ঈদুল আজহা পর্যন্ত পবিত্র জিলহজ্জ মাসের ১০টি দিন বড় বারাকাহপূর্ণ

আপডেট: জুলাই ১২, ২০২১
0

হিজরি সালের সর্বশেষ মাস জিলহজ। মহান আল্লাহ এই মাসকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহর ঘরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মুসলিমরা এসে জড়ো হন। এই মাসের প্রথম ১০ দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। প্রথম ১০ দিন হাদিসে বর্ণিত বিশেষ আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ হয়।

১. আল্লাহ কর্তৃক সম্মানিত মাস : মহান আল্লাহ চার মাসকে হারাম তথা সম্মানিত মাস হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এর অন্যতম হলো জিলহজ মাস। মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে আকাশমণ্ডলী ও ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় বারো মাস, এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এই সময়ে তোমরা নিজেদের ওপর জুলুম কোরো না। (সুরা : তাওবাহ, আয়াত : ৩৬)

আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যেদিন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে সময় অতিবাহিত হচ্ছে। এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিন মাস ধারাবাহিক রয়েছে। তা হলো – জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম। আর একটি মাস হলো রজব, যা জুমাদা (আল উখরা) ও শাবান মাসের মধ্যে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৩১৯৭)

২. প্রথম দশ রাতের শপথ : মহান আল্লাহ জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের শপথ করে এই সময়ের মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা জানিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, শপথ ভোরবেলার, শপথ দশ রাতের। (সুরা : ফজর, আয়াত : ১-২)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) ও মুজাহিদ (রহ.)-সহ অনেক সাহাবি, তাবেয়ি ও মুফাসসিরের মতে এখানে ১০ রাত বলতে জিলহজ মাসের প্রথম ১০ রাত বোঝানো হয়েছে। তা ছাড়া আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এটিকে বিশুদ্ধ মত বলে বর্ণনা করেছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৫৩৫-৫৩৬)

৩. সবচেয়ে উত্তম সময় : হাদিসে জিলহজের প্রথম ১০ দিনতে সবচেয়ে উত্তম সময় বর্ণিত হয়েছে। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘মহান আল্লারহ কাছে জিলহজের ১০ দিনের চেয়ে উত্তম কোনো দিন নেই।’ (সহিহ ইবনে হিববান, হাদিস নং: ২৮৪২)

৪. আল্লাহর কাছে প্রিয় সময় : জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লহর কাছে অন্যান্য দিনের তুলনায় জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমল সবচেয়ে উত্তম। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? রাসুল (সা.) বলেছেন, জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ ও সম্পদের ঝুঁকি নিয়েও জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না তার কথা ভিন্ন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৯৬৯; আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৪৩৮)

৫. হজের মাস : ওমরাহ বছরের যেকোনো সময় পালন করা যায়। তবে জিলহজ মাস হজ পালনের একমাত্র সময়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হজ নির্ধারিত মাসগুলোতে (অনুষ্ঠিত হবে)। অতঃপর কেউ এ মাসগুলোতে হজের ইচ্ছা করলে সে যেন হজের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ করবে না’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭)

আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেছেন, হজের নির্ধারিত মাসগুলো হলো- শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। আল্লাহ এই মাসগুলো হজ পালনের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আর ওমরাহ সারা বছর আদায় করা যায়। উল্লিখিত মাসগুলো ছাড়া অন্য সময় হজের ইহরাম পরলে হজ হবে না।

বিভিন্ন হাদিসে জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমলের কথা এসেছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো –

এক. সিয়াম পালন : জিলহজ মাসে রোজার অনেক মর্যাদা রয়েছে। হাফসা (রা.) বর্ণনা করেছেন, চারটি আমল নবী করিম (সা.) কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, প্রতি মাসের তিন দিনের রোজা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস নং : ২৪১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ২৬৩৩৯)

দুই. চুল ও নখ না কাটায় কুরবানির সওয়াব : হাদিসে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানি দেওয়া পর্যন্ত চুল ও নখ না কাটার বড় সওয়াব এসেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ কুরবানির ইচ্ছা করলে জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন শুরুর পর সে যেন নিজের চুল ও চামড়ার কোনো কিছু স্পর্শ না করে (না কাটে)।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ১৯৭৭; আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৭৯১; তিরমিজি, হাদিস নং : ১৫২৩)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘সে যেন কেশ না ধরে ও নখ না কাটে।’ আরেক বর্ণনায় আছে, ‘যে ব্যক্তি কুরবানি দেবে সে যেন জিলহজ মাসের নতুন চাঁদ দেখার পর নিজের চুল ও নখ না কাটে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ১৯৭৭; নাসায়ি, হাদিস নং: ৪৩৬৪)

কুরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই এমন ব্যক্তি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ আমল করেন তিনিও কুরবানি দেওয়ার পূর্ণ সওয়াব পাবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কুরবানির দিনকে এই উম্মাহর জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি যদি দুগ্ধবতী ছাগল ছাড়া অন্য কোনো পশু না পাই তবে কি তা দিয়েই কুরবানি করব? তিনি বললেন, ‘না, তবে তুমি এই দিন তোমার চুল ও নখ কাটবে। তোমার গোঁফ কাটবে। নাভির নিচের পশম কাটবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পরিপূর্ণ কোরবানি’। (আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৭৮৯; নাসায়ি, হাদিস নং : ৪৩৬৫)

তিন. জিকির করা : এই দিনগুলোতে তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) পড়া সুন্নত। এসব দিনে জিকিরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে এই ১০ দিনের আমলের চেয়ে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এই সময় তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পাঠ করো।’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস নং : ৩৪৭৪)

পাঁচ. ৯ তারিখ বা আরাফার দিন রোজা রাখা : জিলহজের প্রথম ৯ দিনের মধ্যে নবম দিনের রোজা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। বিভিন্ন হাদিসে এই দিনের রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার দিনের (৯ তারিখের) রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মাফ করবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ১১৬২; আবু দাউদ, হাদিস নং: ২৪২৫)

ছয়. তাকবির পাঠ : জিলহজ মাসে তাকবির পাঠ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর মাধ্যমে আল্লাহর বরত্বের কথা তুলে ধরা হয়। তাকবির পাঠ দুই ধরনের হতে পারে।

সাধারণভাবে তাকবির পাঠ : জিলহজ মাসের প্রথম দিন থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত তাকবির পাঠ করা একটি সাধারণ আমল। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা গণনাকৃত (নির্দিষ্ট) দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২০৩)

ইবনে আববাস (রা.) বলেছেন, এখনে ‘নির্দিষ্ট দিন’ বলতে (জিলহজ মাসের) প্রথম ১০ দিন উদ্দেশ্য করা হয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) ও আবু হুরাইরা (রা.) এই ১০ দিন তাকবির বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন এবং তাদের তাকবিরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবির বলত। মুহাম্মাদ বিন আলি (রহ.) নফল নামাজের পরও তাকবির বলতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৯৬৯)

নির্দিষ্ট দিনে তাকবির পাঠ : জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখ আসরে নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের শেষে তাকবির বলবে। যাকে তাকবিরে তাশরিক বলা হয়। (ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড : ২৪, পৃষ্ঠা : ২২০)

তাকবিরের বাক্য নিম্নরূপ : ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। আল্লাহ বড় আল্লাহ বড়, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ বড় আল্লাহ বড়। সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য। (দারু কুতনি, হাদিস নং : ১৭৫৬; ইরওয়াউল গালিল, হাদিস নং : ৬৫৪)

সাত. কোরবানি করা : জিলহজ মাসের প্রথম দশকের বিশেষ আমল হলো কোরবানি করা। যতটুকু সম্পদ থাকলে জাকাত ওয়াজিব হয় ততটুকু সম্পদের জন্য কুরবানি ওয়াজিব হবে। জিলহজ মাসের দশম দিন থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত কুরবানি করা যাবে। এই সময় হাজিরা মিনা ও আশপাশের প্রাঙ্গণে কোরবানি করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার রবের জন্য নামাজ আদায় করো এবং কোরবানি করো।’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ২)।

রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৬৪৯০; ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ৩১২৩)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ওই দিনগুলোতে বেশি বেশি আমল করার তাওফিক দান করুন।