একটা বিভাগীয় ইলিশ মাছের ভাগাভাগির কাল্পনিক গল্প

আপডেট: মে ২৫, ২০২৩
0

ডা জাকারিয়া চৌধুরী :

স্থান: চাদপুর পুরান বাজার

কাল: ভোর সাড়ে চারটা

পাত্র: আড়তদার, সুলতান ব্যাপারী এবং তার অনুসারী। অন্যদিকে আছে সুলতান ব্যাপারির চিরশত্রু কুদ্দুস গং ও তার অনুসারীরা।

রাত আড়াইটার দিকে মাঝি সুবল ফোন করল সুলতান ব্যাপারীকে। রাত আড়াইটায় সামান্য একজন মাঝি ফোন দিল তাও প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির মধ্যে !! বড় কিছু হইল নাকি !! সুলতান ফোন তুললেন, সুবলের কথা একতরফা শুনলেন, ফোন রাখলেন। আবার ফোনটা হাতে নিয়ে জাহাংগীর কে ফোন দিয়ে বললেন, কুড়ি মিনিটের মধ্যে পুরান বাজারের তিন গেইটে ১২ জন লোক সহ অবস্থান নিতে। কেউ হোন্ডা ব্যাবহার করবে না। সাথে মোবাইল, সিগারেট, লাইটার এসব রাখা যাবে না। বাজারে যেন একটা মাছিও ঢুকতে না পারে। জাহাঙ্গীর মনে মনে হেসে ফেলল। এত রাইতে এমন তুফানে বউ ছাইড়া কেউ বাইরে যাইবো ? কথাটা বলার সাহস সে দেখালো না। এরপর সুলতান সাহেব বিদ্যুত অফিসে ফোন করে বললেন সোয়া চারটা থেকে পাচটা পর্যন্ত পুরান বাজারের বিদ্যুত বন্ধ রাখতে। অফিসের বিদ্যুত অপরেটর তাকে বলবার চেষ্টা করেছিল এই বলে যে, এই মুহুর্তে কারেন্ট না থাকলে সকালে বিপুল বরফের ঘাটতি দেখা…. ………… সুলতানের ধমক খেয়ে থেমে গেল খোদ বিদ্যুত অফিস। অফিসের সেই লোকটা মনে রাখতে পারেনি সুলতান সাহেব কখন থেকে বাজারে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ রাখতে বলেছে !! নার্ভাস বিদ্যুত ওপারেটর বাজারের ইলেক্ট্রিক লাইনটা তাৎক্ষণিক ডিসকানেক্ট করে টিএনটি ফোনের রিসিভারটা তুলে ঘুমিয়ে পড়ল।

অন্যদিকে সুবল ছোট্র একটা বরফের ব্যাগ চাদপুরগামী এক লঞ্চে ছুড়ে ফেলে নিজেও সেই লঞ্চে উঠে বসল। এই রুটে সারারাত শত শত লঞ্চ চলে। আগে তো কলিকাতা টু রেংগুনের সার্ভিস ছিল বলেও সে শুনেছিল।সে আজ চারটা সোনালী ইলিশ পেয়েছে। টোটাল ১৫ কেজি ত হবেই। এই ইলিশের কথা সে তার দাদার মুখে শুনেছিল। এমন কিছু শুনেছিল যে উত্তেজনায় সে বমি করে দিল। নৌকা ফেলে আসবার সময় সে পাটাতনের ছিদ্র খোলা ফেলেই চলে এসেছে। আধা ঘন্টা পরেই সেটা ডুবে যাবে। যাক। দাদার আমলের ভাংগা নাও। আর কত !! এই ইলিশের মাংস নাকি এক গ্রাম দুই গ্রাম হারে বিলেতে বিকিকিনি হয়। এর তেল………………সুবলের আবার বমি আসলো। আর কিছু মনে হবার আগেই সুবল লঞ্চের ডেকে দ্বিতীয়বার বমি করে ফেল। দাম কত হতে পারে ? এই ইলিশের রক্ত দিয়ে যেন কিসের অসুধ বানায় ! ? সুবল ঠিক করল সে এক হালি ইলিশের দাম এক কোটি টাকা চাইবে। আড়তদার মুছলমানের ছেলে। সে সোনালী ইলিশ কি জানেও না। তারে বাইপাস করে কিছু করাও যাবে না। সুবল তৃতীয়বার বমি করল। সুবল তাঁর জীবনে কখনো একবারে পাঁচ হাজার টাকা হাতে নিয়ে দেখেনি। তাঁর জীবন আড়তে বান্ধা। সুলতান সাব একদিন কথায় কথায় সুবলরে কইছিল, সাগরের নিচে আগুন ধরলে সোনালী ইলিশ ডাংগায় আসে। যে পায় সে সাত রাজার ধন পায়। সুবল বিশ্বাস অবিশ্বাস কোনোটা-ই করতে পারেনি। কারন তাঁর দাদাও সোনালী ইলিশের কথা বলেছিল। এখন এই মাছ সুলতান সাব না নিলে চারটা ইলিশ পচিশ হাজারও বিক্রি হবে না। দূর থেকে চাঁদপুর শহর দেখা যাচ্ছে। বাজার দেখা যাচ্ছে না। কারেন্টের ট্রান্সমিটার জ্বলে গেল কিনা কে জানে !

বাজারে বরফ ব্যাবসার একক নিয়ন্ত্রন কুদ্দুসের হাতে। টানা এক ঘন্টা বরফের কারখানা বন্ধ মানে বিরাট সমস্যা। কুদ্দুস বিদ্যুত অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। এক রুমের অফিস । ফোনের রিসিভার তুলে, সদর দরজা সটান খোলা রেখে অপারেটর ঘুমাচ্ছে। রাস্তার স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলে অথচ বরফ কল চলে না। বাজারে যে ইলেক্ট্রিক সংযোগ ঢুকেছে তাঁর লিভারটা খামাখা উপরের দিকে তোলা। বাজারে আগুন লাগলেও এত বৃষ্টিতে সব নিভে যাবার কথা। কুদ্দুস সাহসী, ঠান্ডা মাথার মানুষ। অপারেটরের ঘুম ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত সে তাঁর পাশে সিগারেট হাতে বসে রইল। তাকে ঈষৎ চিন্তিত দেখাচ্ছে। অপারেটরের দিকে তাকিয়ে কুদ্দুস মনে মনে ভাবছে, আহা ! গরীব মানুষ ! ভুলে হয়ত কারেন্টের লাইন অফ করেছিল। অন করতে ভুলে গেছে। এদের বেতন কত কে জানে। কুদ্দুস ঠিক করল তারে মাসকাবারি এক হাজার করে টাকা দেবে। কোন কারন নাই, এমনি-ই দেবে। কুদ্দুস দেয়। দেয়ার ব্যাপারে তাঁর সুনাম আছে শহর জুড়ে। তাঁর নৌকায় করে আনা বড় বড় বরফের চাই নদীতেও বিক্রি হয়। কোনো কোনো দিন কুদ্দুস উদাস হয়। সেইদিন সে নিজেও নৌকায় বসে বসে নদী দেখে, বরফের বেচাকেনা দেখে। শৌখিন সাহেবেরা, তাদের ছেলেপুলেরা ক্যাবিন ক্রুজার ভাড়া নিয়ে নদীতে ঘুরতে আসে। একেক সময় একেক দল। এদের দিন নাই রাত নাই। নানান আমোদ ফুর্তি করে। কেউ কেউ পাগলের মত আচরন করে। সব নৌকা বরফ কিনে না কিন্তু এরা অবশ্যই কিনে। দেদারসে টাকা খর্চা করে। নানান পদের মাছ কিনে। কুদুস নিজে তদারকি করে এদের মাছ বাক্সবন্দী করে দেয়। অতিরিক্ত হিসেবে আস্ত একটা বরসের চাই ক্রুজরের পাটাতনে দিয়ে দিতে বলে। ক্রুজরের বাচ্চারা সব হাই লেভেলের নেশা করে বুঝা যায়। বড় লোকের বখে যাওয়া সন্তান এরা। আচ্ছা তারা কি কখনো কেউ আচ করতে পারে ক্রুজার নিয়ে ফিরতি ঘাটে নামার আগেই এক ফাকে এর ড্রাইভার সুবাস বাবু বরফের চাইটা কেন সরিয়ে ফেলে ? কুদ্দুস প্রতি চালানে এক কেজি করে আফিম পাঠায় এইভাবে। বিশেষ এয়ারটাইট বক্সে ভরে। সেই বাক্সের চারদিক ঘীরে থাকে বিশাল বরফের সেই চাই।

প্রচন্ড একটা বাজ পরার শব্দে ইলেক্ট্রিক অপরেটর লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়ল। কুদ্দুসকে দেখে বিরবির করে বলল – সুলতানের হুকুমে বাজারের লাইন বন। আমার হাত নাই………………
কুদ্দুস ঘর থেকে বের হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অপারেটর বুঝতে পারছে না সে ইলেক্ট্রিক লাইনটা অন করবে নাকি এভাবেই ফেলে রাখবে……………

সুবল মাঝি থরথর করে কাঁপছে। তাঁর হাতে ৪৯ লাখ টাকা। তাঁর দায়িত্ব ঘরে গিয়ে নিজের বাঞ্জা বউ নিয়ে আঁধার থাকতে থাকতেই বর্ডার পার হয়ে চলে যাওয়া। আর জীবনে কখনো সে ফিরবে না। জাহাঙ্গীর তাকে তাঁর বোনের বাড়িতে রেখে আসবে। টাকা পয়সাও জায়গামত পৌঁছে দিবে। সে নিজে না বললে তাঁর দিদি কখনো কিছু টের পাবে না। যাবার আগে যেন জাহাঙ্গীরের কাছে সে তাঁর ভিটের দলিলটা, আর কয়েকটা কাগজে সই করে যায়।
সুবলের ভাবনার সময় নেই তাঁর ভিটের দাম কত !! পড়েছে রাবনের হাতে যেতে হবে সাথে।
আড়তদারের হাতে আছে এক লাখ টাকা। সুলতান এই টাকা দিয়েছে এমনিই। এই টাকা দিয়ে সে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবে। কেবল বিপদ হবে কথা বললে। সুবল যাবার আগে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মাছের ডিম গুলোর উপর তাজা রক্ত সব ঢেলে একটা জিপ পলিতে ভরে বরফের কার্টনে রেখে গেছে।
কুদ্দুস বিড়ালের মত নিঃশব্দে এসে সুলতানের পাশে দাঁড়াল। সুলতান এতে অবাক হয়নি, এ কাজ কেবল কুদ্দুসের পক্ষেই সম্ভব। জাহাঙ্গীর তাকে আটকাতে পারলে কুদ্দুর সুলতানের মুখে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ত না।
– সোনালী ইলিশ ! এক সাথে চাইরটা…………… এইজন্যে কারেন্টের লাইন বন্ধ রাখছ না ! আমি হইলেও তাই করতাম। ওমা ডিম হয় নাই ? সোনালী ইলিশের ডিম হয়না। তুমি হুদাই কাটাছেড়া করলা সুলতান। সুবল’রে কত দিয়া দেশছাড়া করলা !! – পৈশাচিক হাড় হিম করা কন্ঠে ধীরে ধীরে কথা গুলো বলল কুদ্দুস। সুলতান যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও পারল না। একটা কটন বাডের মাথায় টিস্যু পেঁচিয়ে সে তাঁর কান চুলকাতে লাগল।
৫০ । সুলতান যথাসম্ভব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল। কুদ্দুস বিড়ালের মত ঢুকলেও গুন্ডামি কইরা বাইর হইয়া যাইতে পারব না। ডিল এ আসতে হবে – সুলতান এই যুক্তিতে নিজের নার্ভাসনেস গোপনের চেষ্টা করছে।
শুনো, আমি বেকুব না। ডিম আর রক্ত তুমি নিছো নেও। মাছ চাইরটা আমারে দিয়া দেও। তোমার পাহারাদার ১১ জন’রে ৫৫ হাজার দিবা। জাহাংগীরের ভডভটি বাইকটা আমি কাইল রাইতে পানিতে ফেইলা দিমু। তুমি তারে নতুন একটা বাইক কিন্না দিবা। সে নেড়ি কুত্তার মত আগের স্টাইলেই তোমার পা চাইটা যাইব। আজ রাতের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাইব না। টাকা দিবা একেক দিন একেক জনরে একেক ছুতোয়। এখানে কি হইল না হইল তাগো লগে কথা কইও না। আমি তোমারে ৪০ দিয়া দিতাছি ক্যাশ। বরফ কলে টাকা আছে। ডিম আর রক্তের পোটলা কয় কোটি বেচলা জিগামু না। রাজত্ব তোমার, নবাবী আমার। তুমি তোমার মেয়াদ পর্যন্ত রাজত্ব করো। কেউ ডিস্টার্ব করব না । আমি নিজে তোমার গ্যারান্টর। আমার লোকেরা সকল পর্যায়ে নবাবী করব। মাসিক খাজনা ধরো আমি অগ্রিম দিয়া দিলাম। তুমি এই বিষয়ে কিছু না কইলে তোমার গোলামেরা ৫০০০ টাকাতে-ই সন্তুষ্ট থাকব। তুমি রাজা থাকবা আর আমি ১৪ টা নবাবী আমার লোক দিয়া চালাব। তোমার লোকেরা নবাবী চাইলে কইবা রাজা মান সিং আমারে এই এলাকার রাজা বানাইছে, কুদ্দুসরে দিছে নবাবী আর দেওয়ানী। কুদ্দুস মাসে মাসে নিজ হাতে খাজনা দিয়া যাইব। সেই খাজনার ৯০ ভাগ যাইব রাজার দরবারে………… ইতং বিতং……… পরেরবার যেন রাজা একজন নবাব অন্যজন না হয় তাদেরকে সেই আশ্বাস দিবা। বুঝছ ভাই ?

এইটারে কি বলে জানো ? থাউক সব জাইনা লাভ নাই। তুমিও চাও নাই, তোমার লেবারেরা কেউ দেওয়ানী বা নবাবী পাউক। আমি জানি সুলতান। আমি সব জানি। তুমি যারে ইচ্ছা হয় মুখে মুখে রাজা বানাও যারে ইচ্ছা হয় তারে তোমার আখড়ায় বাইন্ধা পিটাও। নিজে রাজাও হইলা, কয়েক কোটি টাকা পকেটে ঢুকল, সবলরে দেশছাড়া করলা। এক রাইতে এরচে বেশি পাওন ভালা না। আরেকটা কথা কই শুনো- সুবলের বাড়িটা ছাইড়া দিলে কইও। পাঁচ কোটি । আমার আরও বরফ কল দরকার। দেখো না ক্যামনে রাইত বিরাইতে কারেন্ট বন্ধ হইয়া যায় তোমার ধমকে !! কুদ্দুস কিছুটা মুচকি হাসি ধরে রেখে বলল – যাও কিছুদিন ঘুইরা আসো। পারলে আগামী সপ্তাহে-ই যাও। শুভ কামনা রইল।


লেখক : Zakaria Chowdhury নির্বাহী সম্পাদক দেশ জনতাডটকম