জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার : মির্জা ফখরুল

আপডেট: আগস্ট ৪, ২০২৪
0

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছে তা উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, দেশে আজ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

রোববার (৪ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা আশ্রয় নিয়েছে তা উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা পাখি শিকারের মতো নির্বিচারে গুলি করে লাশের পর লাশের পর লাশের স্তুপ সৃষ্টি করেছে, ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়েছে, হাজার হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন। সরকার তাদের এই বর্বরতা আড়াল করতে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে কিছু স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে, এর দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।’

‘এজন্য মিথ্যা অভিযোগে নিরীহ ছাত্র-জনতার সাথে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনসহ অন্যান্য বিরোধী দলের সিনিয়র নেতা, কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আটক করা হয়। আটকাভিযান এখনো চলছে। আন্দোলন দমাতে সান্ধ্য আইন দিয়ে, সেনাবাহিনী নামিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সান্ধ্য আইনের মধ্যে রাতে বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড দিয়ে নিরীহ ছাত্রসহ বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা কয়েছে। আটক করতে গিয়ে বাসাবাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ছাত্র ও নেতাকর্মীদের পরিবার-পরিজনের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে। আসবাবপত্র ভাঙচুর এবং টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে না পেয়ে তাদের বাবা, ভাই ও অন্যান্যদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। চলছে গ্রেফতারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজি,’ বলেন মির্জা ফখরুল।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ আড়াল করতেই তথাকথিত তৃতীয় পক্ষ আবিষ্কারের জন্য সরকারের বিরামহীন এই প্রচেষ্টা চলছে, যা জনসাধারণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।’

সরকার প্রথম থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের যৌক্তিক দাবি অস্বীকার করে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশকে ধ্বংস ও নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে গেছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলন বলপূর্বক দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে চলছে নজিরবিহীন তৎপরতা। দেশে আজ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। চারিদিকে শুধু অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। এর সম্পূর্ণ দায় রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ আওয়ামী লীগ সরকারের।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে গণহত্যা, নৈরাজ্য, ধ্বংস, দমন-নিপীড়ন দেখে সারাবিশ্ব স্তম্ভিত। সরকার ছাত্র-যুবক, শিশু-নারীসহ জনতাকে নির্বিচারে নির্দয়ভাবে হত্যা করে মানবতাকে হত্যা করেছে। সরকারের মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয়েছে। দেশ-বিদেশে সরকার ধিকৃত ও ঘৃণিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেশের সকল মানুষ এবং গণতন্ত্রকামী বিশ্ব গণহত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং আটক নেতা-কর্মীসহ নিরীহ ছাত্র-জনতাকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানালেও সরকার কূটকৌশল করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।’

‘এসব দাবিতে ছাত্র-জনতার কর্মসূচি বানচাল করতে সরকার আবারো নিরাপত্তা বাহিনীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদেরকে ছাত্র-জনতার ওপর লেলিয়ে দিয়ে আরো হত্যা, নির্যাতন, দমন, নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। যার ফলে সমগ্র দেশ আজ অগ্নিগর্ভ। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সকল জনপদ ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ-বিদ্রোহে মুখরিত। সমগ্র দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক, আইনজীবী, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শ্রমজীবী মানুষসহ ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে শামিল হয়ে গণজাগরণের সৃষ্টি করেছে। গড়ে উঠেছে অভাবনীয় জাতীয় ঐক্য, জনগণের ঐক্য। সমগ্র দেশ আজ গণহত্যাকারী সরকারের বিরুদ্ধে একাট্টা। গ্রাম ও শহরের ঘরে ঘরে আর্তনাদের সাথে উচ্চারিত হচ্ছে খুনী সরকারের পদত্যাগের দাবি।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গতকাল এক দফা দাবি অর্থাৎ স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগের দাবি সম্বলিত এক দফা ঘোষণাপত্র উত্থাপন করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আগে থেকেই গণতন্ত্র হত্যাকারী, ভোটাধিকারসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণকারী, জাতীয় স্বার্থ বিপন্নকারী, জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী লুটেরা দুর্নীতিবাজ আওয়ামী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। সেই আন্দোলনও দমন করতে সরকার হত্যা, গুম, দমন, নিপীড়নের স্টিমরোলার চালিয়ে ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসন কায়েম করেছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তথা আপামর জনসাধারণের উত্থাপিত এক দফা ঘোষণাপত্রের সাথে সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করছে। বিএনপি জাতির এই চরম ক্রান্তিলগ্নে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গণতন্ত্র প্রিয় আপামর জনসাধারণ এবং বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি রাজপথে নেমে এসে ছাত্র-জনতার সাথে একাত্ম হয়ে গণহত্যাকারী স্বৈরাচারী সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে অসহযোগ আন্দোলন সফল করার আহ্বান জানাচ্ছে। শত শত শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইনশাআল্লাহ ছাত্র-জনতার বিজয় অবশ্যম্ভাবী।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তীব্র গণআন্দোলনে পতন অবশ্যম্ভাবী জেনে আওয়ামী লীগ আবার সংঘাত, সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে। গতরাতে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে কারাগারে আটক বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ডা: শাহাদাত হোসেন, বর্তমান আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর চট্টগ্রামের বাড়িতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশারফ হোসেন, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যরিস্টার মীর হেলাল, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক ব্যরিস্টার রুমিন ফারহানার ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়, মিরপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের পারিবারিক রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালিয়ে ভাংচুর করে। সন্ত্রাসীরা রুমিন ফারহানাকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তার বাড়ির আশপাশে অন্যান্য বাড়িতেও সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আমিনুল হকের রেস্টুরেন্টে লুটপাট করে। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।’

‘এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ গতরাতে সন্ত্রাস চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আমরা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী তৎপরতার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলতে চাই, এসব করে তারা সরকারের পতন ঠেকাতে পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘দেশে আজ এক গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছে। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাঈদ, মুগ্ধসহ শত নিরীহ ছাত্র, শিশু ও জনতার রক্তে অবৈধ শাষকগোষ্ঠীর হাত রঞ্জিত হয়েছে। জনগণ এই ভয়াবহ গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় বেরিয়ে আসছে। ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী, চাকরিজীবী, মা-বোন, পিতা-মাতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক আজ এক কাতারে। দলমত, বয়স, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ ফুলে উঠেছে ক্রোধে। দ্রোহের মিছিলে শরীক হচ্ছে সকল স্তরের সকল শ্রেণীর সকল বয়সের মানুষ। আমি তাদের অভিবাদন জানাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘গতকাল শহীদ মিনারে জনতার উত্তাল সমুদ্রে সামনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা এই অবৈধ খুনি সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেছেন এবং অবিলম্বে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন। দেশের সকল মানুষ এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।’

‘আমরা ২০১২ সাল থেকে এই সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করে আসছি। অবৈধ সরকার ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে চিরস্থায়ীভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। দেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো ধ্বংস করেছে নজীরবিহীন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। এখন ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবি- কোটা ব্যবস্থায় যৌক্তিক সংস্কারের আন্দোলনকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে গিয়ে শত শত তাজা প্রাণের রক্ত ঝরিয়েছে, শত শত মায়ের বুক খালি করেছে, শত সন্তানরা পিতাকে হরিয়েছে। এমনকি চার বছরের শিশুও রেহাই পায়নি। গণহত্যার মাধ্যমে ছাত্রদের আক্রমণকে দমন করতে ব্যর্থ হয়ে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যের মধ্য দিয়ে যে চূড়ান্ত আন্দোলন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত, তাকে স্তব্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে ছাত্রদের এই যৌক্তিক, ন্যায়সঙ্গত, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছি। আজ আমারা তাদের নতুন ঘোষণাকে সমর্থন জানাচ্ছি এবং এই ভয়াবহ দানবীয় খুনী শাসকগোষ্ঠীর পতনের লক্ষে সকল রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি, পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষকসহ আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই অবৈধ খুনী হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’