জুলিয়াস সিজার, ঈসাবেলা ও আমরা

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২
0

ডা.জাকারিয়া চৌধুরী:

জুলিয়াস সিজার, প্রখ্যাত রোমান সেনাপতি ও শাসক। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০ অব্দে, ১২ বা ১৩ জুলাই তারিখে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, ইনি ছিলেন ট্রোজান রাজকুমার ঈয়েনেয়াস-এর বংশধর। জুলিয়াস সিজারের পিতা গাইয়ুস জুলিয়াস সিজার ছিলেন রোমান সিনেটর। মায়ের নাম ছিল আউরেলিয়া কোট্টা। রাজনীতি, ক্ষমতা ও শক্তিশালী অর্থনীতি তার ছিল জন্মের পুর্ব হতেই।

জুলিয়াস সিজারের কোনো ভাই ছিল না। দুটি বড় বোন ছিল। এদের নাম জুলিয়া সিজারিস মেজর ও জুলিয়া সিজারিস মাইনর । প্রথম বোনের সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে ছোট বোন জুলিয়া সিজারিস মাইনর ছিলেন রোমের প্রথম সম্রাট অগাস্টাসের মাতা। খ্রিষ্ট-পূর্ব ৪৪ অব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আমরণ ডিরেক্টর পদ লাভ করেন। বলা চলে তিনি এ্যাবস্যুলিউট পাওয়ার গ্রহন করেছিলেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে যা সর্বস্তরের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষের মনে রাখা উচিত। সেটা হল – ”Power corrupts… Absolute power corrupts absolutely. এ কথার মানে যারা বুঝেন তারা নিশ্চয়ই এর মর্মবানী বুঝেন। তারাও ইতিহাসের এ ঘাট সে ঘাটে ঘুরে মিলিয়ে নিতে চান এ্যাবস্যুলিউট পাওয়ারের ফল। আমরন ডিরেক্টরশিপ লাভের এক মাস পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ অব্দের ১৫ মার্চ-এ সরকার ও বিরোধীদলের গোপন চক্রান্তে তিনি নিহত হন। কম বেশি প্রায় সবাই এ কান্ড সমর্থন করেন।

এ চক্রান্তের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড বা হোতা জুলিয়াসের সবচে বিশ্বস্ত বন্ধু ও সিনেটর ব্রুটাস – যার ভুমিকার বিষয়ে আগাম সতর্কতা দেয়া স্বত্ত্বেও গায়ে মাখেননি সিজার। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন, সিজারের পর যোগ্যতাবলে রোমের শাসক যদি কেউ হয় তবে তা নিশ্চয় ব্রুট্যাসই হবেন। ছোট খাটো গড়নের রোগা পাতলা ব্রুটাশ খুব বড় যোদ্ধা হয়ত ছিলেন না কিন্তু তাকে ছাড়া সিজার কখনো কোন অভিযানে যেতেন না। বিকজ হি ( ব্রুটাস ) ওয়াজ এ গেম মেকার, গেম চেঞ্জার, ওয়ার উইনার এন্ড ডেফিনেটলি এ কিং মেকার। এমং অল দ্যা সোলজার্স অব রোম, হি সিলেক্টেড জুলিয়াস সিজার টু বি মেইড দ্যা নেক্সট ‘ডিরেক্টর’। সিজারের বাহিনীতে সিজারের চেয়েও মহাবীর যোদ্ধা ছিল কিন্তু ডিরেক্টর হবার জন্যে যে শুধুমাত্র বীর যোদ্ধা হলেই চলেনা, তা সবচে বেশি বুঝতেন ব্রুটাস। তিনি জানতেন, রাজা হওয়া-ই শেষ কথা নয়। রাজকার্য পরিচালনা করা কো-ই বাচ্চে কো খেইল নেহি হ্যায়। সিজার নিজের বীরত্ব আর অহংকারে মাটিতে লাত্থি মেরেছিলেন। সিজার প্রথমে নিজেকে দশ বছরের জন্য ডিরেক্টর মনোনিত করেন। সিনেটররা তার এই অগণতান্ত্রিক আচরনকে ভালোভাবে নেননি। খ্রী পুর্ব ৪৪ অব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই একই সিনেটকে ব্যাবহার করেই তিনি আজীবনের জন্যে নিজেকে ডিরেক্টর মনোনিত করেন। এই ফরমান জারির এক মাস তথা ৪৪ অব্দের ১৫ই মার্চ তিনি অত্যন্ত নির্মম ও হৃদয় বিদারক ভাবে খুন হন সিনেট অধিবেশন চলাকালে, সিনেট ভবনে। সিনেটররা খুব ভালভাবেই জানতেন, সেনাবাহিনী এবং সাধারন জগনের কাছে জুলিয়াস সিজার শুধু মাত্র একটি নামই নয়, সিজারের উপস্থিতিই তাদের সুরক্ষার জন্যে যথেষ্ট। আর রাজনীতিজ্ঞ, সংযুক্ত সিনেটরেরা জানতেন স্বেচ্ছাচারিতার পরিনতি কি! ফলে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রথমে বিরোধী দলীয় সিনেটরেরা একের পর এক নিরস্ত্র সিজারের পেটে বুকে যখন ছুরি বসিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এক সময় হতোদ্যম সিজার ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে আধা শোয়া ভংগিমায় পরে ছিলেন। খুনীদের জটলাটা সরে যাবার পর ‘ব্যাথিত’ ব্রুটাস পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সর্বশেষ আঘাতটি করেন। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে জুলিয়াস সিজারের জীবনের সবচে বড় বিষ্ময় ছিল সম্ভবত এ আঘাতটি-ই। একরাশ হতাশা, ভীতি আর অবিশ্বাস্য বিষ্ময়ে সিজারের শেষ উক্তি ছিল

– ওহ ব্রুটাস, শেষ পর্যন্ত তুমিও?

ফিউনারেলের আগ মুহুর্তে ব্রুটাস সমবেত জনতার উদ্দ্যেশ্যে নিজের অবস্থান ব্যাক্ত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ক্ষুব্ধ জনতা তাকে বিশ্বাস ঘাতক বলেই চিৎকার করছিল। তবু তিনি তার বক্তব্যটা এভাবে শুরু হয়েছিল- হে রোমান, প্রিয় দেশবাসী আপনারা আমার কথা মন দিয়ে শুনুন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। জুলিয়াস সিজার ছিলেন আমার সবচে প্রিয় বন্ধু ও আমার নেতা যাকে আমি ভালোবাসতাম আপনাদের মতই। তার এই নিষ্ঠুর মৃত্যুতে আমিও আজ শোকগ্রস্থ। আপনাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়টা অনুধাবন করতে হবে যে, জুলিয়াস সিজার সমগ্র রোম কিংবা রোমান জাতীর চেয়ে বড় ছিল না। নিজের আত্ম অহংকার আর অতি উচ্চাভিলাষ তাকে এ চরম পরিনতির দিকে নিয়ে গিয়েছে। সমগ্র রোমান’রা নিজেদের রক্ত দিয়ে তার ডিরেক্টরের পথ বিনির্মান করেছে। জুলিয়াস সিজার এই আত্মত্যাগের কথা মনে না রেখে নিজেই নিজের পথ আবিস্কার করেছে। তার এ পরিনতির দায় শুধুমাত্র তারই এবং এ মৃত্যুর প্রয়োজন ছিল………….

হ্যা, নিশ্চয়ই। এ মৃত্যুর প্রয়োজন তো ছিলই।

ব্রুটাস তার বক্তব্য শেষ করতে পারেননি। এরপর মার্ক এ্যান্টনিকে বক্তব্যের আহবান জানিয়ে ব্রুটাস এক প্রকার পালিয়ে বাচেন। অথচ গত গত দুই হাজার বছর ধরে ‘ব্রুটাস’ মানেই বন্যতা, পশুত্ব আর পেছন থেকে ছুরি মারার প্রতীক হয়ে আছে। ব্রুটাস মানেই জ্বলজ্যান্ত এবং চুড়ান্ত বেঈমানী’র প্রতীক। আমি তার বক্তব্য বহুবার পড়েছি। বিভিন্ন নির্মাতার হাতে বানানো ‘জুলিয়াস সিজার’ মুভিটি দেখেছি। সেকেস্পিয়ারের স্ক্রিপ্টে জুলিয়াস সিজার নাটকটি দেখেছি। বক্তব্যে ভিন্নতা এসেছে বারবার কিন্তু বাস্তবতা, পরিনতি এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে কোথাও চুল পরিমান ভিন্নতা নেই।

১৪৯২ সালের পহেলা এপ্রিল স্পেনে একদিনে প্রান হারায় ত্রিশ লক্ষ মুসলিম নারী, পুরুষ আর শিশু। রানী ঈসাবেলা আর রাজা ফার্নান্ডেজের বাহিনী তিন দিক থেকে স্পেনে আক্রমন করে। সাধারন মুসলিম জনতা প্রান বাচাতে রাজধানী গ্রানাডার দিকে ছুটতে থাকে। তখন রাজা রানী ফরমান জারী করে আদেশ দেন, যে সকল মুসলিম নারী পুরুষ মসজিদে আশ্রয় নেবেন তাদের কোন প্রকার হয়রানী করা হবে না। যারা জাহাজে আশ্রয় নেবেন তাদেরকে অন্য কোন মুসলিম দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সাধারন জনগন নিজেদের কোন সেনাবাহিনী না পেয়ে ইসাবেলার কথামতো্ই মসজিদ আর জাহাজে আশ্রয় নেন। এই সুযোগে সবগুলো মসজিদ বাইরে থেকে তালা মেরে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জাহাজ গুলোকে মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয় ইসাবেলার সেনারা। এ সংবাদে রানী ঈসাবেলা খিলখিল করে হেসে উঠে বলতে থাকেন- How fool the muslims are!! How fool, How funny’. মাত্র দশ হাজার সেনা একলক্ষ দশ হাজার সেনার বিরাট বাহিনীকে হারিয়ে যে স্পেন বিজয় করেছিল, তার আট’শ বছর পর সাধারন জনগনকে গনহত্যার মাধ্যমে মুল্য দিতে হলো রাজা রাজন্যদের স্বেচ্ছাচারিতা, আমোদ ফুর্তি, বিত্ত বৈভবে ডুবে যাবার ফল হিসেবে। সেদিন স্পেনে কোন যুদ্ধই হয়নি। হয়েছে জাতি নিধনের সফল মঞ্চায়ন। ইথনিক ক্লিনজিং…

যে কথা ব্রুটাস বুঝেছিলেন সেই দুই হাজার দুইশ বছর আগে, যে কলংক কখনোই মুছতে পারবেন না বলে জানতেন ব্রুটাস-এ্যান্টনি’রা সে কথা দু’হাজার পরেও কি এদেশের রাজনীতিবিদেরা বুঝেনা ? নাকি ব্রুটাসের বক্তব্যের মানে কি দাঁড়ায় সেটাই কেউ তর্জমা করতে পারেনা ? নাকি লজ্জায় এ বিষয়ে সব বুঝেও কেউ মুখ খুলে না ? নাকি এ্যান্টনি, ব্রুটাস কিংবা সিজারের নামও শুনেনি কেউ? কোনটাকে সত্য বলে ধরে নেব। ‘এ গ্লোবাল ট্রেন’ নামক পাচ পর্বের একটা ধারাবাহিক লিখতে গিয়ে তিন পর্ব লিখে থেমে গেছি। আজকে যা লিখছি, কালকেই তা ঘটছে। কি ভয়াবহ ব্যাপার!! আমার কাল্পনিক গল্পের এমন সফল ও বাস্তব মঞ্চায়ন দেখে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গেছি। কেউ কি আছেন? দয়া করে কেউ কি বলবেন, আমরা কি দেশটা খুইয়ে ফেলব নাকি স্পেনীয় পরিনতির জন্যে অপেক্ষা করব ? এ দেশে কি কেউ নেই যিনি ভারত-ইজরাইল-মায়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পুরো জাতিকে এক করে ফেলতে পারে?

ফিউশনের যে সাইকেল শুরু হয়েছে, স্বেচ্ছায় সেখানে কেউ বলি হতে চাইলে সে তাতে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু জাতি? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে একটু একটু আয় তার একটা অংশ যায় করের খাতে, আরেকটা সামান্য অংশ যায় সঞ্চয়ের খাতে। করের টাকায় রাজারা রাজভোগ করে। আর থাকে নানান লিপ্সায় মত্ত। সঞ্চয়ের পুরো টাকা ট্রানস্ফার হয়ে যায় অচিন কোন স্বত্বে। ব্যাংক একাউন্ট ফোর্সফুল্লি টাকা কেটে নেয় এদেশের ব্যাংকাররা। তারা জানে, তাদের বিচার হবে না। সতেরো কোটি মানুষ বড় নাকি রাজা বড়? এটাও জানে, ব্যাংকাররা। যে রাজা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন বলে বুক বেঁধে বসে আছি; সে রাজা একদিন ভিন কোন দেশে চলে যাবেন ? ওহে রাজা; আমাদের এতো এতো ঘামে ভেজা টাকা গুলোর এই পরিনতি দেখার জন্যে আপনাদেরকে কেউ দায়িত্ব দেয়নি। আপনারা না পারলে চলে যান। দেশের পুরো শরীরে ক্যান্সার আজ জেকে বসেছে। আমাদেরকে প্রতারনাময় মৃত্যুর হাত থেকে বাচান। আমরা কোন ঈসাবেলার উল্লাসনৃত্য কিংবা কোন গ্ল্যাডিয়েটরের খুন করার দৃশ্য কিংবা নির্মমভাবে খুন হয়ে যাবার দৃশ্য উপভোগ করতে বসিনি। আমাদের হৃদয় কোন গ্রানাইটে পাথরে গড়া নয়। আমরা যেকোন খুনোখুনিতে কষ্ট পাই। আমাদের মন কাঁদে । আমাদের সাথে এ অসদাচরণ বন্ধ করুন প্লিজ।


নির্বাহী সম্পাদক দেশ জনতা ডটকম