মানুষের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁস বেআইনি হলেও এটি বন্ধ হচ্ছে না। বৈধ যোগাযোগের গোপনীয়তা সংরক্ষণ সংবিধানবলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও অহরহ ফাঁস হচ্ছে ফোনালাপ। এতে ব্যক্তি ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কারোরই গোপনীয়তার অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না।
সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ফ্রি-স্টাইলে ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁসের এই বেআইনি কাজের প্রতিকার চেয়ে সরকারের পদক্ষেপ কী—সে বিষয়ে জানতে চেয়ে উকিল নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে এই নোটিশ দিয়েছেন।
নোটিশে বলা হয়েছে, গত আট বছরে অন্তত ১৬টি ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সর্বজনীন মানবাধিকার সনদপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর সব আধুনিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। এরই ধারাবাহিকতায় সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা সংরক্ষণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই অধিকার সংবিধান কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সংবিধানের তৃতীয়ভাগে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ অন্যতম।
এছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩০(চ) ধারা অনুযায়ী টেলিযোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষা নিশ্চিত করা বিটিআরসির দায়িত্ব। কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে, এই ধরনের ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁসের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অথচ সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিটিআরসি ব্যক্তির গোপনীয়তা সংরক্ষণ নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁস প্রতিরোধে বিটিআরসি কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা নোটিশপ্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। যদি এটা না জানানো হয় তাহলে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ও ভারত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে গণ্য করেছে। এই অধিকার লঙ্ঘনকে বেআইনি ও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়তা, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তার সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না।
গত কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা মানুষের টেলিফোন কথোপকথন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বা ফাঁস করা হচ্ছে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ব্যক্তির পাশাপাশি এ থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও রেহাই পাচ্ছেন না। তথ্যপ্রযুক্তির উত্কর্ষতার ফলে মোবাইল ফোনে কল রেকর্ডার অপশন রয়েছে। সেই অপশন ব্যবহার করে সহজেই ফোনালাপ রেকর্ড করা হচ্ছে। ফোনালাপ রেকর্ডের পাশাপাশি হীন স্বার্থে সম্পাদনা করেও প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ অন্যের সরলতার সুযোগ নিয়েও বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতারণামূলক এ কাজ করছেন। বেআইনি এই কাজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। যদিও আমাদের সংবিধানে ৪৩ অনুচ্ছেদের (খ)তে বলা হয়েছে, ‘চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই অধিকারকে সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট ৯ সদস্যের বিশেষ সাংবিধানিক বেঞ্চ তার রায়ে বলেছে, ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী জীবনের অধিকারের মতোই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখাও এক জন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। বিচারপতি মো. রহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ এ সংক্রান্ত বিষয়ে সম্প্রতি একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষায় বিটিআরসিসহ দেশের সরকারি-বেসরকারি সব মোবাইল ফোন অপারেটরের দায়িত্ব রয়েছে। সংবিধানেই নাগরিকের এই গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। চাইলেই কোনো স্বার্থে নাগরিকের সাংবিধানিক এই অধিকারকে লঙ্ঘন করা যায় না। রায়ে বলা হয়েছে, আমরা ইদানীং লক্ষ করছি যে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল অডিও-ভিডিও কথোপকথন সংগ্রহ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছে। ঐ কথোপকথনের অডিও-ভিডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস করার অভ্যাস বন্ধ হওয়া উচিত। আমরা এটা ভুলে যেতে পারি না যে সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তাই এটা রক্ষা করা ফোন কোম্পানি ও বিটিআরসির দায়িত্ব। এটা বন্ধে বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক চাহিদাপত্র ও গ্রাহককে অবহিতকরণ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি থেকে কললিস্ট বা কল রেকর্ড সংগ্রহ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন দ্বারা অনুমোদিত না হলে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও দেশের নাগরিক বা গ্রাহকের কললিস্ট-সম্পর্কিত কোনো তথ্য কাউকে সরবরাহ করতে পারে না। নইলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।
দেশের প্রচলিত আইনে একমাত্র তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সরকারের অনুমতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করার অধিকার রয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে—“এই আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারিবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করিতে বাধ্য থাকিবে? (২) এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘সরকার’ বলিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝাইবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হইবে?”
এ প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা বা গোয়েন্দা সংস্থার কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছা করলেই যে কোনো নাগরিকের টেলি কথোপকথন রেকর্ড করতে পারেন না। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিখিত আবেদন লাগবে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লিখিতভাবে অনুমোদন দিতে হবে এবং যা অনন্তকালের জন্য হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিষয়টিও আইনে রয়েছে। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ বিষয়ে তাদের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তি পর্যায়ে ফ্রি-স্টাইলে কথোপকথন রেকর্ড চলছে। কিছু কিছু গণমাধ্যম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বেআইনিভাবে এসব কথোপকথন প্রচার করছে। এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রতিকারমূলক কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান না থাকায় সংবিধান ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় এই বেআইনি কাজ চলছে বলেও অভিমত আইন বিশেষজ্ঞদের।