না’গঞ্জে ভিক্টোরিয়ায় হাসপাতালে সাড়ে ১১ টা বাজলেই বন্ধ প্যাথলজি বিভাগ : রোগীদের ভোগান্তির চরমে

আপডেট: মে ১৫, ২০২২
0

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ : ৫ বছর বয়সী আরিফা ৭ দিন ধরে তীব্র জ¦র, ঠান্ডায় ভুগছেন। মেয়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গৃহকর্মী শিউলী বেগম তাকে নিয়ে হাসপাতালে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসেন প্যাথলজি বিভাগে। কিন্তু এখানে এসে পড়েন বিপাকে। প্যাথলজি বিভাগ বন্ধ। প্যাথলজি বিভাগের ল্যাব এটেনডেন্টরা তাকে জানান, রোগ নির্নয় পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। সোমবার (১৬ মে) সকালে আসার নির্দেশনা দেন। তখন ঘড়ির কাটায় ১১ টা বেজে ২০ মিনিট। এরপর পড়েন দালালের খপ্পরে। দালালের সাথে গিয়ে হাসপাতালের নিকটস্থ ইউনাইটেড ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে তিনগুণ মূল্যে মেয়ের পরীক্ষা করান। রোগীদের ভোগান্তির নিত্যদিনের এরূপ চিত্র নারায়ণগঞ্জ শহরের সরকারী জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া)। অন্যদিকে কমিশনের টাকায় পকেট ভারী হচ্ছে কতিপয় ডাক্তার ও দালালদের।
ওবিবার (১৫ মে) সকালে সরেজমিনে হাসপাতালের বহি.বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, চিকিৎসকের প্রতিটি কক্ষের বাহিরে রোগীদের লম্বা সিরিয়াল। যেখানে অধিকাংশ রোগীর হাতেই রয়েছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রোগ পরীক্ষার রিপোর্ট। যারা ডাক্তারের কাছে প্রথম ভিজিটে আসছে, তাদেরকে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে আশে পাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এছাড়া হাসপাতালের রোগ পরীক্ষার প্যাথলজী, রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘন্টা পূর্বে বন্ধ হয়ে যায়। সামর্থ না থাকা স্বত্তেও উপায় না পেয়ে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেই পরীক্ষা করাচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তির এই দৃশ্য দৈনন্দিনের। প্রতিদিন এই অনিয়মেই চলছে রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা। হাসপাতালে এই অনিয়ম যেন নিয়ম হয়ে উঠেছে।
হাসপাতালের প্যাথলজী, রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে দায়িত্বরত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট-ল্যাব এটেনডেন্টরা জানান, সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত প্যাথলজী বিভাগে রোগ পরীক্ষার স্যাম্পল গ্রহণ করা হয়। তারপর তারা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। রোগ পরীক্ষার অন্য বিভাগ গুলোতেও একই সময়ে টেস্ট করানো হয়।
হাসপাতালের সূত্রমতে, বহি.বিভাগে রোগী দেখার সময় সকাল ৮ থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। কিন্তু রোগ পরীক্ষার সময় মাত্র আড়াই ঘন্টা। হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে করার মেশিন নেই। তবে আলট্রাসনোগ্রামসহ অন্যান্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে পারছে না রোগীরা। রোগীদের অসয়াত্বের সুযোগে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করায় সুযোগসন্ধানী দালালেরা।
ভুক্তভোগী রোগী হাসান আহাম্মেদের অভিযোগ, বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে হাসপাতালের অনেকেই কমিশন পায়। এই হাসপাতালে আমার পায়ের অপারেশন করছি। এখন পর্যন্ত একটা টেস্টও হাসপাতাল থেকে করতে পারি নাই। ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট বলছে, হাসপাতালের টেস্ট ভালো না। বাহিরে থেকে করাতে বলছে। হাসপাতালের মানুষ কমিশন পায় বলেই তো বাহিরে পাঠায় টেস্ট করতে। কয়েক বারে প্রায় ৪ হাজার টাকার টেস্ট করা লাগছে। হাসপাতাল থেকে একটা সরকারি ঔষধও পাই নাই।
মেডিকেল টেস্ট বা প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় বহন করতে গিয়ে মধ্য ও নি¤œ আয়ের মানুষকে রীতিমতো চরম হিমশিম খেতে হয়। তারা চিকিৎসা খাতের জন্য সামান্য বাজেট বরাদ্দ রাখলেও অধিকাংশ সময়ই ব্যয় হয় বাজেটের দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধিকাংশই এখন একাধিক পরীক্ষা ছাড়া ওষুধ দিতে চান না। শতভাগ সঠিক রোগ নির্ণয় করতে হলে প্যাথলজি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ফলাফল জানা আবশ্যক। আর সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বাধ্য হয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন রোগীরা। কিংবা অর্থের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ইউনাইটেড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালের প্যাথলজী বিভাগে দাড়িয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা আজগর আলী। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ডাক্তার এক্সরেসহ আরো কয়েকটা টেস্ট দিছে। হাসপাতালের বাহিরে টেস্ট করাতে বলছে ডাক্তার। ইউনাইটেড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট দেখিয়ে বলেন, একটা টেস্ট করাইছি আরেকটার জন্য টাকা নাই। এখানে আসছি, ওনারা বলল বন্ধ করে ফেলছে আজকে আর টেস্ট করাইবো না।
আজগর আলীর পাশে অপর একব রোগীর স্বজন রিনা বেগম বলেন, ২৮০ টাকার টেস্ট হাসপাতাল থেকে করাইছি। আর ১ হাজার ৫০ টাকার টেস্ট বাহিরের থেকে করানো লাগছে।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এস কে ফরহাদের সঙ্গে হাসপাতালে এ প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে ও আলট্রাসনো করা যাচ্ছে না মেশিনের অভাবে। আমরা মেশিন আনার জন্য মন্ত্রাণালয়ে চিঠি দিয়েছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন উত্তর পাইনি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে রোগীদের বাহিরে টেস্ট করতে হচ্ছে। রোগ পরীক্ষা কেন সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত করানো হয়, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এমন তো হওয়ার কথা নয়। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মশিউর রহমান এই বিষয়ে বলেন, হাসপাতালে আলট্রাসনো, ইসিজি সহ অন্যান্য পরীক্ষাও হয়। আলট্রাসনোর মেশিন নষ্ট ছিল, সেটা ঠিক করানো হয়েছে। কোন পরীক্ষা ভিক্টোরিয়া হাপাতালে করানো সম্ভব না হলে, হাসপাতালের ডাক্তার যেকোন সরকারি হাসপাতালেও তাদেরকে রোগ পরীক্ষার জন্য রেফার্ড করতে পারবে। বাহিরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রেফার্ড করার প্রয়োজন নেই। ডাক্তার রেফার্ড করলে রোগীরা ৩০০ শয্যা হাসপাতালেও টেস্ট করতে পারবে।

এম আর কামাল
নারায়ণগঞ্জ
তারিখ ঃ ১৫-০৫-২০২২