জোসনা ফুলের উইল

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২
0

মাহমুদা ডলি:

শরৎ এখন পাইটি বিলের মধ্যেও চুপ। পূনির্মার আকাশে এই সন্ধ্যা রাতেও সাদা মেঘের লুকোচুরি। চাঁদের আলো দেখে হাসছে নীল নোনতা-সাদা শাপলা। কলমীলতা. শৈবালের ইষৎ সবুজ জ্যোৎস্নার রহস্যময়ী রুপালী রাত্রীর উত্থান।
মহাশূণ্যে সপ্তলোকে আর সৃষ্টিমূল উত্থান – পতন ভাবি; ভেবেই নিজেকে খুজেঁ বেড়াই কোথায় আমি আজ দাঁড়িয়ে! তোমার ভালোবাসাই আজ হয়তো আমাকে বাচিঁয়ে রেখেছে। নয়তো কবেই হয়তো আমার সমাধীতে শৈবালেরা আশ্রয় নিতো।

পেছন থেকে ডাক দিলেন বড় আপা ,শুনছিস। পেছন ফিরে তাকালাম কোন উত্তর না দিয়ে। আমি যেন নিজেকে আর প্রকৃতি নিয়ে আজন্ম বিভার মতো দাড়িয়েছিলাম এতোক্ষণ ।

আপা বললেন ‘ ওই বাড়ির বুড়ি এসেছে তোর কাছে কথা বলার জন্য। দুপুরে তুই আমাদের বাসায় এসছিস শুনেই আসতে চেয়েছিল। বেশ কয়েকবার খবর নিয়েছে । তুই বিশ্রাম নিচ্ছিস শুনে আসেনি। বড় আপা আমার হাত ধরে ঝুল বারান্দা থেকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন পেছনের রুমে।

বৃদ্ধা বসে রয়েছেন মেঝেতে। আমাকে দেখে নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করলে হাত ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিলাম। বড় আপা আমাকে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বললেন,তুই এখানে বস। এরপর বড় আপাও একটা জলচৌকি নিয়ে বৃদ্ধার পাশে বসলেন। ভালো ভাবে নোটিস করলাম বৃদ্ধাকে । সাদা চুলে মনে হয় চিরুনী পড়েনি একমাসেও। পড়নের কাপড়টা বেশ মলিন ,পুরোনো হলেও বেশ পরিস্কার। চেহাড়া,শরীরের সাদা লাবন্যময় স্কিন দেখে মনে হলো বয়সের অনেক আগে সে বৃদ্ধা হয়ে গেছে। চেহারা দেখে মনে হলো বয়স তা ৬০ হয়নি এখনো । তার বিষন্ন-বিধ্বস্ত মুখের মধ্যেও ম্লান হয়ে যায়নি গায়ের ফর্সা রংটা। আভিজাত্যের ছাপ মুখে না থাকলেও তার ব্যক্তিত্বের ছাপ সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে।

আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বড় আপা বললেন, দেখ ,আমাদের পেছনের যে বাড়িটা ওটার মালিক উনি। আমি জানালা ফোঁকড় গলে দৃস্টি দিলাম বাড়িটাতে । আপা বললেন, ‘ওই বাড়িটার একটা উইল করতে চান উনি’। তুই যেহেতু উকিল মানুষ ,উনার জন্য ভালোভাবে একটা উইল তৈরী করে দে।’
বৃদ্ধার নাম ফুলবানু । জিজ্ঞেস করলাম উইল করবেন কার নামে। বললেন,নাত বউ আর দৌহিত্রর নামে। একটু অবাক হলাম। কেন আপনার ছেলে ,স্বামী ?
কথার জবাব এড়িয়ে বললেন , তারা কেউ নাই। আপাতত এদের নামেই হবে।
বড় আপা বললেন,’ উনি বাড়িটা বেচতে চাইছিলেন ,কিন্তু পরে পথে বসতে হবে ভেবেই ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। তার এখন ভরসা কেবল এই নাত বউ আর নাতি।
বললাম , ঠিক আছে আপনি রোববার কোর্টে আমার চেম্বারে একবার আসুন। আপার কাছে থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে নিবেন কেমন? জবাবে বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে।

বেশি কথা না বলা এই বৃদ্ধার ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নাই। কিন্তু বড় আপা একেবারে গদগদ অবস্থা তার ব্যাপারে। আমার মোটেই ভালো লাগেনি।আপা বললেন, উনি যদি এখন এই উইলটা না করে তাহলে,তার আর পায়ের নীচে মাটি থাকলো না।
এবার ফুলবানু শান্ত ,ধীর-স্থীরভাবে মাটির নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সবই ছিল আমার , কিন্তু কোন কিছুই আমার রহলো না। ’

“সেই ৫ বছর বয়সে মৃত বাবার মুখটাকে মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু আসেনা। বাবা –মায়ের দেয়া নিজের নামটা কি ছিল তাও ভুলে গেছিলাম। বাবা মারা যাওয়ার পর মাসখানেক এ বাড়ি ও বাড়ি , এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে ঘুরে ভাত চেয়ে খেতাম। একবেলার বেশি কউ কোনদিন ডেকে খাওয়ায়নি। ঘুরতে ঘুরতে রেলস্টেশনে পৌছে গেলাম। ট্রেনে উঠে পড়লাম। কতক্ষণ ছিলাম জানিনা। নিজেকে আবিস্কার করলাম কমলাপুর রেলস্টেশনে। হয়তো ট্রেনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।স্টেশনে পৌছানোর পর কেউ আমাকে বাইরে ফেলে রেখেছে। তখন বুঝিনি ওটা কমলাপুর। এখন আন্দাজ করছি। হাটতে হাটতে সদরঘাট এসে পৌছালাম । দু’একদিন চেয়ে চিন্তে পল্টুনে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু চারদিকে যেখানে তাকাই ,যেদিকে যাই অপরিচিত মুখ ,নিষ্ঠুর মুখ, চোরের মুখ,পকেটমারের মুখ,অজ্ঞানপার্টির মুখগুলো আমাকে আরো বিভীষিকার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে কাঁদতে থাকি। কত লোক আসা যাওয়া করছে কউ আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। কেউ আমারে ডেকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করেনা যে ,কেন কাঁদছিস!’’

ফুলবানু কাঁদতে থাকে। আমি তাকে বাধা দেই না। হয়তো কষ্ট জমে আছে । ফুলবানুর কথা শুনতে শুনতে আমার ভেতরেও কেমন হাহাকার করে উঠলো। ভেসে উঠলো সেই ছোট্ট ফুলবানুর মুখ।

ফুলবানু চোখ মোছে । নিজেকে নিজে সামলায়। আবার বলতে শুরু করেন ‘ ৩দিন এভাবে কেটে যাওয়ার পর এক ভিক্ষুক মহিলা তার নাম শরীফা । সে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো। আমি নাম বলতে পারলাম না। যতদূর মনে পড়ে শরিফা বেগম আমারে কোলে নিলো।এরপর নিয়ে এলো তার ঘর মানে মগবাজার রেললাইনের পাশে বস্তি ঘরে।
সে আমার নাম দিলো ‘ফুলবানু’। বললো ,সে-ই নাকি আমার মা। আমিও মা পেলাম ,বাবা পেলাম।বড় আদরের সঙ্গে তার কাছে বেড়ে উঠলাম। মেয়ে বড় হয়ে গেলে বাবা-মায়ের তো চিন্তার শেষ থাকে না। আমারে কাজে-কাইমে দিতেও মা ভয় পাইতো। বলতো , মানুষেরে বিশ্বাস নাই। আগে বিয়ে-থা দেবো তারপর কাজ-কাইমে যাইবো।
তখন আমার বয়স ১১ বছর। ধাই ধাই করে বেড়ে গেলাম। মায়ের চিন্তার শেষ নাই। একদিন প্রস্তাব নিয়া আইলো একজন।ছেলে রিকশা চালায় শারুলিয়া এলাকায়।
বিয়ের দিন আসলো ঘনিয়ে এলো। মা আমারে কইলো এই স্বামীই তোর আপনের চেয়েও আপন। ধরে রাখিস যত্ন করে। আমারে বিয়ে দিয়া মা বাচঁলো। নতুন করে বেঁচে থাকার সে যে কি আনন্দ ! তার মধ্যে চলে এলো কোল জুড়ে আমার খোকন।সে আনন্দ সবার এক রকম হয়না। স্বামীর সংসারে সন্তান বুকে আগলে আমার কল্পনা আর স্বপন দিয়েই চলছিল। শুধু স্বপ্ন স্বপ্ন আর স্বপ্ন। বাস্তবটাকেও কল্পনার ফানুসে বানিয়ে নিলাম। যেন এতেই আমার সব সুখ নিহিত। পায়ের নীচে মাটি নাই, একবেলা খাই তো পারের বেলা না খাই থাকি।তবুও আমার পৃথিবীর রং তখন একটাই,সবুজ।

কিন্তু সেই ভাব,সে স্বপ্ন বেশি দিন টিকলো না। সংসারের আর্থিক চাপের মুখে পড়ে আমিও নামলাম কাজে। যাত্রাবাড়িতে হোটেল -মেসে -দোকানে -দোকানে পানি দিতাম। যে টাকা আসতো তাই দিয়েই দুজনের সংসার চলে।
একদিন সকালে দেখলাম দুইটা ছেলে নিয়ে এক মহিলা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একই জায়গায় বসে বসে কাঁদছে।বেড় ছেলেটার বয়স প্রায ৮ আর ছোট ছেলে চার কি পাঁচ হবে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে একই জায়গায় বসে থেকে কাঁদতে দেখে জানতে চাইলাম, কেন সে বসে বসে কাঁদছে। বললো , ‘কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে এসেছে’ । নাম শরীফা বেগম। বয়স ২৫/ ২৬ বছরের বেশি হবে না। তার স্বামী দ্বিতয়ি বিয়ে করে দুই ছেলেসহ তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
আমি আহত হলাম মনে মনে। ভাবলাম এভাবে এখানে থাকলে যুবতী নারীর যেকোন দূর্ঘটনা ঘটে যাবে রাত গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই। আমি তাদের সঙ্গে করে সারুলিয়া আমার বাসায় নিয়ে এলাম। আমার স্বামীর যে কি চিৎকার চেচামেচি! কেন এসব ঠাঁই দিলাম। মানুষকে বিশ্বাস নাই, আরো কত কিছু। আমি কাকুতি –মিনতি করে স্বামীর হাতে –পায়ে ধরে তারে আশ্রয় দিলাম। বললাম,কয়েকদিনের মধ্যেই তার জন্য কাজ আর অন্য বাসা ঠিক করে দেবো।
দিনের বেলায় তরে রেখে কাজে যাই। নিজেরটা করি আর তার জন্য কাজের সন্ধান করি। পরমার্শ্চের বিষয় হলো ; কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই নারী ,আমার অনুপস্থিতিতে আমারই স্বামীর বাহুতলে যায়। দিনের পর দিন চলছিল । হঠাৎ একদিন চক্ষুর সমক্ষে যা দেখেছিলাম ; তখন নিজেকেই খুব ঘৃণ্য মনে হয়েছিল। রাতভর কোন কথা ছিল না কারো মুখে। সারাদিন কাজ কর্ম ,মনের ওপর গভীর চাপে ক্লান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । রাত জেগে দেখি নাই কউ নাই। আমার স্বামী সেই নারীর হাত ধরে পালিয়েছে। এমনকি নিজের ছেলেদুটাকেও আমার কাছে ফেলে রেখে গেছে। সারাদিন খুজলাম বিভিন্ন বস্তিতে ,বাসাবাড়িতে যেখানে আমার স্বামীর যাতায়াত ছিল সেখানেও। ভাবছেন, স্বামীকে ফিরিয়ে নিতে খুজঁছিলাম ? তা নয়। তার ছেলে দুটারে তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম …কাদছেঁন ফুলবানু।
আমার গলাও রুদ্ধ হয়ে এলো ফুলবানুর কথায় । কাঁদছেন কাঁদছেন। ফুলবানুর মহারোল যেন আকাশের নক্ষত্ররাজিও উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলো! নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হয়ে উল্কার মতো দাগ কেটে তার বুকের ভেতর। অদূরের শীতলক্ষা নদীর জলসম্ভারও যেন সব অপমান মুছে দেবে বলে বহে চলেছে নিরন্তর ,নিরবে।
মিলিয়ে গেছে ফুলবানুর আকাঙ্খার সম্পূর্ণটুকু,মুছে দিয়েছে তার সমস্ত স্বপ্ন।
ফুলবানু এবার কান্না থামায়। গলা খাকড়ি দিয়ে নিজের কন্ঠ পরিস্কার করে। এরপর আবার বলতে শুরু করেন,‘
দিশেহারা হয়ে ঘরে ফিরলাম। চারদিকে শূণ্যতা। শরীফার ছেলে দুটো সামনে দাড়ায়। নিরবে পড়তে থাকা চোখের পানি মুছে দেয় বড় ছেলে জসিম। অবাক চোখে তাকাই। ভাবলাম এ ছোট দুটি অসহায় শিশুকে যদি আমি রাগ করে তাড়িয়ে দেই ; তাহলে এরাও আমার ছোটবেলার মতো করুণ অবস্থার মধ্যে পড়বে। শরীফার বড় ছেলেটা আজ দুই দিন পর আমার সামনে দাড়িয়েছে । চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ডাক দিলো ; মা বলে । আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।ছেলেটাও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।তা দেখে ছোটটা রুবেলও মা মা বলে আমার কাছে ছুটে এলো। খোকনসহ এই তিন ছেলের দায়িত্ব আমার কাধে। আমার কষ্টটা ভুলিয়ে দিতে জসিম বলল,‘মা আজ থেকে তুমিই আমার মা। দেখো বড় হয়ে আমি তোমার কষ্ট ভুলিয়ে দেবো।’
আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলাম। ওদের তিনজনকেই বুকে আগলে বেঁচে থাকার পথ খুঁজলাম। বছর পাঁচেক পরে দেখি একা আর সংসার সামলাতে পারছি না। জসিমকে যাত্রাবাড়িতে একটা চায়ের দোকানে কাজ যোগাড় করে দিলাম। ভালোই চলছিল। ছেলে প্রায় ছয়/সাত পরে কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
বাসায় ঠিকমতো ফিরছে না, খোজঁ খবর নেয় না। একদিন রুবেলকে নিয়া গেলাম ওর দোকানে। সেখানে গিয়ে পেলাম আরেকটা ধাক্কা। চায়ের দোকানের মালিকসহ যারা জসিমের চারপাশে থাকে তারা ছেলেটাকে বিগড়িয়ে দিলো ,যে আমি জসিমের কউ না। তার ভবিষ্যৎ আছে ,সে কেন টাকা-কড়ি আমারে দিবে। এইটা সেইটা শুনতে শুনতে ছেলে আর আমার কাছে যায় না। আমি দোকানে গেলে , সেই লোকগুলো হই হই করে উঠলো ‘ ওই যে দেখো আসছে । ’ আমি বললাম,বাবা তোর এখানে কাজ করার দরকার নাই। তুই ঘরে চল। ছেলে কিছু না বললেও দুই তিন ব্যাটা-ছেলে এসে আমাকে অশ্লিল –অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে চুল ধরে টেনে রাস্তার ওপর ফেলে দিলো বললো ,‘মাগি যা। এখানে আর যদি আসবি তাহলে তোরে খাইছি।’
‘‘চোখের সামনে আগের চেনা পৃথিবীটার সব কিছু নতুন করে কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। মন সবই বুঝে ;কিন্তু সর্বশক্তি দিয়েও জীবনের এই অনিবার্য অলিখিত ঘটনা আটকাতে পারছি না। মনেও কষ্ট ,বুকে যেন জগদ্দল পাথর বসে গেলো ’’

অপত্যস্নেহের আকুলতায় কাদঁতে থাকে ফুলবানু। ঘরের ভেতর এবারো পিন পতন নিরবতা। আমিই ভেঙ্গে দিলাম। এবারে ডুকরে কাঁদতে থাকে সে।বড় আপাকে বললাম, ‘ বড় আপা একটু চা খাবো।’ এর মধ্যে রুমের ভেতর প্রবেশ করলো আমার অচেনা যুবতী বউ। বড় আপা তারে নাম ধরে ডাকলেন,’জোসনা যা তো একটু চা বানিয়ে নিযে আয়। জোসনা চলে গেলো। বড় আপা বললো, এই হলো উনার ( বৃদ্ধার ) শেষ সম্পদ , বাঁচার শেষ ভরসা ! উনার নাতি বউ। আমি আরো অবাক হলাম। বৃদ্ধাকে বললাম , কাদবেন না । আমারো আরো কিছু শোনার আগ্রহ বাড়লো ।বললাম , এরপর কি হলো বলেন ?
ফুলবানু নাকের পানি ঝাড়লো নিজের আচঁল দিয়ে। এরপর চোখ মুছলো ,গলা খাকাড়ি দিয়ে কন্ঠ পরিস্কার করলো এরপর বললো , ‘ আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাস্তার ওপর দপ করে বসে রইলাম। রুবেল কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। বলল,মা বাড়ি চলো। শেষ পর্যন্ত বিমর্ষ হয়েই বাসার পথ ধরলাম রুবেলের হাত ধরে।
বার বার মনে হয় যেন কিছুই ছিল না ; তবু কী বিশ্বাসে বুকের ভেতর উছলে ওঠে। বন্ধ ঘরে আবার স্বপ্ন নেমে এলো। আশার পথে হাত নেমেছে । কিন্তু ওই যে কথায় বলে কাকের বাসায় কোকিলের ছা। আমার মনে হয়েছে নিজেকে একটা কাক। কিছু দিন পর রুবেলকেও জোড় করে ধরে নিযে গেলো জসিম।

এবার আমি আর খোকা। অসার হয়ে পড়ে রইলাম দু’দিন।কেন সব মায়া – মহব্বত শুধু আমারই থাকবে! নিজের মনকে শক্ত করতে চাইলাম । আর কাঁদলাম না।আগের কাজ ছেড়ে দিলাম। একা খোকাকে রেখে আমি কোথায় যাবো। কাজ খুঁজতে লাগলাম। বেশি দিন লাগলো না। শারুলিয়াতেই পেলাম। ফিরোজ খানের বাসায়। খোকারে কোলে দেখে জানতে চাইলো এভাবে বাচ্চা নিয়ে কাজ করবা কিভাবে? বললাম ,‘স্যার আমার তো আর কেউ নাই। ওরে কোথায় ফালাইয়া রাখুম।’ ফিরোজ খান আমার কথা শুনে বললো তাহলে তোমাকে অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তাছাড়া তুমি তো যুবতী । আমার ধারনা পারবে ।আমিও আগ্রহের সঙ্গে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললেন, ’বাড়ির গ্যারেজের পাশেষ একটা এক রুম আছে , তুমি ছেলেকে নিয়ে ওখানে থাকবে। আর বাড়ির সমস্ত কাজ তুমি করবে ,খাওয়া দাওয়া এখানেই। মাসে কিছু মাইনে পাবে। ’ ‘এই আশ্রয়টুকুই আমার জীবনে যেন সব চেয়ে বড় নিরাপদ জায়গা।’

দু’হাত নিজের থুতনিতে ধরে রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ফুলবানু। সারা ঘরে পিন পতন নিরবতা। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই ফুলবানুর দিকেই তাকিয়ে রইলো।
একজেন নারীর জীবনে এতো মানুষের মধ্যে আর যা-ই থাকুক; খুটি একটা থাকেই। সেটি যত মজবুত হয় ,নারীর নিরাপত্তাবোধ তত নিশ্চিত হয়। স্বামীই তার সেই খুটি। কিন্তু ফুলবানুর তাও নাই।
আচঁল দিয়ে চোখ মোছে ফুলবানু । মাথার কাপরটা পড়ে গেছে দমকা বাতাসে। জানালাটা ধরাস করে গ্রিলের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো জোড় বাতাসে। ভ্যাপসা গরম থেকে একটু হলেও স্বস্তি মিললো। ফ্যানটা ঘুরছে তার সর্বশক্তি দিয়ে।
নিজের খোকাকে নিয়ে ভালোই চলছে ফুলবানুর।কাজের মধ্যে ডুবে থাকায় কিভাবে কেটে গেলো ৫টা বছর নিজেই জানেনা। ও আর কোন আশা করেনা। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে জীবন-যাপনের স্বপ্ন দেখেনা। ওর রক্তে যে বিষ ঢুকেছে তা কোন দিন দূর হবেনা। নিজেকে আশ্চর্য রকমের নির্লিপ্ত করে ফেলেছে।
সব কিছু চলছিল ঠিকই। একদিন আবার অন্ধকার রাতেই ফিরে এলো সেই দমকা ঝড়ো হাওয়া।

তার স্বামী তাকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির গেটে হাজির হলো। ফুলবানু দেখলো তার স্বামী। বয়সের চেয়েও বেশি বয়স্ক লাগছে।ফূলবানু সামনে গেলো জানতে চাইলো কি চাই? বললো , জসিম-রুবেল তার মাকে খুজে পেয়েছে। এরপর তাকে ওই বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
ফুলবানু ভাবলো এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। সেই দিনগলোর কথা আর মনে করতে চায় না তবুও মনে করিয়ে দেয়ায় আরো ঘৃনার বেগটা চাপলো । সেই দিনগুলোতে চার দেয়ালের মধ্যে তারই সামনে ,কখনো রাতে ,কখনো দিনের আলোতে যা চলছিল।এতো খারাপের মাঝে সে ভালোটা কিভাবে আশা করে!
ফুলবানুর স্বামী আবার ফিরতে চায় । ফূরবানুর মুখে কোন কথা আসেনা। বুক ভরা ঘৃনা ছাড়া এই মুর্হূতে তার কাছে আর কিচ্ছু নেই। ভেতরে ভেতরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। কিন্তু সে শব্দ করে কাঁদতে পারছে না। লোকলজ্জার ভয়ে ,স্বামীর প্রতি তার দুর্বলতা প্রকাশ পায় সেই ভয়ে। ফুলবানু স্বামীর মুখের ওপর গেট লাগিয়ে দেয়।এপাশে দাড়িয়ে বলে তুমি চলে যাও। আমি কাউরে চাই না। ফুলবানু আজ আর রাতে ওই বাসায় যায়নি নিজের রুম ছেড়ে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। মধ্য রাতের দিকে ফিরোজ খান ডেকে বলে ,পারলে ওরে ক্ষমা করে ঘরে ডেকে নাও । ও দাড়িয়ে আছে। ফুলবানু বলে,স্যার ও যদি ভালোবাসে আমায় তাহলে আরো অপেক্ষা করবে। দেখি কতক্ষণ থাকে ! এরপর ব্যবস্থা নেবো। ফিরোজ কান আর কিছু বলেন না । চলে যায় নিজের ঘরে।

ফজরের আযানের সুরে ঘুম ভেঙ্গে যায় । ধরফর করে ওঠে বসে। জানালা খুলে বাইরেটা দেখে নেয় তার স্বামী আছে কিনা। তাহলে তাকে ডেকে ঘরে তুলে নেবে। জানালা খুলে দেয়ার পর সকালের আলো যে তার জীবনে কখনো ফুটবে না সে বুঝতে পারেনি। দেখে স্বামী নাই। ফুলবানু আর অপেক্ষা করেনা। সে ওখান থেকে যাত্রাবাড়ি যায় তার পরিচিত কাপড়ের দোকানে।সেই কাকডাকা ভোরেই সেলসম্যানদের ডেকে তোলে।একটা সাদা থান কিনে নেয়। সকালে তাকে সবাই আবিস্কার করে বিধবার বেশে। সাদা থান পড়া। ফিরোজ খান অবাক চোখে তাকায়। এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ফুলবানু – স্যার ,ও আমারে কোনদিন ভালোবাসেনি।তাহলে একটা রাত তো সে অপেক্ষা করতে পারতো।চিৎকারে সকালের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ফিরোজ খান নিজের মুখ লুকিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। কোন স্বান্তনা দিতে পারেনা কেউ ।
েএরপর আর কোনদিন স্বামীকে দেখেনি। কোথাও তার খোঁজ মেলেনি।খোঁজ নেয়নি।
এপর ছেলে বড় হলো ,বিয়ে করলো। একটা নাতি ঘরে এলো। হঠাৎ ছেলে মাদকের নেশায় ডুবে গেলো। ৩০ বছর বয়স না পেরোতেই ছেলে রাস্তায় পড়ে মারা গেলো। ছেলের বউ সুইপারের চাকরি করে সিটিকর্পোরেশনে ।স্বামী ছাড়া তার শ্বাশুড়িকে ভালোলাগে না। নিজের সন্তানকে শ্বাশুড়ির কাছে ফেলে রেখে গেলো । এবার নাতিকেও বড় করার দায়িত্ব তার। নিজের যা কিছু সহায় –সম্বল বলতে তার দীর্ঘ জীবনে সঞ্চয় করা কিছু অর্থ । যা জমেছে তাই দিয়ে দেড় কাঠা জমি কিনে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করলো বাড়ি তৈরী করে।
নাতি বড় হওয়ার পর ফুলবানুকে বাড়ির ঝি’এর কাজ ছাড়তে বাধ্য করা হলো। ফুলবানু আর ঝিয়ের কাজ করেনা।
কিন্তু সব পাল্টে গেলো নাত বউ ঘরে আসায়। ফুলবানুর স্বামীর মতোই তার নাতির সেই একই অভ্যাস,একই নিয়ম ,একই অপমান, নিগ্রহ, একই কথা , এক সুর,একই আচরনে , একই গ্লানি আর নাতি বউয়ের একই রকম আর্তি। শুধু সময়টা পাল্টেছে , পরিস্থিতি পালেটছে। সেদিন ফুলবানুর যা ‍কিছু করার ছিল না ,আজ সে পারছে, পারবে। এবার আর তার মতো করুণ পরিনতি হতে দেবেনা নাতী বউ জোসনার। বাড়িটা লিখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ফুলবানু। ফুলবানুর উইল হবে জোসনার নামে। তার মানে জোসনা ফুলের উইল।
ফুলবানুর কথা শুনে বুঝলাম যে , ফুলবানু কারো ভালোবাসা না পেতে পেতে না পাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি আর কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাদঁছি না। ভরসাও করছি না। সে জোসনাও নয়। এখন শুধু সবার জীবনের জন্য আগুনের ফুলকি হয়ে থাকবো। আর জোসনার জন্য শুধু সূর বলয় হয়ে থাকবো।