চোখের জল ফেলে ক্ষমা চাইলেন মেয়র জাহাঙ্গীর, দলের সিদ্ধান্তের রিভিউ করবেন

আপডেট: নভেম্বর ২০, ২০২১
0

গাজীপুর প্রতিনিধিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার দায়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সদ্য বহিষ্কৃত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তার বহিষ্কারাদেশ পুনঃবিবেচনা করার জন্য আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট দাবি জানিয়েছেন। তিনি তার অপরাধের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এসময় তিনি চোখের জল ফেলে নগরবাসীর কাছেও ক্ষমা চেয়েছেন। শনিবার দুপুরে মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তার বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

শনিবার সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে শতশত দলীয় নেতাকর্মী ও শুভান্যুধ্যায়ী ছয়দানাস্থ মেয়রের বাসভবনে সামনে জড়ো হতে থাকে। তারা মেয়রের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকে। বেলা একটার দিকে মেয়র নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে ভবনের নীচতলায় নেমে আসলে নেতাকর্মীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এসময় পুরো বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। মেয়রও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। পরে মেয়রের ছোট ভাই ও মা মেয়রকে সান্তনা দিয়ে বাসার উপরে নিয়ে যান। এরপর কিছুটা স্বাভাবিক হলে মেয়র জাহাঙ্গীর সাংবাদিকদের অনুরোধে বাসার নীচতলায় নেমে এসে তার বহিস্কার সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

এসময় মহানগর আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ মজিবুর রহমান, বন ও পরিবশে বিষয়ক সম্পাদক মোঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাউন্সিলর মোঃ রফিকুল ইসলাম, সদস্য কাউন্সিলর আজিজুর রহমান শিরিশ, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান তরুণ, সহ দপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রুহুল আমীন, কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম, মাওলানা মনজুর হোসেন, মহানগর শ্রমিকলীগের আহবায়ক আঃ মজিদ বিএসসি, মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, মহানগর কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর আঃ কাদির মন্ডল, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক সুমন আহমেদ শান্ত বাবু, মহানগর মহিলালীগের সভাপতি সেলিনা ইউনুস, সাধারণ সম্পাদক ফাহিমা আক্তার হোসনা প্রমুখ কাউন্সিলর ওবিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আবেগ তাড়িত কন্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুর মহানগরীতে আওয়ামীলীগকে একটি শক্ত ভিতের উপর আমি দাঁড় করিয়েছি। গাজীপুরকে আওয়ামীলীগের ঘাঁটি হিসেবে তৈরী করেছি। আমি ছাত্রলীগ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করি। পরবর্তীতে আমাকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। ছাত্র জীবন থেকেই একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। পরবর্তীতেও তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র থেমে থাকে নি। ২০১৩ সালের পর থেকে কিছু লোক আমাকে মারার জন্য এবং বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আমাকে আমার পরিবারকে এবং আমার সমর্থনে যারা আছে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আমার পিছনে সব সময় লেগেছিল। তারই অংশ হিসেবে আমার ঘরের ভিতরে বসে তিন ঘন্টার আলাপচারিতাকে খন্ড খন্ড করে ও সুপার এডিট করে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের ভিডিও এবং অডিও করে ইন্টারনেটে ভাইরাল করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা আমার সম্পর্কে ভুলভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। যাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আর যেতে না পারি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছিলাম আমার কথা বলার জন্য। করোনার কারণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। আমি যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই অডিও ও ভিডিও’র বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে পারতাম তাহলে প্রধানমন্ত্রী সবকিছু বুঝতে পারতেন। উনার কাছে সঠিক তথ্য গেলে আমি সত্য ও ন্যায় বিচার অবশ্যই পেতাম। তখন তিনি হয়তো আমার ব্যাপারে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেন না। তাই তিনি দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে রিভিউ করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।

এসময় তিনি তার আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ ফিরে পাবার আকুতি জানিয়ে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা মাথা পেতে নিব। আমি কোন পাপ বা অন্যায় করি নি, অপরাধ করি নি। তবে মানুষের ভুল হয়। আমারও ভুল হতে পারে। আমি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন আমার বহিস্কারাদেশ পুনঃর্বিবেচনা করেন এবং শহর গড়ার জন্য যেন আমাকে সহযোগিতা করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেন বিবেচনা করে। আমি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বা কোন পদ চাইনা, আমি বাকি জীবন আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ সদস্য ও সমর্থক হয়ে থাকতে চাই।

মেয়র জাহাঙ্গীর বলেন, আমার অস্তিত্ব ও প্রাণের মধ্যে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমার অস্তিত্বের মধ্যে সব জায়গায় আমার প্রধানমন্ত্রী একটি আদর্শের জায়গা, মায়ের স্থান। তিনি আমার অভিভাবক হিসেবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমি মাথা পেতে নেব। তিনি যদি আমাকে বিনা দোষে বিনা কারণে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে বলেন আমি তা করতে রাজি আছি।

তিনি বলেন, আমাকে যদি মনে হয় গ্রেফতার করবেন বঙ্গবন্ধুর জন্য এবং আওয়ামী লীগের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য যদি আমার জীবন দিতে হয় আমাকে বলবেন আমি আত্মসমর্পন করবো। আমাকে যেন কোন মিথ্যার সঙ্গে জড়িত না করা হয়। আমার পক্ষ থেকে কোন আইনজীবী নিয়োগ করবো না। আমাকে ফাঁসি দেওয়া হোক বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার নেত্রীর জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য তাতে আমার কিছু আসে যায়না। কিন্তু মিথ্যা অপবাদ যেন না দেওয়া হয়। আমার মা আছে, সন্তান আছে, আমার আওয়ামীলীগ আছে, আমার সমর্থিত লোকজন আছে, শহর আছে। আমার শহরের মানুষ যেন কোনভাবে অপবিত্র না হতে পারে এ জন্য তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

মেয়র আরো বলেন, ছাত্রজীবন থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ লালন করে বড় হয়েছি। আমার অস্তিত্বজুড়ে আওয়ামীলীগ। আমি আওয়ামীলীগের একজন সমর্থক হিসেবে কাজ করে যেতে চাই। আমি কলেজ, জেলা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০৮ সালে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগ আমাকে মনোনয়ন দেয়। বিপুল ভোটে আমি ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হই এবং ২০১৭ সালে আমাকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাননীয় নেত্রী আমাকে দায়িত্ব দেন। আমি ২০১৮ সালে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতিক নিয়ে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হই।

তিনি বলেন, গাজীপুর সিটিতে কোন রাস্তাঘাট ছিলনা। আমি প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক সহযোগিতায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনে প্রথম পর্যায়ে ৩২ হাজার বাড়ি ঘর, দোকানপাট, কবরাস্থান, মসজিদ ভেঙ্গে মানুষ রাস্তার জন্য জমি দিয়েছে এবং আট হাজার বিঘা জমি আমি স্থানীয় মানুষের কাছে চেয়ে চেয়ে নিয়ে এলাকায় রাস্তা-ঘাট ও ড্রেন নির্মাণ করেছি। স্থানীয় কাউন্সিলর ও আওয়ামীলীগের নেতাদের সহযোগিতায় আমি নগরীতে প্রায় আটশত কিলোমিটার রাস্তা এবং ড্রেন করতে সক্ষম হয়েছি।

এসময় তিনি বলেন, এ নগরবাসীদের রাস্তা করার জন্য আট হাজার বিঘা জায়গা নগরবাসীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। আট’শ কিলোমিটার রাস্তা প্রায় সমাপ্তির পথে নিয়ে এসেছি। উন্নয়ন কাজের জন্য নগরবাসী প্রায় ৩২ হাজার বাড়ি-ঘর ও দোকানপাট নিজেদের উদ্যোগে সরিয়ে নিয়েছেন। সেজন্য আমি নগরবাসীর কাছে ক্ষমা চাই। এ রাস্তাগুলো আমার ব্যবহারের জন্য নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করতে। সেই উদ্যোগে আমি কাজটি শুরু করেছিলাম।

তিনি বলেন, গাজীপুরে হাজার হাজার মিল কারখানা রয়েছে। কোন একটি কারখানাতে একটি টাকাও কোনদিন চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেনি। আমি সবাইকে নিয়ে একটি বাসযোগ্য শহর করার জন্য কাজে হাত দিয়েছিলাম। আমার শহরের মানুষ যেন ভাল থাকে। আমাকে ফাঁসি দেন তাকে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমার আওয়ামীলীগের যারা নেতাকর্মীরা আছেন যারা দীর্ঘ দিন আমার সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের কোন যেন কোন ক্ষতি করতে না পারে। আমার উপর মিথ্যা গভীর ষড়যন্ত্র করেছে।

বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় এখানে একটি হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
এদিকে জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে দলের সিদ্ধান্তকে তার অনুসারীরা মেনে নিতে পারছেন না। তারাও নেত্রীর কাছে সিদ্ধান্তটি পূনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে।

প্রসঙ্গতঃ গত ২২ সেপ্টেম্বর মেয়র জাহাঙ্গীরের একটি ঘরোয়া আলোচনার একটি রেকর্ড ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এর একটি অংশ ছিল ভিডিও, একটি অংশ ছিল অডিও। আলোচনার রেকর্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর আওয়ামী লীগের একটি অংশ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দলীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে বিক্ষোভে নামে। সেসময় মেয়র ছিলেন দেশের বাইরে। ফেসবুকে রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ার পর মেয়র জাহাঙ্গীরের শাস্তির দাবিতে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে গাজীপুর ছিল উত্তপ্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে গত ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরের ব্যাখ্যা চায় আওয়ামী লীগ। এতে তাকে ১৫ দিন সময় দেয়া হয়। ১৮ অক্টোবর সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই মেয়র তার ব্যাখ্যা দেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সঙ্গে তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়।
####

মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে
বহিষ্কার করায় খুশি দলীয় নেতা কর্মীরা –আজমত উল্লাহ খান

গাজীপুর প্রতিনিধিঃ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করায় দলীয় নেতাকর্মীরা খুশি হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে নিজের মনগড়া বক্তব্য দিয়ে জাহাঙ্গীর যে অপরাধ করেছে, সেই অপরাধের শাস্তি সে পেয়েছে। এতে আমরা আওয়ামী পরিবারের লোক, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক খুশি। শুধু গাজীপুরের নয়, সারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের লোক খুশি। এ সিদ্ধান্তের জন্য আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সকল সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। এই দলের একটি গঠনতন্ত্র রয়েছে। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগে অতীতেও কোনো বিভাজন ছিল না, এখনও নেই। জাহাঙ্গীরের ওই বক্তব্যের পর তাদের অন্তরে জ্বালা ছিল। গাজীপুরের মানুষ দলের এই সিদ্ধান্তে আনন্দিত।