“কুহেলী গুন্ঠন টানি শীতের নিশীথে/দু’ফোটা শিশির আর অশ্রুজল -পাতে!!’

আপডেট: নভেম্বর ২৭, ২০২২
0

কবি আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের শীতের বর্ণনা প্রসঙ্গে দেহ মিলনের এক মধুর চিত্র তুলে ধরেছেন- ‘সহজ দম্পতির মাঝে শীতের সোহাগে হেমকান্তি দুই অঙ্গ এক হইয়া লাগে। ঋতু পরিক্রমায় শীত আসবে শীত যাবে কিন্তু কবিচিত্তে রেখে যাবে তার সরব উপস্থিতি। বাংলাকাব্য সাহিত্য শীতবিষয়ক প্রতিটি কবিতাই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। শীত বন্দনায় কবির পঙ্‌ক্তিমালায় নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা আর অসহায়ত্তের চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি কোনো কোনো শীত বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

প্রকৃতি যখন শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে হিম কুয়াশায় ঢেকে দেয় প্রভাতের আলোকরশ্মি কিংবা ঘাসের ডগায় জমে থাকা কুয়াশার জলবিন্দুর ওপর অস্পষ্ট সূর্যালোক,তখন তার প্রতিবিম্বিত যে অপার সৌন্দর্যের আলপনা তৈরি করে- মনে হয় শীত এসেছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওর-বাঁওড়, খাল-বিলে অতিথি পাখির আনাগোনা কিংবা শর্ষেফুলের হলদে ক্যানভাস দুলে ওঠা হিমেল হাওয়া অথবা নতুন খেজুরের রসে বানানো পায়েস আর পিঠা-পুলির ম-ম গন্ধ মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতিতে শীতের আগমন।


যদিও জলবায়ু পরির্বতনজনিত কারণে আমাদের দেশে ঋতু বৈচিত্র্যতা অনেকখানি হারিয়েছে তবুও শীতের আমেজ হারিয়ে যায়নি একেবারে। শীত ও বর্ষা ঋতু শ্রমজীবী মানুষের কাছে বেঁচে থাকার জন্য লড়াইয়ের ঋতু। শীতের এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিচিত্র সব কবিতা রচিত হয়েছে। শীত বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে আছে আমাদের বাংলা কবিতা ও গানে। অবশ্য এ কথা সত্য বিভিন্ন কবির কবিতায় শীতের উপস্থিতি বিভিন্নভাবে এসেছে।

সুকান্ত ভট্টাচার্য শ্রেণি সংগ্রামের কবি। তার ভাবনায় নিসর্গের চেয়ে জনজীবন প্রাধান্য পাবে এমনটাই স্বাভাবিক। সুকান্ত শীতে দরিদ্রের কষ্ট দেখেছেন পথের ছেলেগুলোর জন্য শীত কতটা যাতনাময়। শীত যেন বিভীষিকা। গরিবদের শীত নিবারণের জন্য সূর্যই হয়ে দাঁড়ায় তাদের উষ্ণতার অবলম্বন। ‘কৃষকের চঞ্চল চোখ ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলোর জন্য’ যেমন প্রতীক্ষা করে, তেমনি দরিদ্ররা ‘হিমশীতল রাতের পর উত্তাপ বিলানো সূর্য ওঠার জন্য’ প্রতীক্ষায় থাকে। শীত নিবারণের জন্য শীতার্তদের কাছে ‘সকালের এক টুকরো রোদ্দুর’ এক টুকরো সোনার চেয়েও দামি মনে হয়। সেই সূর্যের প্রতি ‘প্রার্থী’ কবিতায় সুকান্তের আহ্বান- হে সূর্য তুমি আমাদের সঁ্যাতসেঁতে ভিজে ঘরে উত্তাপ আর আলো দিও আর উত্তাপ দিও রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে। শীত কেবলি কুয়াশা ভেজা পাতাঝরার ঋতু হলেও শীত কখনো প্রাণহীন ঋতু নয়।

শীত ঋতু কবিচিত্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে; এক দিকে শীতের নিষ্ঠুরতা, পাতাঝরার নিঃসঙ্গতা অপর দিকে খালে-বিলে অতিথি পাখির কল-কাকলি কিংবা শর্ষে ফুলের হলুদ ক্যানভাস প্রকৃতিকে ভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তোলে। ৭০ দশকের জনপ্রিয় কবি আবিদ আজাদের কবিতায় শীত আসে ভালোবাসার রূপে- এই শীতেই আমর শ্বাসকষ্টের কালো জল ঝলকাতে থাকে মাছের আশের রৌদ্র ও জীবিত কবিতায় শীত তাই আমার ভালোবাসার ঋতু শীত তাই আমার কবিতার ঋতু।

শীতের মাঝেই প্রেয়সীর শারীরিক উষ্ণতায় শীত নিবারণ করতে চেয়েছেন কেউ কেউ, পাশাপাশি কারো কারো কবিতায় সরাসরি শীত না এলেও শীতের নানা অনুষঙ্গ কবিতার শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছে আলোর বর্ণচ্ছটা। স্বভাবতই শীতের মুগ্ধতা কিংবা নির্মমতা যাই বলি না কেন, বারবার কবির কলমে নিত্য নতুন পঙ্‌ক্তিমালায় উঠে আসবে শীত।

ব্রিটিশ কবি শেলি তাঁর এক কবিতায় শীতকে আশাবাদের ঋতু হিসেবেও দেখেছেন। কবিতায় তিনি লিখেছেন, “ও, ভিন্ড, ইফ ভিন্টার কামস্, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?” অর্থাৎ “যদি শীত আসে, বসন্ত কি খুব দূরে থাকতে পারে?” আহা শেলির মতন যদি শীতকালকে দেখতে পারতেন রাশান কবি মায়াকোভস্কি।

শেষঅব্দি তার সুইসাইডের পেছনে শীতকালও দায়ী ছিল বলে একদল ফরাসি মনোবিদদরা দাবি করছেন। তার প্রেমিকা পোলানস্কায়ারের কথাগুলো এমন, “আমি বেরিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়েছি কয়েক পা। একটা গুলির শব্দ। আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে এলাম করিডোরের দিকে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে ভয় হলো। তারপর ভেতরে ঢুকলাম, যেন একযুগ হয়ে গেছে। সারা ঘরে বারুদের ধোঁয়া, কার্পেটের ওপর পড়ে আছেন মায়াকোভস্কি। হাত দুটো ছড়ানো। বুকে রক্তের দাগ। শীতকালে সে খুব বিষাদে ভুগত। শীতকাল নিয়ে আমাকে একটা চিঠিও লিখেছিল। সেই শীতকালই নিয়ে গেল তাকে।”