জলবায়ু অর্থায়ন বরাদ্দে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থাক কেন্দ্রবিন্দুতে

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১
0

একশনএইড বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। এর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় তা বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় খুবই অপ্রতুল। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন ও লস এন্ড ডেমেজের মত বিষয়গুলো জলবায়ু বাজেটে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া নারীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বৈষম্যমূলক প্রভাব সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে খর্ব করে। কার্যকর জলবায়ু কর্ম পরিকল্পনা তৈরিতে অবশ্যই লৈঙ্গিক বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। জেন্ডারভিত্তিক বাজেট নিয়ে সরকারী মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ধারণা আরো বাড়াতে হবে। জেন্ডার সংবেদশীল জলবায়ু বাজেট নিয়ে গভীর জ্ঞান ও প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী।

একশনএইড বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত ‘স্টেকহোল্ডার কনসাল্টেশন অন বাংলাদেশ ক্লাইমেট বাজেট (২০২১-২২)’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক, আলোচক, সাংবাদিক এবং স্টেকহোল্ডাররা মঙ্গলবার দুপুরে (১৪ সেপ্টেম্বর) এসব কথা বলেন।

এ ওয়েবিনারে প্যানেলিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. মিজান আর খান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি ফেরদৌসি বেগম, একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির।

এই ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু বাজেট বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন যেখানে জলবায়ু ব্যযের প্রাসঙ্গিকতা এবং কার্যকারিতা বোঝার জন্য বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। এসময় গত বছরের তুলনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য জলবায়ু বাজেট বরাদ্দ কমে যাওয়ায় তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের ২৫টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের জন্য ৮ শতাংশেরও কম বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মোট জাতীয় বাজেটের ৫৭.৩৩ শতাংশ অর্থাৎ ২৫,১২৪. ৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্যে অপারেটিং বাজেটের অধীনে ১০,২৮৬.১৭ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন বাজেটের অধীনে ১৪.৮৩৮.৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গত বছরের বরাদ্দের তুলনায় চলতি অর্থবছরের বাজেট ৭.৪৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৭.২৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ হয় ৩৭৯.২১ কোটি টাকা যা গত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৯.৮৩ কোটি টাকা কম। তাছাড়া আগের বছরের তুলনায় বাজেটে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৪২৭.১৯ কোটি টাকা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ১১৩.৩২ কোটি টাকা কমেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু হবার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে জলবায়ু অর্থায়ন কমে যাবে বলে আশংকার কথা বলেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট এর প্রফেসর ড. মিজান আর খান। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু অর্থায়নের ৮৫ ভাগ বরাদ্দ আসে স্থানীয় খাত থেকে তাই স্থানীয় খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। একইসাথে নিজেদের টাকা কিভাবে খরচ হচ্ছে তা সচ্ছতা ও জবাবদীহিতার মধ্যে রাখতে হবে। ন্যাশনাল এডাপটেশন প্লান স্থানীয় ও আঞ্চলিকভিত্তিতে বাস্তবায়ন করাই সমীচীন। জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে বলেও তিনি জানান। জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে তাই লস এন্ড ডেমেজ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। তাছাড়া দেশের জনমিতির লভ্যাংশকে কাজে লাগানোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার যুব সমাজকে প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধম্যে জনশক্তি রপ্তানি করা যেতে পারে বলে তিনি অভিমত দেন। পাশাপাশি সুশীল সমাজ কে এই ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের আহবান জানান তিনি।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি ফেরদৌসি বেগমের অভিমত যে কোন দূর্যোগে নারী ও শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই আমাদের চেষ্টায় আছে কিভাবে নারী ও শিশুবান্ধব বাজেট প্রনয়ণ করা যায়। উঠান বৈঠক, কর্মশালা ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের সাথে জনমত ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ে। এসময় তিনি সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জলবায়ু সংকট নিরসনে এগিয়ে আসার কথা বলেন।

একশনএইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, এটা সত্যি আমরা এখন করোনা, জলবায়ু ও অর্থনীতি এমন ত্রিমুখী সংকটের মধ্য দিয়ে আমাদের সময় পার করছি। অথচ এখনো জলবায়ু অর্থায়নে বিশ্ব জুড়ে নেতৃত্ব, ঐক্যমত, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, বিনিয়োগ ও বরাদ্দের বড় ফাঁক রয়ে গেছে। যেকোন প্রকল্পে শুরুতেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মাথায় রেখেই করতে হবে। সবার আগে আমাদের উন্নয়ন নারী ও যুব বান্ধব কি না সেটি বিবেচনা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আগামীতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করে পরিকল্পনামাফিক কাজ করার অনুরোধ জানান তিনি।

সামনে আমাদের পানি সংকটসহ আরো অনেক ধরনের সংকটের সম্মুখীন হতে হবে এমন আশংকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন নেই এটা বলে চোখ বন্ধ করা যাবে না। এখন থেকেই কিভাবে পানি, বৃষ্টি, ভূমি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় সেটা ভাবতে হবে। বাজেটে বরাদ্দ আছে তবে যে প্রকল্পে বরাদ্দ সেখানে ব্যয় হচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সরকারকে নতুন করে অতিরিক্ত অর্থায়ন করার আহবান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে আলোচকরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ডিজিটাল রিস্ক ম্যাপিং, ইনডেক্স তৈরি, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা এবং মানবাধিকার বিষয়সহ জনগণের মতামতকে প্রধান্য দেওয়ার কথা বলেন। তাছাড়া ঝুঁকি মোকাবেলায় অভিযোজন ও সাম্যবস্থা নিশ্চিত করতে সকলকে আরও বেশি মনোযোগী ও একটি যৌথ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে নীতি নির্ধারকদের সমবেতভাবে কাজ করার আহবান করেন। ####