গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনঃ জায়েদার কর্মী-সমর্থকদের সন্ধান মিলছে বিভিন্ন জেলার কারাগারে

আপডেট: মে ২২, ২০২৩
0

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুরঃ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে বলতে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষন করতে ভারত চীনসহ কয়েকটি এ্যাম্বাসীতে চিঠি দিয়েছেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। চিঠিতে প্রতিটি কেন্দ্রে ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ এবং
কুটনীতিকদের মাধ্যমে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করারও অনুরোধ জানানো হয়। ইংরেজীতে লেখা তিন পাতার ওই চিঠি গত রোববার ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের রাস্ট্রদূত ও হাইকমিশনারকে দেয়া হয়েছে। এর আগে সিটি নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন নির্বাচন কমিশন সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ অন্যদের কাছে একই দাবিতে চিঠি দেন। সোমবার মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের ছেলে ও তার নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারী বহুল আলোচিত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জাহাঙ্গীর আলম জানান, নির্বাচনী এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বলার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ জানানোর জন্য কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারকে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে নির্বাচন পর্যবেক্ষন করতেও বিদেশী কুটনীতিকদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা চাই একটা অবাধ, সুষ্ঠু, গঠনমূলক নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনার বলেছেন সুষ্ঠু ভোট করবে, সিসি ক্যামেরা দিবে, ইভিএম-এ ভোট হবে। যার ভোট সে দিবে, যে ভোট পাবে তার নামে ডিক্লিয়ার হবে। আমরাও এটাই চাই। ওনারা যে কমিটমেন্ট করেছে সেটার বাস্তবায়ন চাই।

জানা গেছে, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারকে ইংরেজিতে লেখা তিন পাতার এ চিঠিটি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগসহ কয়েকটি দাবি জানানো হয়েছে। এর আগে সিটি নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন নির্বাচন কমিশন সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ অন্যদের কাছে একই দাবি জানিয়েছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন।

চিঠিতে জায়েদা খাতুন বলেন, ‘আমি জায়েদা খাতুন আসন্ন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে “টেবিল ঘড়ি” প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করছি। আমি গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমের মা। আপনারা সবাই অবগত আছেন যে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আমার ছেলে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নির্বাচিত মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বাতিল করা হয়েছে। আমার ছেলের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার প্রতিবাদ করতে ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি।

তিনি চিঠিতে আরো উল্লেখ করেন, গাজীপুরে আমি আমার নির্বাচনী প্রচারণায় নামলেই লাখো শান্তিপ্রিয় মানুষ আমার প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। আমি ৯ মে প্রতীক পাওয়ার পর থেকে নির্বাচনী আইন অনুযায়ী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রতিপক্ষ প্রার্থী ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান আমাকে নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় বাধা দিচ্ছেন, আমার জনসংযোগে হামলা করছেন এবং আমার নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত পোলিং এজেন্ট এবং সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিচ্ছেন। ব্যক্তিগত গুন্ডা ও প্রশাসনের ছদ্মবেশে বিশেষ পুলিশ পরিচয়ে তাদের ভয় ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।”

চিঠিতে জায়েদা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, ‘অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান তার সন্ত্রাসী লোকজন নিয়ে আমার গণসংযোগের সময় আমার গাড়ীবহরে বাধা দিচ্ছেন এবং তার পক্ষে (নৌকার) উস্কানিমূলক শ্লোগান দিচ্ছেন এবং পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরা অযথা বিভিন্ন স্থানে আমার নির্বাচনী প্রচারণাকে অবৈধভাবে বাধা দিচ্ছে ও হয়রানি করছে। আমি এসব ঘটনা জানিয়ে একাধিকবার নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ করেছি। এ বিষয়ে আমি ১৮ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। সর্বশেষ গত ১৮ মে বিকেলে মহানগরীর টঙ্গীর ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগকালে আজমত উল্লা খানের সন্ত্রাসী বাহিনী আমার গাড়ীবহরকে বাধা দেয় এবং আমার নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত গাড়ীটি ভাঙচুর করে।’

জাহাঙ্গীর বলেন, এসব কারণে ক্থটনীতিকদের দ্বারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং সেনা মোতায়েনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানিয়েছেন মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন।

জায়েদার কর্মী-সমর্থকদের সন্ধান
মিলছে বিভিন্ন জেলার কারাগারে

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা টেবিল ঘড়ি প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের নিখেঁাজ কর্মী-সমর্থকদের সন্ধান মিলছে বিভিন্ন জেলার কারাগারে। সোমবার টেবিল ঘড়ি প্রতীকের সমর্থক ও টঙ্গী পূর্ব থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য রাসেল (৩৪), টঙ্গী ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মোস্তফা হায়দার ওরফে কামাল (৫০) ও ৫০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম ফাত্তা (২২) এর সন্ধান মিলে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে। গত শনিবার রাতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাদেরকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। পরে তাদেরকে রূপগঞ্জ থানার বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের একটি মামলায় নং- ৭২(১১)২২ গ্রেফতার দেখানো হলে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে তাদের ঠাই হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম ফারুক খোকনকে প্রধান আসামী করে বিএনপির ৩৯ নেতাকর্মীর নামে গত বছর ২৮ নভেম্বর রূপগঞ্জ থানায় ওই মামলা দায়ের হয়। অপরদিকে টঙ্গীর ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য সচিব মোা. কামাল হোসেনের সন্ধান মিলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিএনপি নেতাদের নামে রাজধানীর তুরাগ থানার বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের একটি পুরনো মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা কামালকে কারাগারে পাঠানো হয়। গত শনিবার রাত ১১টায় সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা কামালকে টঙ্গীর বড় দেওড়া পরানমন্ডলের টেকের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবারের সদস্যরা জানান।
এদিকে গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করেছিলেন, তাদের কর্মী-সমর্থকদের ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে বিভিন্ন জেলায় রাখলেও তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। নিখেঁাজদের পরিবার পরিজনের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য সচিব ও ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি কামাল হোসেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীরপন্থী হিসেবে পরিচিত। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর কামাল হোসেন প্রকাশ্যে নৌকার ব্যাজ ধারণ করলেও গোপনে জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ি প্রতীকের পক্ষে কাজ করতেন। এদিকে কামালকে গ্রেফতারের ঘটনায় জাহাঙ্গীরপন্থী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নড়েচড়ে বসেছেন। তবে তার গ্রেফতারের ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা গেছে। কামালের গ্রেফতারের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই কামালকে আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতা উল্লেখ করে তাকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ তার গ্রেফতারে দুঃখ প্রকাশ করলেও ‘দুই নৌকায় পা দিলে পরিণতি এমনই হয়’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
এদিকে জায়েদা খাতুনের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম গত শনিবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, তার মা’র টেবিল ঘড়ি প্রতীকের নির্বাচনি প্রচারণায় বাধা দেওয়া ছাড়াও তাদের কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতারসহ বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও হুমকি দেয়া হচ্ছে। টেবিল ঘড়ি প্রতীকের এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়া হচ্ছে। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে যাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের অনেকেরই কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন জেলার কারাগারে নিয়ে রাখা হচ্ছে।
ইতিপূর্বে জায়েদা খাতুনের সমর্থক সন্দেহে গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আরিফ হোসেন হাওলাদারকে আটক করে পুলিশ এবং মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মো. শওকত হোসেন সরকার, মহানগর বিএনপি নেতা মাহবুবুল আলম শুক্কুর, জিএস জিয়াউল হাসান স্বপনসহ বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর বাসায় কয়েক দফায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। গাসিক নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদার পক্ষে তারা ভূমিকা রাখতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকেই এ ধরপাকড় ও তল্লাশি চলছে বলে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন। এদিকে এসব ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এতে অনেকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে বলছেন, ‘খেলা হচ্ছে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ।’ অথচ হয়রানি করা হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে। এদিকে মহানগর সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান, ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মো. রাজীব ও কোনাবাড়ি থানা বিএনপির মৎস্য বিষয়ক সম্পাদক মো. আসলাম মিয়ার এখনো কোনো সন্ধান মিলছে না বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন।

###
মোঃ রেজাউল বারী বাবুল
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।
২২/০৫/২০২৩ ইং।