`নদী ভরা ঢেউ বোঝ নাতো কেউ’

আপডেট: অক্টোবর ৩০, ২০২২
0

লেখা : ডা.জাকারিয়া চৌধুরী

ভরসা করি এ ভব কাণ্ডারী
হালটি ছাড়িয়া এখন দাও দাও রে।

নদী ভরা ঢেউ বোঝ নাতো কেউ
কেন তরী নিজে বাও বাও রে
ভরসা করি এ ভব কাণ্ডারী,

জীবনটা এমনই নদীর মতো হাজারো বাকেঁ পরিপূর্ণ আমার। কত শত ঢেউ এসে্একটু একটু করে ভাঙছে আমায়। কেউ বুঝতে পারে না,কখন যে বিশাল ভাঙ্গন ধরে হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করেছে আমার। বলছিলাম তার কথা—– আমি তার আপন পুত্র ছিলাম না। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত একজন মানুষ ছিলাম। তার সান্নিধ্যে আসবার বহু পর আমার এ উপলব্ধি আসে যে, পিতা ও জনকের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তিনি একই সাথে পিতা ও জনক হতে পেরেছিলেন। এটা খুব আনন্দের যে, একই সাথে পিতা ও জনক হয়ে আমৃত্যু সেই অবস্থানে অটল থাকতে পারা। আপনি সে কাজটি করে গেছেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। তিনি মারা যাবার আগের বেশ ক’বছর তার সাথে আমার কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এতে তার সু-কর্ম গুলো কি মুছে যাবে ? নাকি যাওয়া উচিত ! প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ কর্মের ছায়া রেখে যায়। তিনিও তাঁর কর্ম আমাদের সামনে রেখে গেছেন। তাঁর কর্ম শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করার দায় আমার রয়েছে।

এই বাংলাদেশেই এমন শত শত পরিবার পাওয়া যাবে যাদেরকে সামান্য টাকা দিলেই কেউ একজন আমার জন্য একটা সন্তান ধারন করবে ( হোক, সেটা টেস্টটিউব বেইবি )। লোকলজ্জার ভয়ে কাজটা হয়তো গোপনেই করবে। কিন্তু সেই সন্তানের ডিএনএ তে জনক হিসেবে আমার নামই লেখা থাকবে। সেই লেখাটা হয়তো প্যাথলজিক্যাল ভাষায় হবে। এই তো ! তাই না !! কিন্তু সে সন্তানের পিতা হতে হলে বিষয়টা এভাবে ভাবলে হবে কি ? না মনে হয়। আমি বিশ্বাস করি, সেক্ষেত্রে আমার বৈধ স্ত্রী থাকতে হবে। আল্লাহর কাছে সন্তান প্রার্থনা করতে হবে। সে-ই সন্তানের জন্ম থেকে নিজের মৃত্যু অবধি তার পেছনে সব ধরনের ( যা কিছুতে তার মঙ্গল হয় তাই, যা কিছু অন্যের ক্ষতির কারন তা নয় ) কর্ম করতে হবে। শিশুর দুধ পান করানো, ন্যাপি পরিস্কার করানো, শিশুকে নিজের কাছে রেখে নব্য মা’কে রেস্ট নেবার পর্যাপ্ত সময় দান করতে হবে।

শিশু লালন পালন শিখতে হবে। একজন শিশুর জীবনের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক হবেন বাবা। মা নয় ( এটা আমার ব্যাক্তিমত। যার পছন্দ হবেনা তিনি এ লেখা পড়বেন না। ) একজন সু-পিতা কেবল তাঁর নিজের শিক্ষক-ই নয়, তাঁর মায়ে’রও শিক্ষক। পিতা তাঁর শিশুকে এ বিশ্বলয় চেনাবেন। আকাশ চেনাবেন, বাতাসের অস্তিত্ব স্বীকার করা উপলব্ধি করাবেন, সেই উপলব্ধি থেকে সে আস্তিকতা আর নাস্তিকতার পার্থক্য বুঝতে শিখবে। দান করা শেখাবেন, ভারসাম্য শেখাবেন। বোনের অধিকার কিভাবে বোনকে বুঝিয়ে দিতে হয় এবং তারপরও কিভাবে শকুনের মত বোনের ভালো মন্দের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় তা শেখাবেন। আরেকটু বড় হলে লাঞ্চিত মানুষ দেখাবেন। এই লাঞ্চনার প্রেক্ষাপট বুঝাবেন। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে সাথেই বাচ্চাকে এ চিন্তা করা শেখাবেন। কি, কেন, কিভাবে কিছু ঘটে সেসব আলাদা আলাদা করে ডিফাইন এন্ড এক্সপ্লেনেশন করা শেখাবেন।

ইতিহাস শেখাবেন। একটা পজেটিভ ভাবনা কিভাবে লালন করতে হয়, কেন দান করতে হয়, কেন মানুষকে ডেকে এনে খাওয়াতে হয়, কিভাবে কারো চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর অন্তর পড়তে হয় তাঁর বুনিয়াদি প্রশিক্ষন দেবেন একজন সু পিতা। সব শেষে এসে শেখাবেন প্রতিটা নিঃশ্বাস থেকে কিভাবে শিখতে হয়, কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়…………… চয়নিকা পড়াবেন, খনার বচন পড়াবেন, নীতি ও নৈতিকতা শেখাবেন এবং সেসবের অদম্য চর্চা নিজে করবেন, যেন সন্তান পিতাকে দ্বৈত চরিত্রে না দেখে।

এবার আসি মায়ের পালায়। মা সম্পর্কে এক লাইনে শেষ করব। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। এ কথা কেবল বিশ্বাসীদের জন্য প্রযোজ্য। এর মর্মার্থ্য কত বেশি সত্য ও পুরো জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় তা সন্তানের শিশু অন্তরে পাথরের মত ভারী করে ধরিয়ে দেবেন।

আমি গাঁও গেরামের ছোল। জন্মের পর থেকে ভাইয়ে ভাইয়ে কাটাকুটি, নিন্দে-মন্দ, গীবত গালাগালি খুন খুন খারাবি দেখে বেড়ে উঠেছি। যে সমাজে জন্ম নিয়েছি সে সমাজ থেকে মা আমাকে মাত্র ছয় বছর বয়সে-ই শহরে পাঠিয়ে দেন। আমার মা উচ্চ শিক্ষিত চিন্তাশীল নারী ছিলেন। শহরে এসে সর্বপ্রথম যে বিষয়টা খেয়াল করি সে হল নিজের অনেক কাজ নিজেকেই করতে হবে। এখানে মা নেই। বড় বোন আমাকে একেবারে বুকে নিয়ে আগলে রাখছে। তারপরেও শুন্যতা আছে। তাদের পড়ালেখা আছে, কলেজ আছে, প্রাইভেট আছে। বাবা সারাদিন টিউশনি করছে। বাসায় সবাই ব্যাস্ত আছে। আমার কোন ব্যাস্ততা নাই। স্কুল নাই, বন্ধু নাই। ঘরে টেলিভিশন নাই, ফিলিপসের একটা রেডিও আছে সেটা গ্রামের বাড়িতে। সে রেডিওটা-ই মায়ের একমাত্র সম্বল। রোজ রাতে সে বিবিসি’র নিউজ শুনেন, সেনাবাহিনী সদস্যের অংশগ্রহনে টেলিকাস্ট হওয়া অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’ শুনেন। এশার নামাজ পড়ে আমাকে নিয়ে ঘুমাতে যেতেন। শহরে এসে আবিস্কার করি, এখানে আম্মার গায়ের সুগন্ধ নেই। আম্মাকে ছাড়া ঘুমানো খুব কষ্টের ছিল। এখানে নিজেই নিজেকে ঘুম পাড়াচ্ছি। আমার কোনো কাজ নেই এখানে। ছোট ছোট হাড়ি পাতিল দিয়ে ভাত ডাল রান্না করছি, নিজের বিনোদন নিজেই বের করে নিচ্ছি। আপার ফেস পাউডার মাখছি। আপা চোখে কাজল দিয়ে দেয়, আমাকে ডাকে কাজল বলে। রাতে যখন খেতে বসি তখন আমার সারাদিনের রান্নাগুলো বের করি। সবাই হাসতে হাসতে ভিমড়ি খায়, আমি তাকিয়ে থাকি। আমার স্কুলিং শুরু হয় ক্লাস ফোর থেকে……… রাত দিন শুয়ে বসে থেকে তিন বছর পার করে স্কুলে ভর্তির অনুমতি পাই মায়ের অবিরাম আন্দোলনের কারনে। তিনি কিছুতেই আমাকে গ্রামে রাখবেন না। এত এত প্রেক্ষাপট কেন বললাম ? এর কারন হল, আজ যাকে নিয়ে লিখছি তাকে চিনি কমপক্ষে কুড়ি বছর। তিনি অন্তত এক যুগ আমাকে পিতৃ স্নেহ দিয়েছিলেন। আমাকে বাবু বলে সম্বোধন করতেন। তিনি সদ্য গত হয়েছেন। আমি কুমিল্লা থেকে দৌড়ে গিয়েও তাকে শেষবারের মত দেখার সুযোগ পাইনি। উঁচু পদে দীর্ঘদিন চাকুরি করেছেন। আমি প্রথম চার পাচ বছর বুঝতেই পারিনি তাঁর বাসায় ঠিক কখন বাজার হয়। ভোর হবার আগেই তিনি তাঁর বাজার সদাই শেষ করে ফেলতেন। এজিবি কলোনীতে এটা সম্ভব। অসম্ভব পরিশ্রম করে গেছেন শেষ পর্যন্ত। সন্তানদের কখনো মিডল স্ট্যান্ডার্ড খাবার খাওয়াননি। কারো কোন না পাওয়ার অভিযোগ আমি কখনো শুনিনি। কারো সাথে তাঁর কোন রকম বিবাদের কথা শুনিনি। ধর্মকর্ম করেছেন নিয়মিত। রিটায়ারম্যান্টের পরেও অন্তত পাঁচ বছর তিনি নানা জায়গায় চাকরি করেছেন। সাংসারিক খরচ চালিয়ে গেছেন এক হাতে।

কিছু সীমাবদ্ধতা হয়তো তাঁর ছিল। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকেই। এজন্যই তিনি মানুষ, কোন এঞ্জেল নন। কোন মৃত মানুষকে নিয়ে নেগেটিভ কথা বলা কখনো-ই শালীনতা নয়। আজ তো তাঁর শ্রদ্ধা পাবার দিন। গত রাতে গেঞ্জি খুঁজতে গিয়ে তাঁর শেষ সময়ে পরা একটা গেঞ্জি কিভাবে যেন পেয়ে গেলাম। আমি সেটা পড়লাম। চোখে পানি এসে গেল। আজ সারাটা দিন এটা পড়েই অফিস করেছি। আমার ছেলেটাও হয়েছে আমার মত। তাঁর সাথে দেখা হলেই সে আমার গায়ের জামা জুতো খুলে ফেলে। তারপর সেগুলো নিজে পরে আমার সামনে বসে থাকে। আমাকে খুশি করে। সে হয়তো ভাবে, বাবা নিশ্চয়ই খুশি হয়ে আমাকে দূরদেশে ঘুরতে নিয়ে যাবে। সেটা হয় না, হয়ে উঠেনা। তাঁর বাবা অন্তত ছয়বার নিশ্চিত হত্যা প্রচেষ্টা থেকে ভাগ্যজোড়ে বেঁচে যাওয়া মানুষ !

আমি তাকে নিয়ে বাইরে বের হবার সাহস করিনা। তাঁর শৈশব চলে যাচ্ছে আমার মত-ই বন্দী জীবনে। দেশটা যেদিন আবার নিজের পায়ে ঘুরে দাঁড়াবে, ফলপ্রসু স্বাধীনতা ফিরে আসবে, আমি সেদিন হয়ত তাকে নিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর যাব। বসন্তের শিমুল বাগান দেখিয়ে আনব। সনামগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে নেত্রোকোনা যাব। আমি সময়ের আগেই অবসর নেব। পরিবার পরিজনকে আমি আজতক কিছু দিতে পারিনি। তখন সময় দেব। নো ম্যাটার, তাদের সাথে আমার কোন পারিবারিক সম্পর্ক আছে কি নেই ! আমি তাঁর কাছে শিখেছি জনক আর পিতা সম্পুর্ন আলাদা আলাদা দুটো কনসেপ্ট। আমি জনক হওয়াকে ঘৃণা করতে শিখে গেছি। পিতা হয়ে উঠার অদম্য একটা লড়াই আমি দীর্ঘদিন চালিয়ে গেছি।

নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা মুর্খের দেশে, আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে, বিশাল, সুবিশাল একদল বেয়াদবের বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম সহজ ছিল না। আমি জানিনা যুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকব কিনা ! আমার জীবনের পাকে পাকে সামনে আসা বাধা গুলো সহজ ছিল না। এপাড়ে দাঁড়িয়ে বিরাট একটা নষ্ট দলের বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধ করেছি একা, ঠিক তেমনি জীবনের দ্বিতীয় পর্বেও এক দঙ্গল হিংস্র কুকুরের বিরুদ্ধে লড়ে গেছি একা একাই। আমার সারা শরীরে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন আছে। দগদগে সব ক্ষত। শারিরীক, মানসিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আজতক লড়েই যাচ্ছি। পেরে উঠছি কই !!

যাকে নিয়ে আজকের এই লেখা, তাঁর কর্মের প্রতি সুবিচার হয়েছে না অবিচার হয়েছে তাঁর জবাব দেবে ইতিহাস। আমি আমার পুর্ন ঋন স্বীকার করছি। তিনি এক সময় আমার মাথার উপর বট বৃক্ষের মত ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ এ কথা ভুলে গেলে, ইতিহাসে আমিও চন্ডাল অশোক হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আমার বিদ্বান ও ধর্মপরায়ন মা আমাকে খুব একটা ধার্মিক হয়তো বানাতে পারেননি। কিন্তু তিনি বিষবৃক্ষও রোপন করে যাননি। আমার প্রয়াত শশুড়, জনাব মাইনুদ্দিন হায়দার ! আপনি কি আমাকে দেখছেন ?

আমি অকৃতজ্ঞ নই, আমি আপনার জন্য কিচ্ছু করতে পারিনি, কেন পারিনি তা আপনারচে ভাল আর কে জানে !! আমার ব্যার্থতা আপনি ক্ষমা করুন। আপনার চলে যাওয়ার দিন বিকেল পর্যন্ত আমি আপনার বাসাতে-ই ছিলাম। আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি আপনি ঠিক কতটুকু অসুস্থ। আমাকে ক্ষমা করুন বাবা, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি আমার পুর্ন শ্রদ্ধা গ্রহন করুন। দেশের মানুষ হয়তো আপনাকে চেনে না, আমি তো চিনি। আমি-ই না হয় আপনার হয়ে ওকালতি করছি। আপনি একজন বেশ ভাল মানুষ ছিলেন। আমি এ কথা শেষ বিচারের দিনেও বলতে পারব। আল্লাহ আপনার সকল দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করুন। আমি প্রার্থনা করি, পরজগতে অন্ততঃ আপনি শান্তি পান, সম্মানিত একটা দ্বিতীয় জীবনে প্রবেশ করেন। আমিন।