ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের ৩ বছরের প্রকল্প শেষ হলো না আট বছরেও

আপডেট: মার্চ ১৪, ২০২২
0

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ১৪ কিলোমিটার রেলপথটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ১৮৮৫ সালে এই রেলপথটি নির্মাণ করে তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। তখনই রেলপথটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনে উন্নতির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।

ওই পরিকল্পনার ১২৯ বছর পর প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ এই প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথাছিল। কিন্তু তা চলছে ৮ বছর যাবত।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে বাকি কাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রেলপথে চাষাঢ়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকার মাত্র দশমিক ৫১ একর বা ৩১ কাঠা জমি রেলপথটি ডাবল লাইন করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমিটি রেলওয়েরই অধিগ্রহণ করা ছিল। এখন বেহাত হয়ে চলে গেছে ব্যক্তি মালিকানায়। এই জমি সংকটে ২ কিলোমিটার অংশ ডাবল লাইন না করে প্রকল্প সমাপ্তের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) থেকে দশমিক ৫১ একর জমি না পাওয়ার চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল লাইন রেখেই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। তাই ৬৩২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয় করেও রেলপথটির ডাবল লাইনের সুবিধা পাবে না বলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. সেলিম রউফ এ প্রতিবেদককে বলেন, চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এই রেলপথের ডাবল লাইন করতে হলে দশমিক ৫১ একর জমির প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাছে এই জমি চাওয়া হয়েছিল। তারা তা দিতে চায়নি। এ নিয়ে একাধিকবার বৈঠক হলেও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই ওই অংশটুকু বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনকেই ডুয়েলগেজ করে প্রকল্প শেষ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে পুরো অংশ ডাবল লাইন না করলে এর তেমন সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে জানান তিনি।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, চাষাঢ়া থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত অংশে ডাবল লাইন করতে শূন্য দশমিক ৫১ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আর ওই অংশে বিভিন্ন স্থাপনাসহ সাত তলা ভবন রয়েছে। এসব জমি অধিগ্রহণের জন্য আরও প্রায় ১৩৩ কোটি ৫১ লাখ দরকার হবে।
এ নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে একাধিক বৈঠক করা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, প্রস্তাবিত জমি আগে রেলের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তবে পরে সিএস ও আরএস জরিপে এগুলো স্থানীয় জনগণের নামে রেকর্ড হয়ে যায়। তাই অধিগ্রহণকৃত জমি আবার অধিগ্রহণ করতে গেলে অডিট আপত্তি উঠতে পারে। আর চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। তবে ওই অংশটি ডুয়েলগেজ করা জরুরি দরকার। এক্ষেত্রে বিদ্যমান লাইনের ওই অংশটি ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে। ফলে চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জ অংশটি ডাবল লাইন হবে না।
তবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম রেললাইন। বর্তমানে ২৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। অল্প দূরত্বের এ রেলপথেই সবচেয়ে বেশি যাত্রী হয়। ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে সময় লাগে ৩০-৪০ মিনিট। তাই এই রেলপথটি ডাবল লাইন করার জন্য দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছিল যাত্রীরা। এখন যদি জমি অধিগ্রহণের জটিলতার কারণে চাষাঢ়া-নারায়ণগঞ্জ অংশটি ডাবল লাইন না করার সিদ্ধান্ত সঠিক নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ে কর্র্র্র্তৃপক্ষ জানান জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ প্রকল্পে চাষাঢ়া থেকে কিছু অংশ ডাবল লাইন করার জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছে না। রেলপথের বাম পাশে রেলওয়ে কিছু জমি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা ব্যক্তি মালিকায় রেকর্ড করা হয়েছে। এসব স্থাপনার মধ্যে পাকা বহুতল ভবন রয়েছে। এছাড়া ডান পাশে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সড়ক রয়েছে। সিটি করপোরেশনের কাছে জমি চাওয়া হয়েছিল। জমি না পাওয়ার কারণে বাস্তবতা বিবেচনা করে অংশটুকু বাদ দিয়ে ডাবল লাইন করা হচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে অস্বীকার করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন জমি দিচ্ছে না এ কথাটি সঠিক নয়। আমরা বলেছি ডান পাশের রাস্তার জমি নিতে হলে একটু সার্ভে করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এই সড়কে যানজট তৈরি না হয়। বাম পাশে রেলওয়ে নিজস্ব জমি আছে সেটা উচ্ছেদ করে নিতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা আরও সহযোগিতা করবো। এ নিয়ে একবার মিটিং হওয়ার পরে তারা আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি।
তিন বছরের প্রকল্প চলে আট বছর
ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার রেল লাইনকে ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মণে প্রকল্প নেয়া ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালে জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজের জন্য রেলপথটি ১৪ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ১২ কিলোমিটার করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ চার দফা বৃদ্ধি ও ব্যয় এক দফা বৃদ্ধি করা হয়। আট বছর যাবত চলছে প্রকল্পের কাজ। সর্বশেষ চলতি বছরে জুনের প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি)। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপানের অনুদানের অর্থ রয়েছে ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বাকি ১২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় করা করার কথা।
পরবর্তীতে প্রকল্পের ব্যয় ২৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৩২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৬৭ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। তবে প্রকল্পটির বাড়তি টাকা দিতে রাজি হয়নি জাপান সরকার। ফলে ৩৮৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তাই জমি জটিলতার কারণে ২ কিলোমিটার অংশ সিঙ্গেল লাইন রেখেই চলতি বছরের জুনের কাজ শেষ হবে বলে প্রকল্পের সূত্র জানায়।
ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে প্রকল্পের প্রকল্পের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (আরডিপিপি) উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পটি আওতায় বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণকাজ চলছে। নতুন ডুয়েলগেজ লাইনটি বিদ্যমান রেললাইনের চেয়ে অনেক উঁচু। এতে বিদ্যমান রেললাইন অসমতল হয়ে পড়বে। এতে স্টেশন, সেতু, প্লাটফর্ম ও লেভেল ক্রসিংয়ে জটিলতা বাড়বে। ফলে ট্রেন চলাচলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। আবার লেভেল ক্রসিংগুলোয় সাধারণ যানবাহন চলাচলেও সমস্যা সৃষ্টি হবে।
এ সমস্যা পরিহারে নতুন একটি প্যাকেজের মাধ্যমে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনটিও ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় কমলাপুর থেকে জুরাইন পর্যন্ত বিদ্যমান লাইনটি ডুয়েলগেজ করা হচ্ছে। বাকি অংশের মধ্যে জুরাইন থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করা হচ্ছে।
এছাড়া প্রকল্প এলাকায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনায় তিনটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) জন্য একটি দোতলা ভবন কাম ব্যারাক নির্মাণ, সরকারি রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) জন্য একটি দোতলা ভবন কাম ব্যারাক নির্মাণ এবং গেন্ডারিয়া থেকে চাষাঢ়ার মাঝে পাঁচটি গ্যাং হাট নির্মাণ নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান রেললাইনটি সংস্কারে কোন রক্ষণাবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু বাস্তব কাজ করতে গিয়ে কিছু অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়েছে। তাই সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান।
প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে রেলওয়ে সচিব ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর বলেন, যেকোন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছু যুক্তিসংগত কারণ আছে। দেখা যায় প্রকল্প নেয়ার আগে এক রকম পরিকল্পনা করে ব্যয় তৈরি করা হয়। কিন্তু বাস্তব কাজ করতে গিয়ে দেখা অনেক কিছু ঘাটতি দেখা যায়। তখন প্রকল্পের ব্যয় সমন্বয় করতে গিয়ে ব্যয় বাড়ানো হয়।