জাসদ, বিএলএফ এবং ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর

আপডেট: নভেম্বর ৬, ২০২১
0

লায়ন আনোয়ার হোসাইন উজ্জ্বল : ৭ নভেম্বরের ‘ইতিহাসের মাইন ফিল্ডে হাঁটলে যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত জাসদ যা করেছে, ইতিহাস বলবে, তা সঠিক, নাকি ভুল ছিল। সেই সময় বিপ্লবে ২০ হাজার লোক মারা গিয়েছিল। ‘মুক্তিযুদ্ধের পরে যেন প্রতিবিপ্লব না হয়, এ জন্য বিএলএফ গঠন করা হয়েছিল বলে মতদেন কিছু নেতা।

১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয় ঐ মামলায় কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয় । মেজর জলিলের ২০ বছর তথা যাবজ্জীবন এবং আ স ম আবদুর রবের ১৪ বছর কারাদন্ড হয়। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাকে আওয়ামী লীগে ফেরত আনা হয় এবং তার অসাধারণ বাগ্মীতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

“যখন জাসদের ঠিকুজির নিকুচি করা হচ্ছে তখন মূল সভাপতি কোনো কথা বলছেন না। বলছেন কার্যকরী সভাপতি!!! অথচ যেদিন গণবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, সেদিন এই কার্যকরী সভাপতি চট্টগ্রামের নেতা। বাংলাদেশের মতো সমতল ভূমির একটি দেশে যাকে সাপোর্ট দেয়ার মতো কোনো প্রতিবেশী দেশও নেই সেখানে গেরিলাযুদ্ধ কীভাবে সম্ভব, এ প্রশ্ন যখন দলের কেন্দ্রীয় ফোরামের প্রায় সবাই তুলেছিলেন তখন হাসানুল হক ইনু সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে গণবাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। তাকে গণবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ডার বানানো হয়েছিল। কর্নেল তাহের ছিলেন এক নম্বর নেতা। সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা সেদিন সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মূল নেতা হিসেবে মুখ্য ছিল না। ১৭ মার্চ ১৯৭৪ মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাওয়ের পর গণ আন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে তাকে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরের বক্তব্যের সঙ্গে যদিও তিনি একমত ছিলেন (যা জাসদের মূল গণ-লাইনের পরিপন্থী ছিল), কিন্তু পরবর্তীতে কয়েকবার তিনি গণসংগঠন বাদ দিয়ে গণবাহিনীতে যোগ দেয়ার বিরোধিতা করেছেন।
গণবাহিনী গঠিত হয় ‘৭৪ সালে। তখন মুজিব বাহিনী নামে কোনো সংগঠন দেশে ছিল না। ওটা তো যুদ্ধশেষেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর গণবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার কর্নেল তাহের তো মুজিব বাহিনীতে ছিলেন না।
ছাত্রলীগের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব তো আগেই ছিল। স্বাধীনতার পর তাই ছাত্রলীগ ভেঙ্গে যায়।

গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ।
দেশের অন্যতম দল হিসেবে জাসদ এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং আজকের মতোই সেই আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে তখনকার সরকার। জাসদ নেতা মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রবের ওপর হামলা চালানো হয়। পথিমধ্যে তাদের গাড়িতে চালানো হয় গুলী। সরকারি বাধার মুখে আন্দোলনের পথগুলো রুদ্ধ হয়ে যেতে থাকে। এর কফিনে শেষ পেরেক মারা হয় ‘৭৪ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবনের সামনে জাসদের অবস্থান কর্মসূচির ওপর গুলীবর্ষণ করে বরিশাল বিএম কলেজের জিএস জাফরসহ অনেককে হত্যা করে। গ্রেফতার করা হয় মেজর জলিল এবং আ স ম আবদুর রবকে।

চূড়ান্ত হতাশা নেমে আসে জাসদ নেতা-কর্মীদের মাঝে। সরকার যদি গণআন্দোলন করতেই না দেয়, তাহলে বিকল্প আর কী খোলা থাকে ? মাত্র আড়াই বছর আগে যুদ্ধের ময়দান থেকে উঠে আসা জাসদের তারুণ্যে, যৌবনে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। গঠিত হয় গণবাহিনী।
এখনো চলছে বিরুদ্ধবাদী যে কোনো কিছুকে দমন করার সর্বাত্মক সাঁড়াশি আক্রমণ। এ জন্যই সরকারের তল্পিবহন করা সত্ত্বেও জাসদকে রেহাই দেয়া হচ্ছে না। তার ঠিকুজি উদ্ধার করা হচ্ছে। এবং সেটা করছে ‘ অদ্ভুত ”এক বিরোধী দল। কিন্তু জাসদ কী করছে ? খণ্ডিত হতে হতে এখন জাসদের একটি অংশ বহুকষ্টে সংসদে ঢুকে গেছে, সরকারে শরিক হয়েছে। আওয়ামী ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে তাদেরই প্লেট ফুটো করতে কি পারেন তারা ?
২০ হাজার লোক মারা গিয়েছিল, কিভাবে ? অসুখ – বিসুখে মারা যাওয়ার কথা নিশ্চয়ই বলেননি তিনি। কিন্তু এর বেশি সাহসী হতে পারেননি তিনি। কারণ তখন আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদসহ অন্যরা তাকে গণবাহিনী নিয়ে কথা বলতে বলছেন।

মুক্তিযুদ্ধ কালে যারা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ এর সদস্য ছিলেন তাদের তালিকা প্রকাশ করা হোক। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিএলএফ এর অপর নাম হলো মুজিব বাহিনী। সেদিন শুধু জাসদ এবং গণবাহিনীই নয়, সেদিন অর্থাৎ ১৯৭২-১৯৭৫ সালে বিরোধী দলের ২০ হাজার নেতা কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।

“১৯৭৩ সালের নির্বাচনের ছয় মাস পরে ১ সেপ্টেম্বর ৭৩ এক প্রচারপত্রে জাসদ বলে, “ভারতের ৭৫ টি বিড়লা টাটাদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও বর্তমান সোভিয়েতের ব্রেজনেভ কোসিগিন প্রতিক্রিয়শীল চক্রে’র প্রতিনিধি শেখ মুজিবের ‘ফ্যাসিস্ট জাতীয় বিশ্বাসঘাতক সরকারকে উৎখাত করার জন্য, ঘুণে ধরা এই সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নূতন সমাজের ভিত রচনা করার জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করবো।” এ জাতীয় বিবৃতির ভাষায় সরকারের প্রতি যেমন সাধারণ মানুষের ঘৃণার সৃষ্টি হতো, তেমনি বোকা সরল গোছের অনেক তরুণ মনে করত, রুশ বিপ্লব ও চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেয়ে বড় কোনো বিপ্লব এল বলে এবং মুজিবের পতন আসন্ন।

মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ‘ সরকারের উৎখাত দাবি করে ১৯৭৪-এ জাসদ এক প্রচার পত্রে ঘোষণা করে, “ফারাক্কা বাঁধ প্রশ্নে শেখ মুজিবচক্রের “ মেনিমুখো” নীতি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্নে এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আগামী অক্টোবরে কিংবা নবেম্বরে ফারাক্কা বাঁধ চালু হলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ক্রমেই মরুভূমিতে পরিণত হবে।
১৫ নবেম্বর ১৯৭৫ জাসদ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানায় এই বলে, “১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে যেয়ে এবং ১৯৭২ সালের মে মাসে শেখ মুজিবের ভারত-রাশিয়া ঘেঁষা আত্মঘাতী নীতি বিরোধিতা করায় আমাদেরকে জেল জুলুম সহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। …

সত্যিকারের “জনতার গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠাকল্পে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করা হয়। সরকারী কার্যকলাপ প্রতিরোধের জন্য আমরা খুবই গোপনে অথচ তৎপরতার সাথে গড়ে তুলি সারা দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, প্রাক্তন সৈনিকদের সমবায়ে “বিপ্লবী গণবাহিনী”।

দেশ ও জাতির সামনে জাসদ তিনটি মারাত্মক প্রশ্ন উত্থাপন করে। তার প্রথমটির ভাষা, “ভারত-রাশিয়া-আমেরিকা বিশেষ করে ভারতের আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে আমরা গোটা দেশ ও জাতি রুখে দাঁড়াব কি না ? তারপর তারা আট দফা ‘কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জঙ্গি জাতীয় ঐক্য’ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তার প্রথম দফা: ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে “জনতার প্রতিরক্ষা কমিটি” গঠন করতে হবে যেন কোনো ভারতীয় চর, চোরাচালানী ও পাচারকারী এ দেশের মাটিতে পা ফেলতে না পারে। এক হাজার সাত শ শব্দের ‘আহ্বান’ শেষ হয়েছিল ‘ খোদা হাফেজ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগানে।
তাহেরের ফাঁসির দুই মাস আগে ‘জাসদ ও বিপ্লবী গণবাহিনী’ থেকে দেশবাসীর প্রতি যে আহ্বান জানানো হয়, তার শিরোনাম: ‘ভারতীয় হামলা রুখে দাঁড়াও: গ্রামে – গঞ্জে, শহরে – নগরে প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোল’ / ‘বিপ্লবী গণবাহিনী ও বিপ্লবী সিপাহীরা এক হও।’ ওই ইশতেহারে একটি ১২ দফা দাবি জানানো হয়েছিল। তার প্রথম দফা: ‘ভারতীয় আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে শহরে – নগরে, গ্রামে – গঞ্জে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ১২ নম্বর দাবি: ‘ভারত – রাশিয়া – আমেরিকা বিশেষত ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমস্ত গোপন ও অসমচুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। শেষ হয়েছিল ‘বিপ্লব অনিবার্য। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ কথা দিয়ে। জাসদের ৭০ দশকের অবস্থান এবং আজকের অবস্থানের মধ্যে কি আসমান জমিন ফারাক। অন্য কোনো দল এরকম সম্পূর্ণভাবে চোখ উল্টায়নি । জাসদ সম্পর্কে লিখতে হলে আরো অনেক কথাই লিখতে হয়। কিন্তু স্থানাভাবে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তবে যেসব তথ্য ওপরে পরিবেশিত হল সেখান থেকে একথাটি পরিষ্কার যে নীতি আদর্শকে তারা সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়েছে। এরা যখন অন্যদেরকে মাইনাস করার কথা বলে তখন তারা বোঝে না যে ইতোমধ্যেই তারা মাইনাস হয়ে বসে আছে।

১৯৭৫ পরবর্তী মেজর জিয়াউর রহমান

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপরে ঐ বছরের ২৫শে আগস্ট জিয়াউর রহমান চিফ অফ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। ঐ বছরের ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর জিয়াউর রহমানকে চিফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়, যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এবং জিয়ার প্রতি অবিচার করায় ক্ষুব্ধ সেনাসদস্যরা ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতা আরেক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় এবং জিয়াউর রহমানকে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসে। ঐ দিন সকালেই পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় শেরে বাংলা নগরে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত ১০ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে ক্ষুব্ধ জোয়ানদের হাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম,কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লেঃ কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম নিহত হয়।

১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হবার ১০ দিন পর জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপরে ঐ বছরের ২৫শে আগস্ট জিয়াউর রহমান চিফ অফ আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন।ঐ বছরের ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর জিয়াউর রহমানকে চিফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়, যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এবং জিয়ার প্রতি অবিচার করায় ক্ষুব্ধ সেনাসদস্যরা ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতা আরেক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় এবং জিয়াউর রহমানকে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসে। ঐ দিন সকালেই পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় শেরে বাংলা নগরে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত ১০ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে ক্ষুব্ধ জোয়ানদের হাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম,কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লেঃ কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম নিহত হয়।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান

১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চিফ অফ আর্মি স্টাফ পদে নিযুক্ত করা হয় এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চিফ অফ আর্মি স্টাফ পদে দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়[২৪] তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশে পদক প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমের উত্তরসূরি হিসেবে ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন

“ I will make politics difficult for the politicians.”

১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপিল দাখিল করায় ও তার আপিল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হ্যাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ

জিয়াউর রহমান এবং স্ত্রী খালেদা জিয়া, ১৯৭৯
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রদান করে তা জনপ্রিয় করে তোলেন। বাংলাদেশে বহু সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের মতের ও ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন একে অপরের থেকে ভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান।

আইন শৃঙ্খলা
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। ‍সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেন। ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও জিয়াউর রহমানকে বেশ কয়েকটি সেনা-বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবেলা করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।

বহুদলীয় গণতন্ত্র
নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং অবাধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতির গণতন্ত্রায়ণে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এইভাবে, তিনি সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং রাষ্ট্রপতির পদে নিয়োজিত থাকেন।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এই দলের চেয়ারপারসন (Chairperson)। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়ার এই দলে বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোক ছিলেন। বিএনপির সব থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি। প্রায় ৪৫% সদস্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন।

জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহবায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যদের নাম এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮শে আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আব্দুল মালেক উকিল এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন

জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য:

(১) সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।
(২) জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
(৩) বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া।
(৪) দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব।
(৫) সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন।
(৬) গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান।
(৭) গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন।
(৮) গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা।
হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ।
(৯) ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।
(১০) নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ।
(১১) কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি।
(১২) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানির পর্যায়ে উন্নীতকরণ।
(১৩) যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।
(১৪) ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ।
(১৫) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন।
(১৬) তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
(১৭) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ।
(১৮) তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি।
(১৯) দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ‘সার্ক’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ।
(২০) বেসরকারি খাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।
জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানির দ্বার উন্মোচন।
(২১) শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।
(২২) ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি
বিএনপি প্রতিষ্ঠার পরপরই জিয়াউর রহমান দলের কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে কর্মশালা আয়োজনের উদ্যোগ নেন, যার মাধ্যমে দলের কর্মীদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, দলের আদর্শ, সাংগঠনিক নিয়ম-কানুন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হত।

১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এরকম একটি কর্মশালা উদ্বোধনকালে তিনি দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন,

“ কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। একটা অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনোই রাজনীতি করা যেতে পারে না। অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম ধর্মই। আমাদের অনেকে আছে যারা আমাদের দেশে যে বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন, আমরা বারবার দেখেছি তারা বিফল হয়েছে। ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ”

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিশেষ একটি কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি ভারত সহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতা অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক নৈকট্য গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ু যুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার দুটি মূল দিক ছিল সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে আসা ও মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা । জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত প্রাচ্যের আরেক পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। তার পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্কে স্বাধীনতার পর থেকেই শৈত্য বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা জিয়াই রচনা করে গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল। বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পু্নর্গঠনের কাজ অনেকটা ত্বরান্বিত করেছিলেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রাগারের দিকে তাকালে সেই সত্যই প্রতিফলিত হয়। সামরিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উন্নত কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে জিয়া রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়।

প্রাথমিকভাবে এসব সংস্কার বৃহত্তর প্রতিবেশি ভারতের সাথে সামান্য দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করলেও জিয়াউর রহমান যে আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিতেন সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) গঠনে তার উদ্যোগ ও অবদানের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ভারত সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারত। চীনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যস্থাপিত সুসম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা স্থাপিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে যার ফলে বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হবে। এই লক্ষ্যে তিনি সার্কের রূপরেখা রচনা করেন যা পরে ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয় ও প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক।

লেখকঃ লায়ন আনোয়ার হোসাইন উজ্জ্বল
ইমেইলঃ lionuzzal2019@gmail