‘দেশ ও জাতির স্বার্থে কোনো বিভাজন-ই কাজে আসে না’

আপডেট: নভেম্বর ২১, ২০২২
0

সিলেটের গনসমাবেশ ও একটি পর্যবেক্ষনঃ

ডা.জাকারিয়া চৌধুরী

১৭ তারিখ সন্ধ্যায় সিলেট স্টেশনে যখন ট্রেন থাকে নামি তখন চোখে মুখে অন্ধকার, আতংক আর ভয় কাজ করেছে। কেন করেছে তা বলে খুব বেশি কাজ নেই ! সিলেটিরা যার জন্য যেমন পরিবেশ দরকার তেমনি-ই আয়োজন রেখেছে। শুকরিয়া বলে শুকরিয়ার সমাপ্তি টানতে চাই না। আমি মুখে মাস্ক লাগিয়ে গেঞ্জির উপর ঢোলা শার্ট পেচিয়ে একটা হোন্ডায় চেপে কোন এক বাসায় চলে গেলাম জানি না। জিগেসও করিনা। এত জেনেই বা কাজ কি !! আর যারা আমার অপেক্ষায় ছিল তাদের সাথে আমি কোনো যোগাযোগ না করে-ই পালাই। সবাইকে নিয়ে একসাথে বের হবার সাহস আর আমার অবশিষ্ট ছিল না। ট্রেনে টানা ছয় ঘন্টা হয়রানির শিকার হয়েছি। যখন সিলেটের উদ্দ্যেশ্যে কুমিল্লা ছাড়ি তখন আমার ফাস্টিং গ্লুকোজ লেভেল ১১ এবং হিমোগ্লোবিন মোটে ৯ মাত্র।

মহাসমাবেশের আগে ১৮ তারিখ রাত আনুমানিক সাড়ে আটটাঃ

মোটর সাইকেল খুব ধীরলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঈদগা মাঠের চারপাশ ঘিরে। খেয়াল করলাম সেখানে সিলেট #সিটি_কর্পোরেশনের দুটি মোবাইল বাথরুম স্থাপন করা হয়েছে। দুটো-ই এসি ( এসি এবং মোবাইল বাথরুম বাংলাদেশে সহজ ভাবলে হবে না )। দুটি পানির লড়ি উইথ কন্টেইনার ফিল্ড ওয়াটার। জিগেস করলাম সিটি কর্পোরেশনের হর্তাকর্তা কেউ আছে নাকি ? তা না হলে পরিচ্ছন্নতার এমন সুন্দর ব্যাবস্থা ! যিনি আমার বাইক চালাচ্ছেন তাকে আগে-ই বলে রাখা হয়েছে যে, আমি কারো পরিচিত হতে চাইনা। কে কোন গ্রুপের লোক আমাকে যেন না জানায়। উত্তরে উনি বললেন – এটা #আরিফুল_সাহেবের কাজ। মনে মনে তাকে শুকরিয়া জানালাম। এটা খুব জরুরী একটা বিষয়। লড়ি তিনটি রাখা আছে মাঠের পশ্চিম পাশে আলিয়া মাদ্রাসা রোড়ের উপর – একটা সাময়িক ব্যাবস্থা হিসেবে।


উত্তর পাশের সড়ক ধরে বাইক এগিয়ে যাচ্ছে পায়ে পায়ে। চোখে পড়ল #বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম নির্যাতিত সদস্য জনাব সালাহ উদ্দিন সাহেবের বিশাল বড় প্ল্যাকার্ড। এখানে সালাহউদ্দিন সাহেবের এত বিশাল বড় প্যানাফ্লেক্স কেন ? উত্তর এলো – এটা পার্টি অফিস। এই পার্টি অফিসের প্রায় পুরোটা জুড়ে উপর থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদের ছবি দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। সিলেটের মানুষের বিশালত্ব সম্পর্কে আমাকে আলাদা করে বলার কিছু নেই। বরিশালে খাবার হোটেল গুলো আমাদেরকে ক্ষুধার্ত রেখেছিল। তারা দাম নিয়ে গলা কাটছিল। তারা তো জানেনা, এদেশের মানুষ এখন পথে নেমেছে। পথে মরবে ; একরাশ লজ্জা নিয়ে ঘরে ফিরে অপরাধীদের কাছে আত্মসমর্পন করবে না। ফরিদপুরের জনসমাবেশ ছিল শহর থেকে বহু দূরে। এত দূরে যে, এক কাপ চা খেতে আমাকে ১২০ টাকা রিক্সাভাড়া গুনতে হয়েছিল। আর সেটা শহরের বাইপাস মোড়। শহর কত দূরে কে জানে !! কিন্তু ওখানে হরিজন সম্প্রদায় খেলা দেখিয়ে দিল। সারা রাত তারা নাচা গানা করল। ঢোল কিংবা বাশের বাঁশির সুরে আমি আক্রান্ত হয়ে গেলাম। অন্যদিকে ঢাকা উত্তরের যুবদল সভাপতি এবং কেন্দীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মিল্টন ভাই স্টেজ ঝাড়ু দিলেন। টুকু ভাই, ইসহাক ভাই, বাবুল ভাই সারারাত স্টেজে বসে থেকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন মানুষ গুলোকে জাগিয়ে রাখলেন। সারারাত মাঠে থেকে কাজ তদারকি করলেন কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জনাব শহিদুল ইসলাম খান বাবুল।

তো, কমরেডস যা বলছিলাম। চলুন এবার সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে ঢুকে পরি। সেখানে ছিল নতুনত্ত্ব এবং প্রয়োজনীয় কিছু কাজ। পুরো মাঠের চারপাশ শামিয়ানায় ঘিরে ফেলা হলেও বাউন্ডারি থেকে ভিতরের দিকে কুড়ি পচিশ ফিট শামিয়ানার ছাউনি দেয়া হল। ফলে এতে করে চারপাশটা একটা ইউ শেপ ধারন করল। সেট আছে মুখোমুখি। মাঠ উন্মুক্ত রইলো । খুব স্ট্যান্ডার্ড ভীত সম্বলিত স্টেজ করা হলো। স্টেজ এবং উন্মুক্ত প্রান্তরকে কাভার করা যায় এমন একটা মিনি মঞ্চ গড়া হলো মিডিয়া কর্মীদের জন্য। এটা নজরকাড়া একটা ভিত্তি। মিডিয়াকে সঠিক জায়গা না দিলে মিডিয়া আপনজন হয় কি করে ? আমি একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে উঠলাম, চারপাশের প্যানারমিক ভিও দেখলাম, স্টিল ছবি নিলাম। মঞ্চের ডান পাশেই ড্যাব এবং জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের অফিস। সবাই কর্মব্যাস্ত। ডাঃ কাকন ভাইকে না দেখে একটু মনটা খারাপ হল। আবার সময় মত কাকন ভাইও তাঁর টিমের সরব উপস্থিতি ছিল আশা জাগানিয়া।

ড্যাবের পর আছে যুবদলের অফিস। সেখানে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে ক্যামেরায় কথা বলছেন যুব সম্রাট ও যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মানিত সভাপতি জনাব সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ভাই। ডান পাশে মোনায়েম মুন্না ভাই, বা পাশে আছেন মামুন হাসান ভাই। ইসহাক সরকার ভাই চুপচাপ হাসিমুখে বসে আছেন। আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে টুকু ভাইয়ের বক্তব্য শুনলাম। তারপর কথা বললেন মোনায়েম মুন্না ভাই। এ সময় বাইরে থেকে শীর্নকায় একজন যুবক ঢুকতে ঢুকতে বললেন ,এভাবে সবাই যদি চেপে ধরে রাখেন নেতারা অক্সিজেন সংকটে ভুগবেন। জিগেস করলাম –কে ইনি। উত্তর এলো ইনি-ই মকসুদ ভাই। সিলেট যুবদলের নির্বাচিত সেক্রেটারি। খুব ভালভাবে তাঁর বডি ল্যাংগুয়েজ এবং কনফিডেন্ট কথাবার্তা শুনলাম। ভাল লাগল, খুবই ভালো লাগলো। সিলেটে শক্তিশালী তরুন নেতা আছে। তাঁর সাথে পরিচয় নেই, কথাবার্তাও হয়নি। তবু মনে মনে দোয়া করলাম। মকসুদ ভাই দীর্ঘজীবি হোন। এ জাতির জন্য আপনার ভুমিকা একদিন খুব কাজে আসবে। আরও সামনে এগিয়ে আসলাম। এখানে সুনামগঞ্জের ক্যাম্প। বিশাল লাউড স্পিকারে চলছে হাসন রাজার গান। পুরো মাঠের চারপাশে এভাবেই বন্টন করে দেয়া হলো জেলা ও উপজেলার জন্য নির্ধারিত ক্যাম্প। বিশৃঙ্খলা বাঁধার কোনো সুযোগ নেই। জেলা উপজেলার প্রতিটা ক্যাম্পেই চলছে বিক্ষুব্ধ মানুষের হাড় হিম করা জ্বালাময়ী বক্তব্য। কিছুক্ষন পরপর একেকটা মিছিল মাঠে ঢুকছে হাজার হাজার লোক নিয়ে। কেবল সুনামগঞ্জ থেকে-ই এসছে পাঁচ হাজার বাইক। ভাবা যায় !! আবাসন সংকট দূর করতে নেতারা অনেকেই তাদের বাসা খালি করে দিয়েছেন কিংবা যাদের বাসা খালি আছে সে বাসা খুলে দিয়েছেন। সিলেটের মানুষের আপ্যায়ন এক অনন্য অভিজ্ঞতা। যারা বহু আগে থেকে সিলেটের সাথে পরিচিত নন, তাদেরকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না।

মাঠের চারদিকে বসেছে হাজার হাজার ফেরিওয়ালা। কেবল ডাব ছাড়া সব ধরনের খাবার-ই ছিল ন্যায্য মুল্যের। আবাসিক হোটেলের ভাড়া ছিল নাগালের মধ্যে। সবচে বড় কথা যে দেশের জাতীয় নেতারা সাধারন আম জনতার পাশামাশি নিজেরাই নিজেদের মাদুর, চাদর বালিস বয়ে নিয়ে দেশময় ঘুরে বেড়ায় সেখানে আর ভয়ের কি আছে !! নিএনপি’র নেতৃত্বে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। মানসিকতায় এসেছে বড় কিছু করার স্বপ্ন। এ বিজয় এক দুই বছরের অনুশীলন নয়। বর্তমান এ প্রেক্ষাপটে আসতে বিএনপিকে প্রায় সাড়ে চার দশক পাড়ি দিতে হয়েছে। এসি থেকে বের হয়ে রোদে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া নেতারা এখন নানান দায়িত্বে আসছেন। দায়িত্ব পালন করছেন। মাঠেই নামাজ পড়ছেন। সকলের সাথে বন্ধুবৎসল গল্প করছেন। আজকের এ রাতটা দেখার আশায় কত সহস্র রাত আমরা অপেক্ষা করেছি আম জনতা হিসেবে। এ সফলতা জনগন ও নেতৃত্বের মাঝে একটা সুন্দর সেতু হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন দেশের যে কেউ যে কোনো সমস্যায় যেমন কেন্দ্রীয় সেলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন তেমনি প্রয়োজনে যে কোন পর্যায়ের নেতাকে ফোন দেয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। নেতারা মাঠে নেমে এসেছেন তো জনগন ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসেছেন। অসাধারন এক সিনক্রোনাইজেশন ইফেক্ট। এ সফলতা দমাবার শক্তি দুনিয়ার কোন দানবেরও নেই। অন্যদিকে সিলেট মহাসমাবেশের আয়োজক কমিটি ও জনগনকে জানাই আন্তরিক সম্মান ও ভালোবাসা। আপনারা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থে কোনো বিভাজন-ই কাজে আসে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক ,দেশ জনতা ডটকম