন্য উচিত নয় যে, ভরসাকে অপারগতায় রূপান্তরিত করবে অথবা অপারগতাকে ভরসায় রূপান্তরিত করবে। বরং যেসব উপকরণ সে অবলম্বন করবে তার মধ্যে ভরসাও শামিল থাকবে।
এ অর্থে একটি হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! উটটিকে বাঁধার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করব? নাকি আল্লাহর ওপর ভরসা করে (না বেঁধেই) ছেড়ে দেবো? রাসূল সা: বললেন, ‘আগে তা বেঁধে দাও, তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো।’ (তিরমিজি)

আল্লাহর প্রতি ভরাসার বিষয়ে পবিত্র কুরআনে অনেক বার বলা হয়েছে, ‘যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষন্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা তাওবা : ৪০)। ‘আর আল্লাহর ওপর ভরসা করো যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।’ (সূরা মায়িদাহ : ২৩)। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক : ০৩)

আল্লাহ ঘোষণা করেন, যদি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করে থাকেন তবে কেউ তোমাদের ওপর বিজয়ী হতে পারবে না। আর যদি তিনি তোমাদের সহায়তা না করেন, তবে তিনি ছাড়া কে আছে যে তোমাদের সাহায্য করবেন? মুনিদের শুধু আল্লাহর ওপর নির্ভর করা উচিত। (ইমরান : ১৬০)। নিশ্চয়ই তাদের ওপর শয়তানের কোনো শক্তি নেই যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় প্রতিপালকের ওপর ভরসা করে। (নহল : ৯৯)।

ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনিই সর্বোত্তম কর্ম সম্পাদনকারী।’ ইবরাহীম আ:-কে যখন অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন তিনি এটি বলেছিলেন।
ওহুদ যুদ্ধের পর রাসূল সা:-কে লোকেরা যখন বলেছিল, ‘লোকেরা আপনার বিরুদ্ধে শক্তিশালী বাহিনী সমাবেশ করেছে। অতএব, তাদেরকে ভয় করুন।’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৭৩) তখন রাসূল সা: উক্ত কথা বলেছিলেন। (ইমাম বুখারি ও ইমাম নাসাঈ এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)

ভরসা শুধু আল্লাহর ওপরই করার কথা কুরআনের সূরা আনফাল : আয়াত ২, তালাক : ৩, তাওবা : ৫১, ১২৯, মুযাদালাহ : ১০, যুমার : ৩৭, ইবরাহিম : ১১-১৩, ইউসুফ : ৬৭, ইউনুস : ৮৪, মায়িদা : ১১ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। এ ছাড়া আল্লাহর ওপর আস্থা রাখার অনেক আয়াত রয়েছে।

সুতরাং ভরসা রাখতে হবে শুধু আল্লাহর ওপরই। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে প্রত্যেক কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি তাঁর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা-বিশ্বাস রেখে পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।


নয়াদিগন্ত