উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অর্থের অপচয় ও জনদূর্ভোগ কমাতে হবেঃ বি.আই.পি.

আপডেট: মার্চ ১৮, ২০২১
0
file photo

নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে পরিবেশ- প্রতিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, জলাশয়কেন্দ্রিক গণপরিসর তৈরি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে খাল-জলাশয় পুনরুদ্ধার ও দূষণ রোধ, মশক নিধনে পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তোলা, এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ তৈরি ও সকলের প্রবেশ নিশ্চিতকরণ, ওয়ার্ড কাউন্সিল শক্তিশালী করণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি নিয়ে নির্মোহ তদন্তের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে টেকসই ও পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা সম্ভব।

অদ্য ১৮ মার্চ ২০২১ (বৃহস্পতিবার), সকাল ১১ টায় ঢাকাস্থ প্ল্যানার্স টাওয়ারে দেশের নগর, অঞ্চল ও গ্রামীণ পরিকল্পনাবিদের জাতীয় পেশাজীবি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.) এর উদ্যোগে আয়োজিত “সমসাময়িক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উপরোক্ত মতামত দেয়া হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ এর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বি.আই.পি.-র সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান তাঁর উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সমসাময়িক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট বিষয় তুলে ধরেন। ঢাকা শহরের খালগুলোর দায়িত্ব হস্তান্তর কে তাৎপর্য্যপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাল ও বক্স কালভার্ট গুলো থেকে বর্জ্য অপসারণ একটি প্রসংশনীয় উদ্যোগ। এছাড়াও খালকে দখলমুক্ত করতে এবং পুনরুদ্ধার অভিযানে পরিপূর্ণ সফলতা পেতে প্রয়োজন খাল দখল ও দূষণের সাথে জড়িত সকলকে চিহ্নিত করা। এ লক্ষ্যে বি.আই.পি. মনে করে, সিটি কর্পোরেশনকে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা ও অনমনীয় দৃড়তার মাধ্যমে খালসমূহকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। এছাড়াও ঢাকাকে জলজটমুক্ত রাখতে আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধি কিংবা খালের কার্যকারিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলাশয়, জলাভূমি, প্লাবনভূমি, বন্যাপ্রবাহ এলাকা সংরক্ষণ করা, পুকুরসমূহকে জলাধার হিসেবে চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা, প্রকল্প প্রণয়নের সময় খাল ও জলাধার ভরাট করে কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করে প্রকৃতি ভিত্তিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়ণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।

বি.আই.পি.-র সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল বলেন, খাল-জলাশয় দূষণ পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খালকে দূষণমুক্ত রাখতে খালের সাথে সংযুক্ত বসতবাড়ির পয়ঃবর্জ্যের এবং শিল্প কারখানার বর্জ্যের সংযোগ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও ঢাকার খাল ও জলাশয়কে সুনির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের মধ্যে আনতে যেসব খাল সিটি কর্পোরেশনের আওতার বাইরে রয়েছে সেগুলোকে সিটি কর্পোরেশনের হাতে ন্যস্ত করতে হবে । জলাশয়কে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে খাল ও জলাশয় কেন্দ্রিক নগর পরিকল্পনার ধারণাকে সন্নিবেশিত করে মহাপরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে, যেখানে জলাশয়কেন্দ্রিক গণপরিসর, হাঁটার স্থান, সবুজায়নের মাধ্যমে জনগনের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে খালগুলোকে দখল ও দূষণ প্রতিরোধ সম্ভব হবে বলে বি.আই.পি. মনে করে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের পক্ষে ড. আদিল বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেতে “সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা” পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে যার প্রথম ধাপ হচ্ছে শহরকে পরিকল্পনা মাফিক গড়ে তোলার মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও মশা নিধনে জলাশয়, নালা ও পুকুরে ব্যাঙ ছাড়ার উদ্যোগ সফল করতে হলে জলাশয়কে দূষন মুক্ত করতে হবে।

সম্প্রতি ঢাকার মশক নিধন কর্মসূচীতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে বি.আই.পি. দীর্ঘদিন যাবত নাগরিক সেবা কার্যক্রম বাড়ানো ও বাসযোগ্য নগর গড়তে শক্তিশালী ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সাথে জনসাধারণ ও কমিউনিটির সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জোর দাবী চালিয়া আসছে। কিন্তু বর্তমানে কাউন্সিলর অফিসগুলো তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। বর্তমান বাস্তবতায় ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নাগরিকদের সমন্বয়ে নাগরিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে কার্যকর, শক্তিশালী ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করবার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

বি.আই.পি.-র পক্ষ থেকে ড. আদিল বলেন, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ঢাকা শহরে খেলার মাঠের স্বল্পতা আছে এটা স্বীকার করে প্রতিটি ওয়ার্ডে জমি অধিগ্রহণ করে খেলার মাঠ তৈরী করবার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে যে আশ্বাস দিয়েছেন তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

কিন্তু পাশাপাশি এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ঢাকা শহরের বিদ্যমান অধিকাংশ সরকারী খেলার মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবার নামে কতিপয় ক্লাব কিংবা প্রভাবশালী মহল দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আছে। এ বিষয়ে জনগণের দাবি, আন্দোলন কিংবা হাইকোর্টের রায় – এসব কিছুর পরও খেলার মাঠগুলোতে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে আছে। বিআইপি মনে করে, জনসাধারণের মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ করবার নামে দখল কিংবা ইজারা নেয়া- পুরোপুরি অবৈধ এবং শিশু-কিশোরদের প্রবেশে বাধা দেয়া আইনের লংঘন। জমি অধিগ্রহণ করে খেলার মাঠ তৈরী করতে সময় প্রয়োজন হবে, কিন্তু এই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে মানুষের মাঠ জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া সিটি কর্পোরশনের আশু দায়িত্ব হওয়া উচিত।

ড. আদিল আরও বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পই যথা সময়ে, নির্ধারিত ব্যয়ে সমাপ্ত হচ্ছে না, ফলশ্রুতিতে অধিকাংশ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সময় ও ব্যয় বাড়ছে, বাড়ছে জনদূর্ভোগ ও কাজের মান খারাপ হচ্ছে। একই সাথে প্রকল্পে দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের বিষয়ে নির্মোহ তদন্ত হওয়া উচিত বলে বি.আই.পি. মনে করে এবং প্রকল্পের উপযোগিতা বিশ্লেষণ ও প্রকল্পের সামগ্রিক পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ না করার ফলেও প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, প্রত্যক উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রকৃতি নির্ভর পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়ে সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনার দর্শনে পরিবর্তন আনতে হবে এবং প্রকৃতি নির্ভর টেকসই ও সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

খাল-জলাশয় দূষণ ও দখল এর সাথে যারা জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ওয়ার্ড কেন্দ্রিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাকে সুসঙ্গত ও দৃঢ় করতে হবে তাহলেই গণপরিসর, খেলার মাঠ, পার্ক দখল, তদারকি, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার উন্নতি হবে।

তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের মাধ্যমে যেন সামাজিক বিভাজন তৈরি না হয়। ঢাকা শহরের অনেক খেলার মাঠ আধুনিকায়নের প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, পার্ক-খেলার মাঠ উন্নয়ন করা হয়েছে কিন্তু স্থানীয় শিশুরা প্রবেশ করতে পারছেনা এমন উদাহারণ আছে। অথচ এসডিজির মূল লক্ষ্য হচ্ছে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। তাই সকল ধরনের নাগরিক সেবায় প্রান্তিক মানুষ থেকে সকল শ্রেনীর মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে তাদের দায়িত্বে সচেতন হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন বি.আই.পি.-র সভাপতি।