কিশোর গ্যাং: জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রীয় দায়

আপডেট: মে ২৯, ২০২২
0

এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

সমাজে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজমান। অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি কিশোর গ্যাং প্রকট আকার ধারন করেছে। শিশু/কিশোররাই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত সম্পদ। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে শিশুরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসাবেই বিবেচিত। বৃটেনে শিশুদের বলা হয় Queen’s Childreen। কারণ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্নদার এবং সুশিক্ষিত হিসাবে গড়ে উঠা শিশু/কিশোরদের পক্ষেই একটি সৃজনশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা করা সম্ভব। বখাটে বা Deliquent কিশোররা শুধু সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ঝুকিপূর্ণ নহে বরং পরিবারের জন্যও আতঙ্ক এবং একটি বোঝা। তারা ভারাটে খুনী হিসাবে ব্যবহার হওয়া ছাড়াও নেশার টাকা জোগার করতে গিয়ে পিতা, মাতা ও আত্মীয় স্বজনদের খুন করছে। সমাজ সংস্কারকগণ যুগে যুগে শিশু কিশোরদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য তাগিদ ও পরামর্শ প্রদান করেছেন। কবি গোলাম মোস্তফা অনেক আবেগ নিয়ে লিখেছেন যে, “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে।” কবিতার এ দুটি লাইন স্বরণ করিয়ে দেয় যে, রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য শিশুর গুরুত্ব কতটুকু। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ বখাটে হয়ে যাওয়া শিশু/কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে সেটাই এখানে পর্যালোচনার বিষয়। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী শিশু/কিশোররাই সবচেয়ে বেশী নিরাপত্তাহীন। সম্প্রতি আমেরিকার একটি স্কুলে বুলেটে খুন হওয়া ২১ জনের মধ্যে ১৯ জনই শিশু। পৃথিবী ব্যাপী এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। শিশুরা পৃথিবী ব্যাপী যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছে, তাদের দেহের অঙ্গ প্রতঙ্গ বিক্রি করা হচ্ছে, বাংলাদেশে তাদের পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা বৃত্তিতে নিয়োজিত করা হচ্ছে, মেয়ে শিশুরা বয়স বৃদ্ধির পূর্বেই পতিতাবৃত্তিতে ব্যবহ্নত হচ্ছে। শিশুদের উপর নানাবিধ হয়রানী বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘ ১৯২৪ ইং সনে “The Declaration of the Right of the Child” প্রনয়ণ করে যা ১৯৫৯ ইং সনে জাতিসংঘের প্রঞ্চম অধিবেশনে “শিশু অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ” হিসাবে স্বীকৃত প্রদান করে। ১৯৬৬ ইং সনে জাতিসংঘ পুনরায় এ সনদটিকে শিশুদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত দেয়। বাংলাদেশ উক্ত সনদের ২১ এবং ১৪(১) ধারা ব্যতীত সনদের সকল শর্ত মেনে চলার অঙ্গীকারে সনদের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে। উক্ত সনদ মোতাবেক শিক্ষা, সুষম খাদ্য (Balance diet), স্বাস্থ্য, পুষ্টি (Nutrution), অংশীদারিত্ব, নির্মল বিনোদন, বিশুদ্দ পানীয়, স্বাস্থ্য সম্মত মলনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান সম্পন্ন পরিবেশ প্রভৃতি প্রতিটি শিশু/কিশোরের অধিকার। কিন্তু ক্ষুদ্র, দারিদ্রতা, সামাজিক সচেতনার অভাব, বৈষম্য, সুষম খাদ্য, আশ্রয়, পর্যাপ্ত শিক্ষা, নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া থেকে শিশু/কিশোররা বঞ্চিত। শিশু অধিকার সম্পর্কে “প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়” কর্তৃক প্রকাশিত গবেষনা পত্রে গবেষক অধ্যাপক হারাধন কুমার মহাজন উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের মোটা জনসংখ্যার ৩০% পরিবার অত্যান্ত দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থানের কারণে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করে। গবেষকের মতে ৩৬% শিশু প্রাথমিক এবং ১০% শিশু মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। তার মতে দারিদ্রোর কষাঘাতের জন্য মোট দাগে শিশু/কিশোররা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভাবগ্রস্থ পরিবারকে এটাও বিবেচনায় নিতে হয় যে, সন্তানকে শিক্ষিত করার পরও চাকুরী না হওয়ার কারণে বেকারত্বের অভিশাপে গোটা পরিবারকে ভূগতে হয়।

১৯২৪ ইং জাতিসংঘে প্রনীত শিশু অধিকার সনদে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করা স্বত্বেও আইনগতভাবে বাংলাদেশে শিশু শ্রমের বৈধতা দেয়া হয়েছে। যেমন “The Employment of Children Act’ 1938” আইনে শিশুর বয়স ১২ বৎসর নির্ধারন করা হয়েছে। “The Factories Act’ 1965’ ১৯৬৫” মোতাবেক শিশুর বয়স ১৪ বৎসর নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ সনদ, শিশু আইন, ২০১৩ এবং বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুর বয়স ১৮ বৎসর নির্ধারিত আছে। একই রাষ্ট্রে বয়সের এ বৈষম্য দূরীভুত হয়ে সমতল হওয়া বাঞ্চনীয়। জনগণের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্র সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তা নি¤œরূপ ঃ-

“রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার সস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নি¤œলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়।

(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;

(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;

(গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকামের অধিকার; এবং

(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্যলাভের অধিকার।”

অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংবিধান রাষ্ট্রকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৭’তে বলা হয়েছে তা নিম্মরূপ ঃ-

“(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;

(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যখাযখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য;

(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”

জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার প্রশ্নে সংবিধানের ১৮নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের প্রতি যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে তা নিম্মরূপ ঃ-

“(১) জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা করিবেন।

(২) গণিকাবৃত্তি ও জয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ১৯২৪ এবং আমাদের সংবিধানের উল্লেখিত অনুচ্ছেদগুলির মর্মার্থ যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে সহজেই উপলব্দি করা যাবে যে, ভবিষ্যত নাগরিকদের যত্নসহকারে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র কতটুকু দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে? সংবিধানের অনুচ্ছেদে মদ নিষিদ্ধ থাকলেও “এ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২২ মোতাবেক মদের পারমিট, লাইসেন্স ইস্যু করার বিধান করে মদ খাওয়ার বিষয়টি ওপেন করা হয়েছে। সংবিধান হলো রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে একটি চুক্তিনামা, যে চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে রাষ্ট্র বাধ্য। শিশুরা দেশব্যাপী কিশোর গ্যাং এ পরিনত হচ্ছে, খুন খারাপী, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণ প্রভৃতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। কারণ স্বাধীনতার ৫০ বৎসর পরেও সংবিধানের প্রদত্ত নির্দেশনা পুরাপুরি পালন করতে রাষ্ট্র সফল হয়েছে কি?

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)

মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬

E-mail: [email protected]