জীবনটা যখন খাদ্য শৃঙ্খল ঈগলের মতন

আপডেট: মার্চ ২১, ২০২৩
0

ডা, জাকারিয়া চৌধুরী :
ঈশ্বর বাঘের খাদ্য হিসেবে আমাকে/আপনাকে কিংবা অন্য কোনো পশু জাতকে-ই কেন বেছে নিলেন, তা নিয়ে আপনাদের কত বিস্তর চিন্তা ! আমিই বা কেন হরিণ শাবক হয়েও একা একা বাঘার ঘাঁটায় জল আনতে যাই- তা নিয়েও বিস্তর গবেষনা ! আমি বলি কি , একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছেন এসব একটা নির্ভুল ইকোসিস্টেমের মত ! তার সব কিছুই একটা নিখুঁত হিসেবের চক্রে আবর্তিত। এখানে জন্মের আগেই লটারির রেজাল্ট হয়ে যায়, কে বেঁচে থাকবে আর কে কার খাদ্যের যোগান দেবে ! কে বড় হয়ে খাদ্য হবে আবার কে খাদক হবে। যে খাদ্য হবে সে এ সত্যটা জানার সাথে সাথেই মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর মনোঃজগতে কি ভয়ংকর তোলপাড় চলে তা কি কেউ কখনো উপলব্ধি করেছেন ? আপনারা কেউ কি শাবক সহ হরিনীর পাল দেখেছেন !! শাবক ছিনিয়ে নেবার পর হরিনীর আর্তনাদ দেখেছেন ? শাবক হত্যার পর কেউ কি সিংহীর যোদ্ধা হয়ে উঠা দেখেছেন ? আমি একজন নারী’কে দেখেছি, যিনি পুত্র হারানোর ভয়ে বাড়ির চারপাশে কলাপসিবল গেট বাঁধিয়েছেন। সেখানে জোড়ায় জোড়ায় তালা লাগিয়েছেন। নিজের বেড রুমে ভেতর থেকে ভাড়ী কড়া লাগিয়েছেন, তালা লাগিয়েছেন !! ভয় কি ভয়াবহ সংক্রামক ! কি বীভৎস! ছিঃ কি বীভৎস !! সমাজ ও মানুষের প্রতি কি ভয়াবহ রকমের ভয় আর আতংক কাজ করলে মানুষ নিজেই নিজেকে এভাবে বন্দী করে রাখতে পারে তা আগে জানা ছিল না। একে বাংলায় কিভাবে গুছিয়ে বলা যায়, কেউ একটু গুছিয়ে বলবেন ? কেউ বলুন তো !

এই যে জগত, দুনিয়া, সৃষ্টিজগত এবং তার পুরো এই ইকোসিস্টেম আর তাদের খাদ্য ও খাদকের অনুভুতি অথবা মানব জীবন চক্রকে কত সহজে, কত-ই না সহজে ‘চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ ফাটা তারার ক্রন্দন’ -বলে, রবীন্দ্রনাথ তো এই এক লাইনেই ব্যাখ্যা আর বর্ননায় ক্ষান্ত দিয়ে দিলেন। আমরা যারা এক বাক্যের এই বিশালতা বুঝিনা, দহন তাদেরও হয়। জগতের বিশাল একটা শ্রেনী এইসব না বুঝা মানুষের দল, যারা এভাবে এক বাক্যে বলতে জানে না, অন্যকোনোভাবে প্রকাশ করতে পারে না, তাদের কষ্টটা কি কেউ অনুভব করেন ? আমি হরিনীর আচমকা ভীতির অনুভুতি দেখেছি হাজারবার। মানুষের ভীতি দেখেছেন কয়জন !! জানেন, গত সপ্তাহে খুব অভিযাত এক জায়গার একটা বাসাতে আবর্জনায় পরিপুর্ন ভীত সন্ত্রস্ত এক মা আর তাঁর শিশু পুত্রকে দেখে চিৎকার করে কেঁদেছি। যারা তাকে এভাবে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল, সাবাসি দিয়েছিল, প্রাউড টু বি এ সিংগেল মম বলে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল, তারা কেউ কি আর খোজ রেখেছিল তাদের !! অনিষ্টের বুদ্ধিদাতা সেইসব ভাড়া খাটা পতিতারা আজ কোথায় ? আমি এদের অনেকের ক্লায়েন্টদের নামও জানি। এই বারোভাতারি ছাউন সাহস থাকলে সামনে আয়। ভাড়াখাটা বেশ্যা। আর কিছু বললাম না। হ্যাঁ কমরেডস যা বুলছিলাম-

খাদ্য শৃঙ্খলের এই চক্রের বাইরে তো কেউ পা রাখতে পারছি না। সৃষ্টি জগতের সকল প্রানই খাদ্য নির্ভর। চক্রের বাইরে ছিটকে পড়েছো তো প্রথমে যা দেখবে তা হলো তোমার স্বজাতি সর্ব প্রথমে এগিয়ে এসছে তোমাকে খেয়ে ফেলতে। এতে তুমি অবাক হতে পারো, বিষ্মিত হতে পারো, হতাশ হতে পারো। তাতে কারো কিছু যায় আসে না। যে প্রয়োজন ধর্মগ্রন্থ হাতে শপথ করে বলেছিল, তোমার জন্য তার শত ইচ্ছেকে বলি দিয়েও কিছু করতে পারছে না, সেই তোমার কলিজার প্রথম অংশটা মুখে পুরে নেবে। বুঝেছো ভাই, এ বনে বুক ফাটা কান্না অবান্তর। এখানে আমি যদি খাদ্য হই, তুমি তবে নিশ্চিত খাদক কিংবা কোনোভাবে এর বেনিফিশিয়ারি। আবার তুমি খাদ্য হলে আমি খাদক। বিশ্ব সংসারে নিরাপদে একটাবার নি:শ্বাস নেবার জো নেই, নিরাপত্তা নেই। একটা না একটা ক্লজে তোমাকে যেতে-ই হবে। এটাই নিয়তি। কেউ বিশ্বাস করলে ভাল না করলে চলো… তোমাদের একটা গল্প শোনাই। এ গল্প আগেও করেছি অনেকবার। তবু ভালোলাগে বলতে। পৃথিবীটা চলছে-ই খুন খারাবির উপরে। সেসবের স্টাডি থেকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রনীতি হয়। এ জগতে একদল ঈশ্বর আছে। তারা সব নিয়ন্ত্রন করেন। যেমন – ঠিক এই মুহুর্তে আমি জ্বর আর ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত। এমন নয়, আগে একই সমস্যায় আক্রান্ত হইনি। এ বিষয়ে কুবি’র দুজন প্রফেসরের সাথে কথা বললাম। তারা ভয়াবহ বর্ননা দিল। এদেশে পাওয়া যায় এমন কোনো অসুধ নেই যা তারা সেবন করেননি। কেন এমন হলো !!

মানুষ কি দিনকে দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে নাকি রোটা ভাইরাসের বিশেষ কোনো মিউটেশন ঘটানো হয়েছে ? দরিদ্র দেশ গুলোয় ফিল্ড,টেষ্ট করে উন্নত দেশের অসুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো। এসব কথা ওপেন সিক্রেট। এখন যদি এর অন্য একটা স্পেসিসকে আফ্রিকায় ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং মাত্র ১৫ দিনে সেখানে তিনলক্ষ মানুষ মরে যায়, তাহলে কি হবে ভেবেছেন ? সারা বিশ্বে হইচই পরে যাবে। করোনার সময় যা হয়েছিল এখানেও বিশ্বজুড়ে লংকাকান্ড বেধে যাবে !! মানুষ কতজন মরবে তার একটা টার্গেট ধরে, বিশ্ব অর্থব্যাবস্থা থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়ে যাবে ট্রিলিওনস অব ডলার্স। আমি নিজে যেহেতু ডায়রিয়া এবং জ্বর নিয়েই এ লেখাটা শেষ করছি ততক্ষনে আরও কুড়ি পচিশ জনের সাথে কথা বলেছি। সবার অভিজ্ঞতা-ই ভীতিকর !! আচ্ছা, যুদ্ধ যুগের এ সময়টায় পানিবাহিত রোটা, সালমোনেলা যদি ব্যাপক ভিত্তিতে কেউ রাশিয়ার ওয়াটার সিস্টেমে ছড়িয়ে দেয়, তাহলে কি হবে কেউ কি ভাবতে পারেন !! মনে রাখবেন, জম্বিযুগ আসবে একদিন। এভাবেই আসবে হয়ত। এখানে ইকোনমি, খাদ্য ব্যাবস্থাপনা, রাহনীতি, আধিপত্যবাদ, কে কার অনুগত কোনো কিছুই কি ম্যাটার করবে ? করবে না সম্ভবতঃ

ইকোসিস্টেমের এমন এক মহাবলী দেখতে গিয়ে আমি আমেরিকান, আফ্রিকান কিংবা ফিলিপিনো বহু ঈগল পরিবারের জীবন চক্র দেখেছি। ঘুরে ফিরে ধারাভাষ্যে যে সত্য সামনে এসছে তা মনে রেখেছি কেবল আপনাদের শুনিয়ে দেবার আশায়। শুনবেন কি বলছে তারা ? একটা মা ঈগলের দুটি ফুটফুটে ছানা সমেত সংসার। প্রথম ছানাটি দ্বিতীয় ছানাটির চেয়ে এক সপ্তাহের বড়। গল্পের বাকি অংশটা হুবহু দিয়ে দিলাম –
“The older bird is larger, heavier, and more developed than the younger bird, so it requires more food and is avid for its share. Siblings will thus compete for food and parental attention, with one bird attempting to out-compete or dominate the other. The younger bird soon learns to keep a low profile until the older has been satisfied and quickly learns to use its wits, making grabs for food or doing ‘end runs’ around the larger bird. This behaviour occurs more within the first two weeks of life, declining as the siblings learn. Siblicide (one eaglet killing or causing the starvation of another) appears to be rare in bald eagles.”( এটি একটি রিসার্চ পেপারের অংশ বিশেষ )।
বাংলা তর্জমাটা কি মোটামুটি এমন যে,
প্রথম হেচড আউট ঈগল ছানাটা দুই/চারদিন আগে জন্মাবার কারনে এমনিতেই সে দ্বিতীয়টার চেয়ে শান শওকত, আকার আয়তন, এটেনশান ,প্রটেকশন এর দিক থেকে এগিয়ে থাকে। তাছাড়া প্রথম সন্তান হিসেবে তার জৌলুসই আলাদা। দ্বিতীয় ঈগল ছানা ডিম ফুটে বের হবার পরপরই বুঝতে পারে, এ পৃথিবী তার ব্যাটল ফিল্ড ফর সারভাইভাল। অন্যদিকে প্রথম ছানার জন্য এটি একটি নিরুপদ্রুপ স্বর্গ- রাজত্বের জন্য। তার সাথে যুদ্ধ করবার সমকক্ষ কেউ নেই। কিন্তু সে জানে, পৃথীবীতে তাকে তার বাবা মায়ের মতই প্রানী শিকার করে টিকে থাকতে হবে। সুতরাং, সে একটা ফ্যান্টম শত্রু খুজে নেয়। আমি যখন আমার স্কিল বাড়ানোর জন্য পুকুরে ঢিল মারছি, সেটা যে পুকুরে ভেসে থাকা ব্যাংগের জীবন মরনের প্রশ্ন সে কথা ভাবছেটা কে ? যে ছানা শিকার ধরা প্র‍্যাক্টিস করছে সেই কাজ যে তার ছোটো ভাই বা,বোনের মৃত্যুর কারন এ শিক্ষা বনে তাকে দিচ্ছেটা,কে !! তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র জন্মের সময়ের কয়েক দিনের আগে পরের সামান্য পার্থক্যই দুই সন্তানের নিয়তিকে দুই দিকে টেনে নিয়ে যাবার প্রথম ইশারা দেয়। প্রথম বাচ্চাটি যখন জোর করতে শিখে দ্বিতীয় বাচ্চাটি সে সময় কম্প্রোমাইজ করে বেঁচে যাওয়ার আকুতি জানায় প্রভুর নিকট। এটা তার জানা থাকেনা, পশুরাজ্যের পশুরা কি মানুষ, যে সমান অধিকার ভোগ করবে!!! তবু অসহায় ঈগলছানাটি বারবার ঈশ্বরের দিকে তাকায় !! কি যে দেখে, কি যে খুজে আমি বুঝিনা !! আমি সেই ছানার চোখে নিজেকে দেখি।
আমি দেখেছি, একবার এক মা ঈগল বিশাল সাইজের একটা খরগোশ কে প্রায় ছোঁ মেরে আকাশে তুলে নিয়ে এলো। এত বিশাল সাইজের প্রোটিন দেখে সহোদর দুই শিশু ইগলই উল্লসিত হল। কিন্তু ছোট ইগলটির উল্লাসের মাত্রার চেয়ে মায়ের প্রতি করুনার প্রত্যাশা-ই যেন বেশি করেছিল। অন্তত আমার চোখে এমনটা-ই ধরা পড়ল। সে যা আশংকা করেছিল তা-ই যেন ফলল অক্ষরে অক্ষরে। মা ঈগল ছিঁড়ে ছিঁড়ে বড় ছানাটিকে মাংস খাওয়াচ্ছে আর বড় ছানাটি উল্লাসে মাঝে মাঝেই ছোটটিকে ঠোকর দিয়ে দিয়ে যেন মায়ের বাহবা কুড়াচ্ছে। আমি কিছুতেই ভেবে পেলাম না, ছোট ইগলটি এত বিস্তর খাবার থেকে সামান্য একটু নাড়িভুঁড়িও পেলনা কেন ? অন্যদিকে মায়ের সামনে মেরে ধরে যেহেতু বড় ছানাটি কোন বাধার মুখে পড়েনি সেহেতু মা চলে যাবার পরেও সে তার আগ্রাসন অব্যাহত রাখল। ছোট বাচ্চাটি এক সময় নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে বাসাটির এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসে রইল। বড় ছানাটি আবার এগিয়ে গেল। ডানা ঝাপটে পৃথিবীকে তার শ্রেষ্ঠত্বের আগমনী বার্তা শোনাল। ঠোকর দিতে শুরু করল নিজের ছোটোটিকে……………

অনেকক্ষণ পরে দেখা গেল ছোট ছানাটি রক্তাক্ত অবস্থায় বাসা ছেড়ে গাছের ডালে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। রাতে বড়টি ঘুমিয়ে যাবার পরে সে পায়ে পায়ে ফিরে এলো বাসায়। এটা তার মা বাবার বাসা। এখানে বসবাসের অধিকার তার আছে। সম্ভবত এই চিন্তাটি-ই সে সময় তার মরন যাত্রায় উস্কানির রথ হিসেবে কাজ করেছে। সে রাতে মা কিংবা বাবা ঈগলের কোনটিকেই ফিরতে দেখা গেল না। সকালে তীব্র ক্ষুধা নিয়ে শিশু দুটির যখন ঘুম ভাঙ্গে ততক্ষনে দুজনেই দুজনের নিয়তির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে। বড় ছানাটি ধীর পায়ে ছোটটির দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছে, আগের দিনের মত পালিয়ে গিয়ে নিজের প্রান বাঁচানোর শক্তি সম্ভবত ছোট ছানাটির শরীরে আর অবশিষ্ট ছিল না।

আহত ছানাটিকে খেয়ে তৃপ্ত না হওয়া তক পিশাচের পিতামাতা সেদিন ফিরেনি। এটাই ঈগলের ইকো সিস্টেম। মানুষের ইকোসিস্টেম হয়ত অন্যরকম। বড়ছানাটাকে তেলজল ডলে মা বাবা তাকে চোদ্দ ইঞ্চি করে দেয় যেন কেবল ঠাপিয়েই দু একটা শিশু ভাইবোনকে ওপাড়ে,পাঠিয়ে দিতে পারে। এখনো খুনোখুনি নেই। আছে চোখের ইশারা, বকা দেয়ায় প্রশ্রয়ের হাসি, আর না দেখার ভান। আফটার অল মানুষও এক প্রকার ঈগল-ই।