দেশে ৬৩ % নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার

আপডেট: নভেম্বর ২৮, ২০২২
0

২৭ নভেম্বর, ঢাকা :

একশনএইড বাংলাদেশ-এর ২০২২ সালেকরা একসমীক্ষা অনুসারে, ৬৩.৫১% নারী উত্তরদাতারা বলেছেন তারা অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়েছেন, গত বছরে যা ছিল৫০.১৯%। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৬৪ জন নারী অনলাইন হয়রানি ও সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয় ।
দেশে অনলাইন সহিংসতার হার জানার জন্যএকশনএইড বাংলাদেশএই সমীক্ষাটি পরিচালনা করে। এই সমীক্ষাটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারীদের দ্বারাঅনুভূত বিভিন্ন ধরণের সহিংসতা এবং হয়রানি চিহ্নিত করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং এর পেছনের মূল কারণ এবং অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে সচেতনতার জন্য বিভিন্ন পন্থা উপস্থাপন করে।

১৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে রবিবার ,২৭ নভেম্বর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতাঃ বাধা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
সাতক্ষীরা , সুনামগঞ্জ , পটুয়াখালী, বান্দরবান , কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাট – এই৬ টি জেলায় একটি অনলাইন জরিপের মাধ্যমে এই সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়, যেখানে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩৫৯ জন নারী অংশগ্রহণ করেন।

সমীক্ষায় বলা হয়, ২০২২ সালে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যে নারীরা বেশিরভাগই ফেসবুকে (৪৭.৬০%), ম্যাসেঞ্জারে (৩৫.৩৭%), ইনস্টাগ্রামে (৬.১১%), ইমোতে (৩.০৬%), হোয়াটসঅ্যাপে (১.৭৫%) এবং ইউটিউবে (১.৩১%) অনলাইন সহিংসতার সম্মুখীন হয়।’অন্যান্য’ মাধ্যমে ৪.৮০% নারী বলেছেন তারা ভিডিও কল, মোবাইল ফোন এবং এসএমএস এর মাধ্যমে হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন।
এই বছরের সমীক্ষায় দেখা গেছে ৮০.৩৫%নারী অনলাইন সহিংসতার মধ্যে ঘৃণ্য এবং আপত্তিকর যৌনতাপূর্ণ মন্তব্য, ৫৩.২৮% নারীইনবক্সে যৌনতাপূর্ণ ছবি গ্রহণ এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব,১৯.১৭% নারী বৈষম্যমূলক মন্তব্য এর শিকার হয়েছেন।১৭.৪৭% উত্তরদাতারা বলেছেন যে তাদের নামে অন্য কেউ অনলাইনে নকল আইডি তৈরির ফলে হয়রানির শিকার হয়েছেন, ১৬.১৬% বলেছেন যে তাদের কার্যকলাপ সবসময় সাইবার স্পেসে অনুসরণ করা হয় এবং ১৩.১০% সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন, ১১.৭৯% বলেছেন তাদের ব্যক্তিগত ছবি অনুমতি ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করা হয়েছে এবং ১১.৭৯% যৌন নিপীড়নের হুমকি পেয়েছেন।
৩.০৬% উত্তরদাতাদের মতে, যৌন নিপীড়নের সময় তাদের ছবি তোলা বা ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল এবং সেগুলো পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়েছিল। ২.৬২% উত্তরদাতা বলেছেন যে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি গোপনে পোস্ট করা হয় এবং পরে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের হুমকি দিয়ে অর্থের জন্য ব্ল্যাকমেইল করা হয়। ১.৭৫% বলেছেন যে তাদের ছবি সম্পাদনা করে পর্নোগ্রাফি সাইটে প্রকাশ করা হয়।
সমীক্ষা মতে, অনলাইন সহিংসতার কারণে নারীদের জীবনে সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব হলো মানসিক আঘাত,হতাশা এবং উদ্বেগ (৬৫.০৭%), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রভাব হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকা বা মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আস্থা হারানো (৪২.৭৯%)। ২৫.৩৩% ট্রমার শিকার হয়েছেন এবং ২৪.৮৯% আত্মমর্যাদা হারিয়েছেন।সমীক্ষায় আরও প্রকাশ করা হয়েছে যে অনলাইন সহিংসতা এবং হয়রানির কারণে সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা নারীর আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করছে।

সমীক্ষায় আরও বলা হয়, ১৪.৯১% নারী অনলাইন সহিংসতার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছেন এবং ৮৫% এরও বেশি ভুক্তভোগী কোন অভিযোগ জমা না দিয়ে নীরব ছিলেন যদিও তারা বিভিন্ন উপায়ে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন।অভিযোগকারীদের মধ্যে, ৪৪.১২% সোশ্যাল মিডিয়া রিপোর্টিং এর মাধ্যমে, ২০.৫৯% পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন-এর ফেসবুক পেজের মাধ্যমে, ১১.৭৬% জাতীয় জরুরি পরিষেবা (999) এর মাধ্যমে, ১১.৭৬% নিকটস্থ থানায়, ৫.৮৮% সাইবার ক্রাইমের ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সিটিটিসি ও ডিএমপি এর মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সমীক্ষায় আরও প্রকাশ করা হয় যে বেশিরভাগ নারী মনে করেনবিদ্যমান অভিযোগের প্রক্রিয়াগুলি কার্যকর নয়। তাই, তারা কোনো অভিযোগ (২৮.৮৭%) জমা দিতে আগ্রহ দেখাননি । ৬৪.৭১% উত্তরদাতারা তাদের জমা দেওয়া অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার বা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখেননি। সামাজিক কলঙ্ক, ভুক্তভোগী দোষারোপ এবং গোপনীয়তা হারানোর ভয়ে ৭৫.৭৭% নারী অনলাইনের মাধ্যমে বেনামে অভিযোগ করতে চান।
৫৬.৫৫% উত্তরদাতা আরও বলেছেন যে তারা অনলাইনে সহিংসতা এবং নারীর প্রতি হয়রানির বিষয়ে কোনো সচেতনতামূলক প্রচারণা দেখেননি। ৭৩.০৯% বলেছেন যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা পর্যবেক্ষণ করেছেন, ৩৫.৩৪% টিভি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, ২০.০৮% ইনফ্লুয়েন্সারের মাধ্যমে এবং ৭.৬৩% সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেসচেতনতামূলক কার্যক্রম দেখেছেন।
সমীক্ষা মতে, ৩৬.৭৯% প্রচারাভিযান বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবংকর্পোরেট, ৩৩.৪৯% বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং২২.১৭% সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছে।
সমীক্ষায় উত্তরদাতারা অনলাইন হয়রানি, অপব্যবহার এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দ্রুত শাস্তির পরামর্শ দিয়েছেন । এছাড়াও অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা, প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার প্রতি অভিমত দিয়েছেন সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা।
সমীক্ষায় বলা হয় নারীরা অনলাইন ব্যবহার এবং সুরক্ষা প্রোটোকল সম্পর্কে সচেতন নয় যদিও তারাঅনলাইন সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছেন।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীরা মোবাইল ফোনের মালিক নয়, তারা তাদের বাবা-মা বা বড় ভাই-বোনের ফোন ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, যা তাদের হয়রানি নিয়ে কারও কাছে মুখ খুলতে না পারার একটি প্রধান কারণ।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীরা ডিজিটাল সাক্ষরতায় পারদর্শী নয়, এমনকি তারা জানেন না কোথায় অভিযোগ জমা দিতে হবে এবং অনলাইন হয়রানি এবং সহিংসতা সংক্রান্ত কোনও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রযুক্তিগতভাবে কী করতে হবে।

একশনএইড বাংলাদেশএর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “নারীরপ্রতি সহিংসতা নতুন কিছু নয় এবং এটি এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে বিদ্যমান রয়েছে। পরিবার, সামজ, রাষ্ট্র-প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন হচ্ছে এবং এর নানা রকম বহিঃপ্রকাশহচ্ছে।এর নতুন এক মাধ্যম হলো অনলাইন, এই প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে নারীদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । বিশেষ করে কিশোরী ও১৮ বছরের নিচের কন্যা শিশুরা এর শিকার বেশি হচ্ছে। সবাই একত্রিত হয়ে কাজ করলে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব”।
অনলাইন সহিংসতা নিরসনে আইনী প্রক্রিয়ার জোরদারের পাশাপশি প্রযুক্তিগত সহায়তা বেশি দরকার বলে অভিমত প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর আইন অনুষদ এর সহকারী অধ্যাপকতাসলিমা ইয়াসমিন।

মোহাম্মদ সাইফুল আলম খান, প্রকল্প পরিচালক, সরকার ও ডিজিটাল সাক্ষরতা কেন্দ্র প্রকল্পের জন্য নিরাপদ ইমেইল, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), আইসিটি বিভাগ বলেন, “সরকার ২০২১ সালে ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার স্থাপন করে । এখান থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল লিটারেসি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। অভিভাবক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ডিজিটাল লিটারেসি ও সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগও রয়েছে ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টারে”।
আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সাদাত রহমান উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশে অনলাইন হয়রানির কারণে গত ২ বছরে ১১ জন তরুণী আত্মহত্যা করেছে। কিশোর-কিশোরীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু তারা জানে না কীভাবে সহায়তা পেতে হয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং অন্যান্যস্টেকহোল্ডারদের সহায়তা ব্যবস্থাকে আরওসহজলভ্য করতে হবে।”
তৃষিয়া নাশতারান, প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক, মেয়ে নেটওয়ার্ক;ডাঃ আশিক সেলিম, লিড কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাইকোলজিক্যাল হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক; ফাতিমা তুজ জোহারা , স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক কালের কণ্ঠআলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন।
সেশনে ডিজিটাল সাক্ষরতা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উপযুক্ত নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীদের নিরাপদ প্রবেশ নিশ্চিত করার বিভিন্নউপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়। বক্তারা প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু এবং কার্যক্রমে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিও আহ্বান জানান।