গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা চান পরিবেশ ও অর্থনীতিবিদরা

আপডেট: জুন ১০, ২০২১
0

নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র পরিবেশ স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচি কমিটির উদ্যোগে আজ ১০ জুন, ২০২১ বৃহস্পতিবার সকাল ১১:০০টায় “জাতীয় বাজেট ২০২১-২২: স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ”-শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা ‘জুম’ প্লাটফর্মের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়।

প্রাথমিক স্বাস্হ্য পরিচর্যা ও রোগ নিয়ন্ত্রণের সাবেক পরিচালক, ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা এবং বাপা’র পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক, ড. এ. এম. জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপা’র পরিবেশ স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচি কমিটির সদস্য-সচিব লেখক ও গবেষক বিধান চন্দ্র পাল।

আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান, জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বি এম এ এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব, কৃষি অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহম্মাদ। এছাড়া এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বাপা’র কোষাধ্যক্ষ, মহিদুল হক খান, বাপা সাধারণ সম্পাদক, শরীফ জামিল, যুগ্ম সম্পাদক, আলমগীর কবির, নির্বাহী সদস্য, ফরিদা আক্তার, আতাউর রহমান মিটন এবং বাংলাদেশ ফরোয়ার্ড পাটির এড. জিয়াউর রহমান।

মূল প্রবন্ধে বিধান চন্দ্র পাল বলেন, বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, এছাড়া ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে, অবকাঠামোর অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনাগত দিকসহ বিভিন্ন কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যেও অন্যতম। ফলে পরিবেশ সংরক্ষণ টেকসই উন্নয়ন কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া প্রয়োজন। আমরা জানি যে, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হিসাব করতে গিয়ে মূলধনী সামগ্রীর অবচয় বাদ দিলে নীট প্রবৃদ্ধির হিসাব পাওয়া যায় (যাকে যথাক্রমে জিএনপি ও এনএনপি বলা হয়ে থাকে)। এর সঙ্গে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্যায়নের হিসাব নিলে আমাদের জিডিপির বার্ষিক নীট প্রবৃদ্ধির প্রকৃত হার ৭.২ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে বলেই আমাদের কাছে মনে হয় (যাকে গ্রীন একাউন্টিং বা গ্রীন ফাইন্যান্সিং বলা হয়ে থাকে)। আমরা বলতে চাই, পরিবেশ সুরক্ষা একটা বহুমাত্রিক বিষয়। ফলে পরিবেশকে বাজেটে শুধু গুরুত্ব দিলেই হবে না। পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও সামগ্রিকভাবে অগ্রাধিকার নিরূপণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে তোলার প্রয়োজন আছে। তিনি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও যুক্তি উপস্থাপন করে, বাজেটটি পরিবেশ দৃষ্টিকোণ থেকে আবারও পুনর্মুল্যায়ন করে, পরিবেশ রক্ষার ওপর জোর দিয়ে এবং প্রতিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব দিতে সরকারের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনার পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনার দিকে।

সভাপতির বক্তব্যে ড. এ. এম. জাকির হোসেন বলেন, পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা ঠিক হবে না। কয়লা, পেট্রোল বা পলিথিন ও প্লাষ্টিক পোড়ানোর ফলে যে গ্যাস তৈরি হয় তা যে শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে তা নয়, তা মানুষের শরীরে ক্যান্সারের অন্যতম একটি কারণ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এসব গ্যাসের বিক্রিয়ার ফলে মানুষের ফুসফুস, রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা, বৃক্ক, যকৃত, মস্তিস্ক, দৃষ্টিশক্তি, স্নরণশক্তি ইত্যাদি রোগাক্রান্ত হয় এবং মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। তিনি বলেন, জিডিপি’র উন্নয়নকে এখন পৃথিবীর কোথাও সামাজিক, আত্নিক ও পরিবেশের উন্নয়ন বলে বিবেচনা করা হয় না।

ড. আতিউর রহমান বলেন, বর্তমানে কোভিড, জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়োডাইভারসিটি গোটা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোভিডকালে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি প্রকৃতি আমাদের কতটা সহায়ক। সরকার প্রকৃতিতে বিনিয়োগ করে কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। বাংলাদেশে প্রকৃতির অন্যতম অবকাঠামো সুন্দরবন বারবার তার বুক এগিয়ে দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করে। তিনি বলেন, ফসিল ফুয়েল ইনভেস্টমেন্ট ইজ এ বেড ইনভেস্টমেন্ট। রিনিউয়েরবল এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট ইজ এ গুড ইনভেস্টমেন্ট। গুড এবং বেড এর মধ্যে যে টেনশন সেটা আমরা কীভাবে মোকাবেলা করছি সে বিষয়গুলো সারা পৃথিবী এখন নজর দিচ্ছে, ফলে আমাদের বাজেটেও সেদিকে নজর দেবার প্রয়োজন আছে বলেও এ সময় তিনি উল্লেখ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটে পঞ্চমবারের মতো পৃথক জলবায়ু বাজেট প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বৈশ্বিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যতম ঝুঁকিতে থাকা দেশটির নাম বাংলাদেশ। সুতরাং এখানে আলাদা করে বাজেট দেবার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে সেটির তিনি প্রশংসা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এটা কতটা সফলভাবে হচ্ছে, কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটা ভিন্ন কথা, কিন্তু এটা একটা রিকগনিশন যে আমরা আলাদা বাজেট দিতে চেষ্টা করছি।

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, মানুষ দুটি দিক থেকে রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে একটি হলো পরিবেশ এবং অন্যটি মানুষের লাইফস্টাইল। সুতরাং মানুষের অসুস্থতার জন্য পরিবেশের বিষয়টি অবজ্ঞা করার কোনো অবকাশ নেই। রোগের নিরাময় করে ঔষধ কোম্পানীগুলো লাভবান হবে কিন্তু রোগকে প্রতিরোধ করতে হলে পরিবেশকে ঠিক রাখার কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।

দেশের পুরোস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন, আমাদের মনোস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে বাজেটের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং চিকিৎসা বর্জ্যের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার দাবি জনান তিনি।

অধ্যাপক আনু মুহম্মাদ বলেন, আমাদের নীতি নির্ধারকদের দর্শনগত পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি দেশের জিডিপি বৃদ্ধি করার আহবান জানান, তবে পরিবেশ, বন, নদী, পাহাড় ধ্বংসের মত প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে নয়। যে সমস্ত প্রকল্পের কারণে দেশের পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস হচ্ছে এগুলো কোনোভাবেই উন্নয়ন প্রকল্প হতে পারে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।তিনি পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মমংস্থান খাতে বাজেট বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন।

শরীফ জামিল বলেন, সরকারের প্রনীত এই বাজেটের মাধ্যমে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সংরক্ষনে দর্শনগত পরিবর্তন প্রয়োজন বলে প্রতিয়মাণ হয়।পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারনে চলমান মানবিক বিপর্যয় যাতে আরো অবনতি না হয় সে জন্য বাজেটে এ মন্ত্রণালয়কে সুপরিকল্পিতভাবে আরো অনেক বেশী বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন ছিল।

ফরিদা আক্তার এ বাজেটে নারী স্বাস্থ্য, শ্রমিকের স্বাস্থ্যের মানোন্নয়ন করা এবং তামাকের উপর কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন।

বিধান চন্দ্র পাল আরো বলেন, এবারের বাজেটে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেকগুলো বিষয়ের সুস্পষ্ট কোনো প্রতিফলন আমরা খুঁজে পাই নি। এসব বিষয়ে বাস্তব পরিকল্পনা বা আর্থিক বরাদ্দও আমরা লক্ষ্য করিনি। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: কৃষি গবেষণায় প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা এবং গবেষণার পরিসর আরও বিস্তৃত করা; উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় অবকাঠামো, কৃষক সংগঠন (এফএফএস), বিপণন সংগঠন, সমবায় সমিতি ও কৃষি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করা; প্রাণী খাদ্য, গবাদি পশুর ঔষধপত্র ও চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস ও সহজপ্রাপ্য করা, সে-সঙ্গে এগুলোর জন্য যাতে ভালো দাম পাওয়া যায়, তার জন্য বাজার-ব্যবস্থা ও বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধার আরও উন্নয়ন করা; জেলা শহর ও মফস্বল শহরে স্থানীয় কাঁচামালভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের গুচ্ছ শিল্পাঞ্চল (ক্লাস্টার ইন্ডাস্ট্রি) গড়ে তোলা, সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার‘ প্রকল্পকে গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি গুচ্ছশিল্প কাঠামোর সাথে সংযুক্ত করা; জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পকে উৎসাহিত করা; এক বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ওপরে সকলকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা; ঢাকার চারপাশের ৪টি নদী এবং খালগুলোকে দূষণ ও দখলমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে নদীতীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা; বিশ্ব উষ্ণায়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা থেকে মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সেই প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা; সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ ও লবণাক্ততা রোধ ও সুন্দরবনসহ অববাহিকা অঞ্চলের মিঠা পানি প্রাপ্তির লক্ষ্যে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া; দেশের বিস্তীর্ণ হাওড় ও ভাটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা ইত্যাদি।

এছাড়া তিনি আরও বলেন, ওয়ান গ্রুপ ইকোনমি থেকে আমাদের মাল্টি গ্রুপ ইকোনমিতে পরিবর্তিত হওয়া প্রয়োজন। এজন্য আমাদের চাষাবাদে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পরিবেশসম্মত বীজ ও ফসল উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সেজন্য গবেষণা ও গবেষণার ফোকাসের পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন বাপা‘র নির্বাহী সহ-সভাপতি এবং জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সদস্য ডা. মোঃ আব্দুল মতিন, ব্রতীর প্রধান নির্বাহি শারমিন মুরশিদ, ডাঃ মাহমুদুর রহমান, ড. মোঃ মাহবুব হাসান মাসুদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ, বাপার বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং মিডিয়া কর্মীরা।