নানান জটিলতায় ৩০ বছরের পুরানো মিরাকেল ইন্ডাষ্ট্রিজ বন্ধের মুখে : চাকরী হারিয়ে মানবেতর জীবন ১২ শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারীর

আপডেট: জুন ১৬, ২০২১
0

নিজস্ব প্রতিবেদক
পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতার অভাব,আর্থিক দৈন্যতা,দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সংকট,আনাড়ি হাতে একসাথেই অধিক কোম্পানী পরিচালনার ভার,বিদেশী চাহিদার পতন, প্যালিস্টিক নিষিদ্ধ হওয়ায় স্থানীয় বাজারে চাহিদা না থাকার ফলে প্রায় তিন দশকের পুরানো দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে চলেছে। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায় অবস্থিত মিরাকেল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন গত দুই বছর যাবত প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে ইতিমধ্যে এই বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মসংস্থান হারিয়েছে প্রায় ১২ শত শ্রমিক,কর্মকর্তা-কর্মচারী।তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।

এই রুগ্ন ও প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে পতিত শিল্প প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানোর আর্তি জানিয়েছেন। সরেজমিনে খোঁজ খবর ও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ঠদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,নতুন মালিক পক্ষ দেড় বৎসর পূর্বে মিরাকেল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডসহ একই সাথে ৪টি কোম্পানী ক্রয় করার ফলে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়ে পড়ে।এখন পর্যন্ত কোন কোম্পানীর শেয়ার হস্তান্তর করে নিতে পারে নাই। ৪টি কোম্পানির আলাদা আলাদা বড় অংকের ব্যাংক ঋন রয়েছে এবং ব্যাংক ঋন দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকে কোম্পানীর সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, এই ধরনের কোম্পানী চালানোর মত ন্যূনতম কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বর্তমান মালিক পক্ষের। ভাল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দক্ষ জনবন ছাড়া এই ধরনের ফ্যাক্টরী চালানো অসম্ভব। এসব অভিযোগ করেছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
তারা জানান, বিগত ২০১৯-২০২০ অর্থবৎসরের জন্য ডিসেম্বর’২০ কোম্পানী ১% লভ্যাংশ ঘোষনা করার পরও অদ্যবধি পুরাপুরি লভ্যাংশ পরিশোধ করতে পারেননি। এই কারখানা পুরাপুরি চালু করতে হলে প্রায় ৮-১০ কোটি টাকা নগদ বিনিয়োগ প্রয়োজন।অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় কাংখিত পরিমান নগদ অর্থ বিনিয়োগ করা নতুন মালিকের পক্ষে সম্ভব নয়। মিরাকেল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ মূলত দুই ভাবে তাদের উৎপাদিত পন্যবিক্রি করে। একটি হল স্থানীয় বাজারে যা বিসিআইসি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নিকট টেন্ডারের মাধ্যমে, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ইতিমধ্যেই বিসিআইসির বড় বড় টেন্ডার হয়েছে, টেন্ডারে বেশী মূল্য দেওয়াতে তাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। অপরদিকে বেশ কয়েক বৎসর আগে সব খাতে সরকার প্লাষ্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষনা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে এবং পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। যার ফলে স্থানীয় বাজারে প্লাষ্টিক বাগের চাহিদা কমে গেছে। মালিকানা পরিবর্তনের ফলে এবং এই ধরনের কারখানা চালানোর অতীত অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে বিদেশী যেকোন ক্রেতা নুন্যতম ট্রয়াল অর্ডার দিবে। যেখানে এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে কোভিড-১৯ এর কারনে প্রায় ৫০% অর্ডার কমে গেছে, যার কারনে ক্রেতাদের ক্রয় করার চাপ অনেক কম থাকবে। বাংলাদেশে অনেকগুলি একই ধরনের কারখানা হয়ে গেছে এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত দক্ষ জনবলের কারনে কোয়ালিটি প্রডাক্ট তুলনামূলক কম মূল্যে রপ্তানী করতে পারছে। আর্থিক সংকটের কারনে গত দেড় বৎসরে পর্য্াপ্ত অর্ডার না থাকায় ও সময়মত কাঁচামাল যোগান দিতে না পাড়ায় কারখায় উৎপাদন ক্ষমতার ১০/১২% এর বেশী করতে পারে নাই। অনেকেই সন্ধিহান এই অবস্থায় আদৌ কারখানা চালাতে পারবে কিনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকে কারখানায় কর্মরত একজন কর্মকর্তা বলেন, এই ফ্যাক্টরীকে লাভবান করতে হলে বিপুল পরিমান ভলিয়ম অর্ডার সংগ্রহ করতে হবে এবং অপব্যয় কমিয়ে ভলিয়ম প্রডাকশন করে গুনগত মান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে প্রতিযোগীতা মূল্যে অর্ডার সংগ্রহ করতে পারবেন।প্রতিষ্ঠানটির সংঙ্গে জড়িত একাধিক সুত্র জানিয়েছে যদি প্রতিষ্ঠানটি সবদিক গুছিয়ে বৎসরে ৮০-৯০ কোটি টাকা বিক্রয় করতে পারে তাহলে কোন রকমে খরচ সমান সমান হবে যা ৩য় বৎসর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থ বৎসরের আগে কোনভাবেই সম্ভব না।

এদিকে এক-দেড় বৎসরপূর্বে গত ২৮/১০/২০১৯ প্রতিষ্টানের শেয়ারের মূল্য ছিল ১৩.৫০ টাকা। উক্ত শেয়ারের মূল্য ২২/১২/২০২০ তারিখে ১৩.৫০ থেকে বেড়ে ৩৬.৪০ টাকায় উঠেছিল। বর্তমানে ৩৪-৩৫ টাকায় উঠা-নামা করছে। এ প্রসঙ্গে মিরাকেল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ এর কোম্পানী সচিব দেওয়ান মোহাম্মদ জাহিদ বলেন ফ্যাক্টরী একটা সময় রুগ্ন ছিল, ডিভিডেন্ড ফান্ডের ক্রাইসিস আছে যা শিগগিই কেটে যাবে। কোম্পানীর শেয়ার নিয়ে কেউ কেউ রিউমার ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, কেউ না কেউ খেলছে। এতে সাধারন বিনিয়োগকারীগন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এদিকে গত ২০১৯ সালে একটি শেয়ার হস্তান্তর এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির বিগ্রুপের শেয়ার ক্রয় করেন মেসার্স মেহমুদ ইকুইটিজ লিঃ এর নামে একটি প্রতিষ্ঠান যাহার কর্নধার ড. একেএম শাহবুব আলম। যিনি প্রথমে চাকুরী করতেন পরবর্তীতে শেয়ার মার্কেটে ব্যবসা করেন। বর্তমান বিগ্রুপের শেয়ার ১০% এবং বিসিআইসি ও ইহার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ২০% শেয়ার আছে। বিগ্রুপের ১০% শেয়ার মেসার্স মেহমুদ ইকুইটিজ লিঃ এর নিকট বিক্রি হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের সংগে জড়িত নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন,বর্তমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে মেসার্স মেহমুদ ইকুইটিজ লিঃ এর পক্ষে পর্যাপ্ত স্থানীয় ও রপ্তানীর কার্যাদেশ ব্যবস্থা করা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন পুনরায় চালু করা কঠিন বিষয়। তারা মনে করেন যদি নগদ প্রায় ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন, ব্যাংকের সাপোর্ট নিতে পারেন, যথাসময়ে পর্যাপ্ত অর্ডার সংগ্রহ, পর্যাপ্ত কাচামাল সংগ্রহ ও দক্ষ জনবল নিয়োগ ও নিখুত ব্যবস্থাপনায় কারখানায় উৎপাদন করতে পারেন তাহলে সম্ভাব্য সর্বোচ্ছ বিক্রয় করা যেতে পারে । যা অর্থ বৎসর ২০২১-২২ সালে সম্ভাব্য সর্বোচ্ছ বিক্রয়ের পরিমান ৩৫-৪০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ সালে সম্ভাব্য সর্বোচ্ছ বিক্রয়ের পরিমান ৫৫-৬০ কোটি টাকা প্রতি বৎসর টার্নওভার, উৎপাদন গ্রোথ অনুযায়ী সেল্স ৫০%। ২০২৩-২৪ সালে সম্ভাব্য সর্বোচ্ছ বিক্রয়ের পরিমান ৮০-৯০ কোটি টাকা প্রতি বৎসর টার্নওভার, উৎপাদন গ্রোথ অনুযায়ী সেল্স ৫০%। যদি উক্ত টাকা বিক্রয় করতে পারে তাহলে কোন রকমে খরচ সমান সমান হবে । ২০২৪-২৫ সালে সম্ভাব্য সর্বোচ্ছ বিক্রয়ের পরিমান ১০০-১২০ কোটি টাকা। প্রতি বৎসর টার্নওভার, উৎপাদন গ্রোথ অনুযায়ী সেল্স ৩৪%। যদি উক্ত টাকা বিক্রয় করতে পারে তাহলে সামান্য লাভ করা সম্ভব ।

প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রিপোর্ট/অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী গত ২০১৭-১৮ সালে ব্যাংক লোন ৩৭.৪১ কোটি, সুদ হয়েছে ৬.০৩ কোটি, বিক্রয় হয়েছে ৮৪.৪৩ কোটি, ইপিএস ১.০০, নেট এসেট পার ভ্যালু ৪১.৭১ টাকা। ২০১৮-১৯ সালে ব্যাংক লোন ৩৪.৬৪ কোটি, সুদ হয়েছে ৪.৯৩ কোটি, বিক্রয় হয়েছে ৬০.৬৪ কোটি, ইপিএস ০.২৩, নেট এসেট পার ভ্যালু ৩৮.৮৫ টাকা। ২০১৯-২০ সালে ব্যাংক লোন ৪১.১৫ কোটি, সুদ হয়েছে ৩.০২ কোটি, বিক্রয় হয়েছে ৯.২৯ কোটি, ইপিএস -৩.৬২, নেট এসেট পার ভ্যালু ৩১.৯৩ টাকা।
চলতি অর্থ বৎসর ২০২০-২১ এর ৩টি কোয়ার্টার ইতোমধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে এতে দেখা যায় যে, এর বিক্রয়ের পরিমান আরো কমেছে। চলতি অর্থ বৎসর ২০২০-২১ বিক্রয়ের পরিমান ১ম কোয়াটার ৬.৪৩ কোটি , ২য় কোয়াটার ২.৪২ (১ম ও ২য় প্রান্তিক রিপোর্ট অনুযায়ী) ৩য় কোয়াটারের তথ্য পাওয়া যায় নাই। ৪র্থ কোয়াটার, যেহেতু কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে তাই বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎপাদন পুনরায় শুরু করা কঠিন ।

খোজ নিয়ে জানা গেছে যে, প্রতিষ্ঠানটি গত ১৫/১০/২০২০ তারিখে প্রতিষ্ঠানের লিয়েন ব্যাংক শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ, গুলশান সাউথ এভিনিউ শাখা, ঢাকা এর নিকট বর্তমান লোন লিমিট ৫৭.৩২ কোটি হতে বাড়িয়ে ৭২.০০ (বাহাত্তর) কোটি টাকার ক্রেডিট সুবিধার আবেদন করেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক লোনের বার্ষিক সুদ (কম/বেশী) প্রায় ৬.০০ কোটি টাকা ও টার্ম লোনের কিস্তি বার্ষিক (কম/বেশী) প্রায় ৬-৭ কোটি টাকা অর্থাৎ (কম/বেশী) প্রায় ১২-১৩ কোটি টাকা। উক্ত লোন নিয়মিত রাখতে হলে প্রতিমাসে (কম/বেশী) প্রায় ১.০০ (এক) কোটি টাকার বেশী পরিশোধ করতে হবে যা কিনা বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব না।

কারখানার হেড গোলাম দস্তগীর পলাশ কে কারখানা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, আমি এসব কিছু জানিনা আমার কাজ হলো ফ্যাক্টরী চালানো। আমাদের কাছে কোন তথ্য থাকেনা। তিনি বলেন ফ্যাক্টরী দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল বিধায় আপডেট হতে সময় লাগবে। প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বিসিআইসির পরিচালক মিসেস জেসমিন নাহারকে ফোন দিলে তিনি বলেন আমি এখন মিটিং এ আছি। পরে কথা বলব। আপনি আমাদের প্রতিষ্ঠানের পিআরও এর সংগে কথা বলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিআইসি এর জিএম ও কোম্পানীর পরিচালক সুভাশিষ অধিকারী বলেন, শিল্প প্রতিষ্টানটি নানান জটিলতার মধ্যে রয়েছে। প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হওয়ার পরও কেন বড় আকারে শেয়ারের দাম উঠা নামা করছে, এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এভাবে শেয়ারের দাম বাড়া উচিৎ না। এতে শেয়ার হোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি আরও বলেন এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করবে, কেউ জড়িত থাকলেও তাদেরকে নজরদারীতে আনা হবে। কোম্পানীর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল মোরশেদকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায় নাই।
অপরদিকে অনেকবার বিসিআইসিকে পত্রের মাধ্যমে শেয়ার ট্রান্সফারের বিষয়টি জানানো হয়েছে যা কোম্পানীর বোর্ড সভায় মেসার্স মেহমুদ ইকুইটিজ লিঃ এর নামে শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কোম্পানীর অপর একটি বোর্ড সভায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ হতে এনওসি প্রাপ্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।পরবর্তীতে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ, গুলশান সাউথ এভিনিউ শাখা, ঢাকা এনওসি প্রদান করেন।
এ প্রসঙ্গে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ, গুলশান সাউথ এভিনিউ শাখার বর্তমান ম্যানেজার মাহবুব শামীম বলেন, আমি এ শাখায় নতুন এসেছি এখনও সবকিছু বুঝে উঠতে পারছিনা। আপনি ব্যাংকে আসেন তারপর কথা বলব। বিসিআইসির ম্যানেজার শামীম রানাকে ফোন দিলে তিনি জানান আমি বান্দরবনে আছি। মিরাকেল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ এর নানান সমস্যা আছে।

ইতিমধ্যে সাধারন শেয়ারহোল্ডারগনের পক্ষ থেকে ডিএসই ও সিকিউিরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন এর নিকট নালিশ করেছে যা এখন জটিল আকার ধারন করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানীর সিএফও ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমি একটা মিটিং এ আছি আপনাকে পরে ফোন দিব কিন্তু তিনি আর পরে ফোন দেন নাই।