দক্ষ মাদরাসা শিক্ষক গড়ার কারিগর বিএমটিটিআই

আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২২
0

।। মোল্লা সালেহ ।।

বিএমটিটিআই। বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান যা বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে নিয়োজিত। গাজীপুর বোর্ড বাজার অবস্থিত বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে বিএমটিটিআই এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যার সুফলভোগী হলেন সমগ্র বাংলাদেশের মাদরাসার শিক্ষক।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ভারতীয় উপমহাদেশে মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস অনেক পুরানো। ১৭৮০ সালে ইংরেজ শাসক কর্তৃক কলকাতা আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সূচনা হয় মাদরাসা শিক্ষা ধারা। কালের পরিক্রমায় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে। অদ্ভুদয় ঘটে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটো রাষ্ট্রের। অতঃপর ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অদ্ভুদয় ঘটে। মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দাবি ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার ১৯৮০ সাল থেকে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষা ধারাকে এমপিওভুক্ত করে এবং ১৯৮৫ সাল থেকে দাখিলকে এসএসসি সমমান এবং ১৯৮৭ সাল থেকে আলিমকে এইচএসসি সমমান প্রদান করে। ২০০৬ সালে ফাজিল শ্রেণিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া হয় এবং ডিগ্রির মান প্রদান করা হয় আর কামিলকে দেয়া হয় মাস্টার্স এর মর্যাদা।

মাদরাসা শিক্ষার মার্যাদা অর্জনের বিভিন্ন দাবি ও আন্দোলনের পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষকদের গুণগত মান ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট/কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দীর্ঘদিন ধরে দাবি চলে আসছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বাংলাদেশের শিক্ষার মান উন্নয়নের যে কয়েকটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল তাদের প্রত্যেকটিতে মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রতি গুরত্বারোপ করা হয়। প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ১৯৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার গজীপুর বোর্ড বাজারে সাবেক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ইউনিটের জন্য যে জায়গাটি বরাদ্দ ছিলো সেই জায়গাটি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড এর ব্যবস্থাপনায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে “মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট শীর্ষক প্রকল্প” এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালে বিএমটিটিআই এ প্রকল্পের অর্থে মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য সর্বপ্রথম প্রশিক্ষণ কোর্স আরম্ভ হয় । অতঃপর এই ইনস্টিটিউটে অক্টোবর-২০০২ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরম্ভ হয়। ২০০২ সালে সর্ব প্রথম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডর অর্থায়নে প্রশিক্ষণ কোর্স চলতে থাকে। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম রাজস্ব বাজটে বিএমটিটিআই এ প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ২০০৩ সালে সরকার মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এর নামের পূর্বে বাংলাদেশ শব্দ যুক্ত করার জন্য আদেশ জারি করে । সেই থেকে প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট যা সংক্ষেপে বিএমটিটিআই নামে পরিচিত। ২০১২ সেশন থেকে মাদরাসা থেকে যারা ফাজিল পাস করেছেন কিংবা বিএ পাস করেছেন তাদের এক বছর মেয়াদী চাকুরীপূর্ব প্রশিক্ষণ কোর্স তথা “ব্যাচেলর অব মাদরাসা এডুকেশন” (বিএমএড) কোর্স আরম্ভ হয়।

প্রতিষ্ঠিত পরবর্তী সময় হতেই বিএমটিটিআই মাদরাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে আসছে । বর্তমানে বিএমটিটিআই যে সকল প্রশিক্ষণ কোর্সগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে সেগুলো হল; আলিম/ফাজিল/কামিল স্তরের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ এবং দাখিল স্তরের সুপার ও সহকারী সুপারদের জন্য ১৯ দিন ব্যাপী শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কোর্স। ইবতেদায়ী প্রধানদের জন্য ১২ দিন ব্যাপী শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কোর্স। আলিম/ফাজিল/কামিল স্তরের প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপকদের জন্য ২৬ দিনব্যাপী বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স। দাখিল স্তরের সহকারি শিক্ষকদের জন্য ২৬ দিন ব্যাপী বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স। এবতেদায়ী স্তরের সহকারি শিক্ষকদের জন্য ৫ দিনব্যাপী বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স। এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যাচেলার অফ মাদরাসা এডুকেশন বা বিএমএড কোর্স চালু রয়েছে ।
বর্তমান বাংলাদেশের দুই ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে একটি আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ও অপরটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। কালের বিবেচনায় প্রথম কওমি মাদরাসা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ৮৬ বছর পর ১৮৬৬ সালে। কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এদেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমান ও ত্যাগী আলেম-ওলামাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। অপরদিকে আলিয়াা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ফলস্বরূপ কওমি মাদরাসা আলিয়াা মাদরাসার পরে প্রতিষ্ঠা পেলেও প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত তাদের কারিকুলাম অবিকৃত রয়েছে। কিন্তু বিপরীতে আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা শুরু থেকেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কারণে কালে কালে সরকারের পরিবর্তনের সাথে সাথে আলিয়া মাদরাসার কারিকুলামে বারবার এসেছে পরিবর্তন। ফলে আলিয়া মাদরাসার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে হোঁচট খেতে হয়েছে বারবার। উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ধারা হয়েও আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থা মূলধারা শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারেনি বরং সময়ে সময়ে আলিয়াা মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা অবহেলিত ও উপেক্ষিত থেকে গেছে।

বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগ জনগোষ্ঠী মাদরাসা শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী কে বাদ দিয়ে এ দেশের উন্নয়ন সম্ভব না। তাই বর্তমান সরকার মাদরাসা বান্ধব নীতিমালা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। মাদরাসার এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মাদরাসা শিক্ষা প্রতিযোগিতামূলক যথার্থ ও মান নিশ্চিতকরণে সরকার কর্তৃক ২০১৫ সালে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর নামে একটি নতুন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের অংশহিসেবে এই অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দক্ষ শিক্ষকের কোন বিকল্প নাই। আর শিক্ষকদেরকে দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণ অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে বিএমটিটিআই। মাদরাসা শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলছে। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্তে¦ও বিএমটিটিআই তার স্বকীয়তার পরিচয় দিচ্ছে এবং ৩০ ভাগ জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। একটি দেশের বৃহৎ অংশকে পিছে ফেলে রেখে কখনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মূলধারার জনগোষ্ঠির সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারব আমাদের কাক্সিক্ষত সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।

লেখক- মোল্লা সালেহ, প্রভাষক বিএমটিটিআই, গাজীপুর।