করোনায় দেশের ৩৬% নারী কর্মক্ষেত্র হারিয়েছে – মহিলা পরিষদ

আপডেট: মে ২৩, ২০২১
0

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ‘‘নারীর উপর কোভিড- ১৯ এর প্রভাব এবং আসন্ন জাতীয় বাজেট’’ বিষয়ক অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা। সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকেএবং সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরমিন্দ নিলোর্মী; বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ এবং ডিবিসি চ্যানেলের বার্তা বিভাগের প্রধান প্রণব সাহা ।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাৎসরিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজকের আলোচনা সভা। গত দেড় বছরে কোভিড পরিস্থিতি নারী পুরষের বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি বিগত সময়ের অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। আজকের আলোচনার তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে কোভিড মহামারীতে কিভাবে নারীর জীবন প্রভাবিত হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।

পাশাপাশি তিনি চলমান প্রতিকূলপরিস্থিতিতে নারীর অবস্থার উন্নয়নের জন্য এবং উন্নয়ন লক্ষমাত্রাকে ধরে রাখতে বাজেটে বিশেষভাবে সরকারের মনোযোগ দেয়ার কথা বলেন।

লিখিত বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন,‘ নারীর উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব’বিষয়ক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে বলেন মহামারীতে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। সানেমের ২০২০-২০২১ সালে করা বিভিন্ন জরিপের ফলাফল অনুসারে শ্রমবাজার, স্বাস্থ্য, শিক্ষায়, জেন্ডার ভিক্তিক সহিংসতায় নারীদের অবস্থান বিশ্লেষণ করে বলেন দেখা গেছে শ্রমবাজারে নারীরা বেশি কাজ হারিয়েছে। নারীর অংশগ্রহণ ছিলো ৩৬%,পুরুষের ছিলো ৮০%। ব্র‌্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত জরিপে একই চিত্র দেখা গেছে। আয় ব্যয়ে নারী প্রধান পরিবার গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বেশি।

শিক্ষায় ঝড়ে পড়ার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায়না। অনলাইন ক্লাস ইতিবাচক হয়েছে তা বলা যাবেনা। স্বাস্থ্যে অতিরিক্ত খরচ নারীদের বেলায় বেশি হয়েছে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নারী ও শিশুস্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নেতিবাচক দিক লক্ষ্য করা যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা ঘরে-বাইরে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি কোভিড থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।

তিনি বলেন জেন্ডার বাজেট নিয়মিতভাবে তৈরি করতে হবে; ঝড়ে পড়া রোধে মিড-ডে মিল, উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, সেফটি নেট প্রোগ্রামের আওতায় নতুনভাবে দরিদ্রদের সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে; দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ প্রাপ্তির হার বৃদ্ধি করতে হবে; গ্রামীণ নারী;দের স্বল্পসুদে ঋণ দেয়া, মূলধারার শ্রমবাজারে নিয়ে আসা, দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ প্রদানে গুরুত্ব দিতে হবে। অভিবাসী নারীদের নিরাপদ ও সম্মানজনক কাজে অন্তর্ভূক্তিকরণ, তথ্য সহায়তা দেয়া জেন্ডার ভিত্তিক ডিভাইস প্রদানে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতেহবে, জেন্ডার ভিত্তিক তথ্য উপাত্তে জোর দিতে হবে। অস্বীকৃতিমূলক কাজকে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে । নারীর ক্ষমতায়নে বাজেট কতটা টেকসইভাবে কার্য়কর হচ্ছে। বরাদ্দ যেমন গুরুত্বপূর্ণ এর সাথে তা নারীর জন্য কতটা কার্যকর হচ্ছে সেটিওমূল্যায়নে পরিবীক্ষণের উপর জোর দিতে হবে।

সভায় উপস্থিত আলোচকবৃন্দ সংগঠনের প্রয়াত সভাপতি আয়শা খানমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন সমাজের রাষ্ট্রনীতিতে , অর্থনীতিতে নারী পুরুষের মাঝে থাকা বৈষম্যকে আরো প্রকট করেছে কোভিড মহামারীর অভিঘাত। জেন্ডার বাজেটের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে গৃহীত ক্ষেত্রগুলোতে যেমন নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে, সহিংসতা প্রতিরোধে উন্নতি তেমন হয়নি। অর্জন যতটুকু হয়েছে তা হারিয়ে ফেলার আশংকা আছে। নতুন দরিদ্দ্র্যের সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে আড়াই থেকে তিন কোটি। সমস্যার সমাধানে বক্তারা বলেন স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচ বৃদ্ধিকরতে পারলে চলমান বৈষম্য কমানো যাবে। এই খাতে বরাদ্দবাড়লেও তা সন্তোষজনক নয়। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। বাজেটে প্রবৃদ্ধিকে জোর দেয়া হয়, তবে এর ধুম্রজালে যেন আটকে না যায় তা দেখতে হবে।

বাজেটে অনানুষ্ঠানিক খাতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। স্টার্টআপের পাশাপাশি থোক বরাদ্দ চালু করতে হবে্ নারী অভিবাসীরা যারা কাজে ফেরত যেতে চায় তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে নারী অভিবাসীদের সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে; নারী নির্ভর কর্মসূচির কলেবর বৃদ্ধি করতে হবে; সামাজিক সুরক্ষা নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে; নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে মনিটরিং সেল গঠনে সরকারি -বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে করতে হবে; বরাদ্দ কম-বেশির চেয়ে দেখা জরুরী বরাদ্দে নারীকে গুরুত্ব দেয়া, গুনগত বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে; নতুন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পাচঁ লাখ টাকা কর মুক্ত রাখতে হবে; সঞ্চয়পত্রে নারীদের জন্য সুদের হার বৃদ্ধি করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা , বাল্যবিবাহ বন্ধে ক্ষমতার জায়গা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আগামী বাজেটে নারীর কর্মসংস্থানে নীতিগত সহায়তা, মনোজগতে পরিবর্তন সহায়তা সবচেয়ে জরুরি। এর উত্তরণে জেন্ডার বাজেট সংক্রান্ত আলোচনায় মনস্তত্ববিদ, সমাজবিদদের উপস্থিতি জরুরী বলে মতামত দেন বক্তারা।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাজেট কেবল অর্থ মন্ত্রনালয়ের একটি পরিকল্পনা নয় বরং স্বচ্ছ কর্মসূচি পালনের একটি উদ্দেশ্য। নারী আন্দোলন মনে করে নারীর ক্ষমতায়নে , নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কেবল প্রতিশ্রুতিপূর্ণ পরিকল্পনাই যথেষ্ঠ নয়; বরং প্রয়োজন অনুসারে বাস্তবায়ন ও জরুরি। বাজেটের কতটা অংশ প্রকৃত উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত রাজনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে স্থায়ী উন্নয়ন লক্ষমাত্রার সাথে সিডও, জাতীয় উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়নের প্রতিফলন জেন্ডার বাজেটে থাকতে হবে। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অর্থনীতিতে, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীকে মূলধারায় নিয়ে আসার জায়গায় জোর দিতে হবে। সকল অর্থনৈতিক কাজে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রকে সংবেদনশীল করে তোলা, নেতৃত্বে নারীকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। বাজেট প্রণয়নে যারা যুক্ত তাদের জেন্ডার সেনসিটিভ মনোভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে জেন্ডার বান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলতে জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

অনলাইন আলোচনা সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, সানেমের প্রতিনিধি,মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন, আইইডি, ওয়াইডাব্লিউসিএ ব্র্যাক, একশন এইড, বিএনপিএস, এডাবের প্রতিনিধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক এবং কর্মকর্তাসহ ৫৪ জন উপস্থিত ছিলেন।

সভার সঞ্চালনায় ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ- সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত আন্দোলন সম্পাদক রেখা চৌধুরী।