ডা জাকারিয়া চৌধুরী:
একদা একজন লোক ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে গেল। রাত তিনটা’র মত বাজে। রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। সে সময় ইন্ডিয়ান বানারসের শাড়ি বাংলাদেশে হট কেক। ঢাকা মেল কুমিল্লা ছেড়ে চট্টগ্রামের দিকে হেলেদুলে বের হয়ে গেল। আমি বেশ দূরে দেখলাম রেল লাইনের উপর একটা ব্যাগ। মাঝে মাঝে কি যেন চিকচিক করছে। বুঝতে বাকি রইল না ট্রেন থেকে কোনভাবে চোরাই শাড়ির ব্যাগ পড়ে গেছে। চিকচিক করছে ভারী পলিথিন। যে পায় তার বলেই আমি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কাছে চলে গেলাম। হিম ধরে গেল বুকে। রাতের বিজলি বাতির আলোয় তার রক্ত চিকচিক করে উঠেছিল। পেট থেকে নিচের অংশটা সম্ভবত ট্রেনের সাথে চলে গেছে। লোকটা চুপচাপ তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
সে হয় জানে না কি ঘটে গেল অথবা ভয়ে ভাবতে চাইছে না। নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম – দ্রুত নাম ঠিকানা বলুন। পানি খাব, ভাই একটু পানি দেন। আল আমিন হোটেলে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে দৌড় দিলেও হবে না। তখন বোতলজাত পানির দিন আসেনি। ভাই পানি খাব পানি, পানি, পানি…. শব্দের কম্পাংক কমে আসছে। উচ্চারনে জড়তা আসছে। বললাম দ্রুত নাম ঠিকানা বলুন প্লিজ ভাই। স্ত্রী কন্যা পিতা পুত্র কেউ না কেউ আপনার জন্য সারাটা জীবন অপেক্ষা করবে।
ভুল বুঝবে হয়ত… বিয়ে করে অন্য কোথাও থিতু হয়েছেন। মা বা থাকলে তারা আপনার এই দশা কখনোই কল্পনায় আনতেও পারবে না। গরীব মানুষ এরা। এরা কুকুরের জাত। এদেরকে মানুষ বললে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলবে এলিট সমাজ। মাথায় চিন্তার ঝড়….সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার হাতটা ঝাকিয়ে প্রচন্ত ধমক দিয়ে বললাম – আপনার নাম কি ? সে বিরবির করে বলল পানি… পানি…. পানি। তার হাতটা আমার হাত থেকে ধপ করে পড়ল। আমিও কি আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম ? সে ত মরে গেল মনে হচ্ছে !! হ্যাঁ, সে মরে গেছে।
পরদিন বিকেল নাগাদ সবাই জেনে গেল আমি একটা দানব, সীমার, পিশাচ, ডাইন এটা ওটা.. আমি কাউকে এটা বুঝানোর চেষ্টাও করলাম না হোয়াট একচ্যুয়ালি হেপেন্ড.. আমি তার পরিবারকে লাশটা অন্তত ঃ ফেরত দেয়ার চেষ্টা করেছি। কেউ ভেবেও দেখল না, এক দেড় মিনিটের মধ্যে তাকে পানি এনে দেয়া সম্ভব ছিল কিনা !! দিলেই বা কি হত !! এটাও ভেবে দেখল না। এরা নাকি সমাজের শিক্ষিত এলিট শ্রেনী !! লোকটাকে বেওয়ারিশ হিসেবে চালান করা হল। ( আই উইথনেস বুলু ) রেকর্ড জি আর পি, কমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন।
ঢাকা ডেন্টালে ভর্তি হয়েছি কয়েকদিন হল। সবাই সবার নাম ধরে ডাকে, সবাই সবাইকে চিনে ফেলেছে। কলেজে যাই কিন্তু ক্লাস শুরুর বালাই নাই। ক্লাসের সবাই যেদিকে যেদিন যায় আমিও যাই। আমি যে কারো নাম জানিনা এটা ভুলেও কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। সবার পেছনে পেছনে হাটি। সবাই হাসলে আমিও হাসি। কিন্তু সামনের সাড়ির বন্ধুরা ঠিক কি কারনে দল বেধে হেসে উঠেছে আমি বুঝিনি। তাদের আলাপের বিষয় কি, সেটাও জানিনা। সবাই শুনে আমি শুনিনা। আমার ধারনা হল, আমি কানে কম শুনি। একজন আরেকজনকে এটা দেখায়, ওটা দেখায় খিলখিল করে একযোগে সবাই হেসে উঠে। আমিও তাকিয়ে থাকি। এই শহরে কত রংগ দেখা যায় আমি কেন দেখিনা !!
আমার আইকিউ, মনে রাখার ক্ষমতা, যে কোন বিষয় বুঝে ফেলার দক্ষতা নেই আমার ধারনা বদ্ধমুল হলো। যাচ্ছি কই তাও জানিনা। কেউ বলেনি আমিও কাউকে জিগেস করিনি। মিরপুর – ১৩ এর ধারেকাছে একটা বৌদ্ধ বিহারে ঢুকার সময় বুঝলাম সাইনবোর্ড দেখে। ভিতরে সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। আমি জানিই না, এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের এমন কিছু আছে। এক জায়গায় গিয়ে একটু ধাক্কা খেলাম। কালো পাথরের একটা কিছু দেখে। নিচে লেখা শিবলিঙ্গ। শিব একজন দেবতা এটুকুই জানি। কাদের দেবতা জানিনা। একজনকে জিগেস করলাম শিবলিঙ্গ কি ? আমার অজ্ঞতায় সে অবাক হলো… ফিরে আসছি কলেজের দিকে।
কাছাকাছি আসতেই প্রচন্ড একটা এক্সিডেন্ট হল। একজন আহত। ভয়াবহ আহত। তার পায়ের গোড়ালি ছিড়ে বিপুল বেগে রক্তপাত হচ্ছে। এত বেশি বেগে রক্ত বের হচ্ছে যে মনে হল সে এখানেই মারা যাবে। আমাদের মেয়েরা চিৎকার চেচামেছি, কিচিমিচি শুরু করলো। চারদিকে লোক জমে গেল। সবাই দেখছে। আমি হেটে কাছে গেলাম। রিক্সাওয়ালার মাথায় পেচানো গামছাটা খুলে তার পায়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে পারা দিলাম। তারপর শক্ত করে বাধলাম। রাস্তার ওপাশে গিয়ে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দেয়ার পর মনে হল, লোকেরা সকলেই খুব বিরক্ত, এরা নিরাশ হয়েছে। সার্কাস হয়ত আরও কিছুক্ষন দেখতে চেয়েছিল। আমি এমন কি দোষ করলাম !! এপাড়ে ফিরে দেখি নবকুমার আমি রয়ে গেছি। জাহাজিরা সকলেই চলে গেছে।
ধীর পায়ে হেটে হেটে কলেজে ফিরলাম। মানুষকে আমার একদম ভালো লাগে না। এরা কি চায়? এরা কি চেয়েছিল গরীব রিক্সাওয়ালার মৃত্যু দেখতে!! এদের জীবনের তিলে তিলে আয় আর প্রতি বছরের বাড়তি ব্যায়ের সামষ্টিক অর্থই ত এলিট সমাজ। চাল তেল নুন চিনি ডালের সংকট আর সরবরাহের ফারাক থেকে অর্জিত অর্থ হল স্বাভাবিক লাভের পর অতিরিক্ত মুনাফা নামের ডাকাতি। ওই ডাকাতির টাকাটা ধনীদের বাৎসরিক প্রবৃত্তি। এর কিছুটা ব্যায় করলেই বছরে অন্ততঃ দুইবার বিদেশ ভ্রমন করা যায় পরিবার পরিজন নিয়ে। সারাবছর ওয়েস্টিনে খাওয়া যায়। এইতো !! দারোয়ানকে আপনি সম্বোধন করায় একবার আমাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। ৬৫+ বুয়াকে গোপনে মাসে ৫০০/- টাকা বাড়তি দিয়ে ধরা খেয়ে আবিস্কার করেছি, আমি তার যৌনসংগী। আমি ম্যানার্স জানি না। ছোটো লোকদের সাথে কখনোই কথা বলতে নেই। ভাবি, এই বুয়ার টাকাও আমাদের বিনোদনে যুক্ত হয়। একে ঠিক এভাবে বলে না। একে বলতে হবে থোক বরাদ্ধ, ইনক্রিমেন্ট, চিকিৎসা ভাতা, ভ্রমন ভাতা এটা ওটা সেটা… বি কেয়ারফুল, দ্বিতীয়বার এমনটা দেখলে লাথি মেরে ফেলে দেব কিন্তু !! আমি আর কখনো এমনটা করিনি। কলেজে ঢুকলাম। সবাই চোখ বড় বড় করে চোখের সামনে যেন উন্মুক্ত ডাইনোসর দেখছে। একদল মেয়ে আবারও কিচিরমিচির করে কলেজের পেছনে পালিয়ে গেল। বেড পার্টনার সুকান্ত এগিয়ে এসে বলল – তাড়াতাড়ি হলে ফিরে গিয়ে গোসল কর। কাপড় বদলাও। তাকিয়ে রইলাম। বুঝিনি কেন আমাকে চলে যেতে হবে। সে বুঝল যে আমি বুঝতে পারছি না। জানতে চাইলো, আমার সাদা শার্ট রক্তে ভেজা, দুই হাতের রক্ত শুকিয়ে চিটচিটে হয়ে গেছে সেটা আমি জানি কিনা !! আরে তাইতো !!!
আমি দেখিনি, অনুভব করতে পারিনি, এর আফটারম্যাথ কি হবে প্রেডিক্ট করতে পারিনি। পরদিন কলেজে গিয়ে অনুধাবন করলাম, আমি একজন ভয়ংকর লোক। মুখে কেউ কিছু উচ্চারন করছে না, কৌতুহল দমন করতে পারছে না, সবাই যেন সরে সরে থাকছে। আচ্ছা গতকালকের লোকগুলো কি এজন্যই বিরক্ত হয়েছিল ? তারা কি এটা চাইছিল যে, এটা একটা পুলিশ কেস। পুলিশ, ডাক্তার, মেজিস্ট্রেট না আসাতক রিক্সাওয়ালা কুকুরটা এভাবেই পরে থাকুক !! ঘটনা ঘটল দশটায়, বিকেল তিনটায় আইনি প্রক্রিয়া সেরে ডাক্তার দিয়ে টিভি ক্যামেরায় বলানো হোক ডেথ ফলোউড বাই আর টি এ ? তারপর সেও বেওয়ারিশ হয়ে ডোমের কাছে চলে যাবে। ডোম সে লাশ সিদ্ধ করে হাড়গোড় বের করে আমাদের কাছে বিক্রি করবে !!! আমাদের দেশটা শেষ হয়ে যাবার জন্য রাজনীতি খুব বেশি দায়ী কি ।!! এরা এ দেশের সভ্য মানুষ !!! কেবল রাজনীতিবিদদের সব দোষ ?
একজন মানুয় যদি ৪০ বছর রাজনীতি করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয় তবে ক্ষমতা শেষে মৃত্যু পর্যন্ত আদালতের বারান্দায় হাজিরা দিতে দিতে মরে। ক্ষমতার আগের পুরো জীবন সে ছিল আমলাদের পোষা কুকুর। ক্ষমতার পরেও আমলাতন্ত্রের ফাদে পা দেয়া একটা শিকারী কুকুর। যে যেদিকে দেখায় সেদিকেই তাকে যেতে হয়। দুনিয়ায় এমন কোন দেশ আছে, যেখানে আমলাদের কাজের ব্যাপারে মুখ খোলার পরিনতি ভয়াবহ হয় !!! এদেশের মানুষকে ইবনে বতুতা সেই ১২ শতকে কিছুটা বিদ্রুপ করে গেছেন।
আমরা হিংসা আর হানাহানি প্রিয় জাতি। ব্রিটিশরা খোলাখুলি বলে গেছেন – নন রেসিং স্ট্যাট। নন রেসিং স্টেট কি, আশা করি আলাদা করে বলতে হবে না। যদি বলি, তাহলে দুজনের কথার স্বীকৃতি আমিও দিলাম। দেশের বাইরে আমাদের ছেলেমেয়েরা যাবার সুযোগ পেলেই একদল পালিয়ে যায় তো আরেকদল হোটেলের জিনিসপত্র চুরি করে ধরা খায়। এদেশের ফুটবলারদের একবার ধারাবাহিকভাবে ৮০ মন মধু খাওয়ানো হয়েছিল। এদের উন্নতি হয়নি।
না খেলায় না চিন্তা চেতনায়। কোচ তার নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার আগে দুঃখ করে বলে ছিলেন – এদেশে কোনো মেধাবী লোক জন্মে না। আচ্ছা উপরের দুইটা গল্প ত বাস্তব। নাকি !! কিন্ত আমাকে এমন ভোগান্তি পোহাতে হল কেন ? ভুলটা ঠিক কোথায় ? এক গাল্ফুলা বদমাস ইংরেজি আইনকে অনুবাদ করে দেশের ঈশ্বর হয়ে আজও বসে আছে। সে দেশটাকে ধ্বংস করতে কি কি করেছে তা কেউ আজ পর্যন্ত বলেনি। এতদিন ত আমার ভোগান্তি হয়েছে, দ্বিতীয় পর্ব লেখার পর ফাসি হয়ে যাক। আই মিন ইট। কিচ্ছু মনে করব না। চোর, চামার, ভন্ড, বাটপারদের স্যার বলতে হবে। পলিটিক্স করলে আগে থেকেই মেনে নিতে হবে এটা অজাত কুজাতের কাজ।
যারা সর্ব বিষয়ে ব্যার্থ তারাই পলিটিশিয়ান। এটাই অলিখিত কারিকুলাম। এর বাইরে গেলেই ক্রস ফায়ার খা হারামজাদা। দোষ যাবে অন্যদলের পলিটিশিয়ানদের উপরে। একটা প্রশ্ন ইদানিং মাথায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বলতে সাহস হয় না।
আমার চেম্বারে যারা ভয়ংকর আক্রমন করেছিল তারা কি সরকারের আদেশে করেছিল নাকি আমলাদের বা নির্দিষ্ট কোনো আমলার ইশারায় ? আমারকে অবশ্যই সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। রাজনীর জন্য যেমন ফ্রেমওয়ার্ক তৈরী করতে হবে তেমনি আমলাদের ব্যাপারেও কাউন্টার আমলার পথ খুলতে হবে হবে। এদেশে কয়জন জানে, আমলাদের সিকিউর্ড সচিবালয়ে কি পরিমান মধুর বিকিকিনি চলে !! কুঞ্জবন কি শুধুই মথুরায় ? সেটা এখন চলে এসেছে ঢাকায়। তাই আমাদের এখন পড়া উচিত—–ইয়া কানা’বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন”
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি,
এবং তোমার নিকটই সাহায্য পার্থনা করি।
______সুরা ফাতিহা, আয়াত ৫
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক দেশ জনতা ডটকম