নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা অর্জনে তথ্য ও প্রযুক্তির ভূমিকা বিষয়ক আলোচনা ‌:`অনলাইনে নারী বিদ্বেষী অপতৎপরতা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে’

আপডেট: মার্চ ২১, ২০২৩
0

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বৈশ্বিক শ্লোগান ” DigitALL: Innovation and technology for gender equality ’’ – এর আলোকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে (সুফিয়া কামাল ভবন, ১০,বি/১, সেগুনবাগিচা,ঢাকা)‘‘নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা অর্জনে তথ্য ও প্রযুক্তির ভূমিকা ’’-বিষয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. লাফিফা জামাল, প্রফেসর, রোবোটিক্স এবং মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ড. নোভা আহমেদ; প্রফেসর, ইলেকট্রিক্যাল এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আ.স.ম. হাবিবুর রহমান, ওয়েব ডেভেলপার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের তথ্য প্রযুক্তি কর্মকর্তা দোলন কৃষ্ণ শীল।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। উন্নয়নকে টেকসই করতে নারীসমাজকে সঙ্গে নিয়েই উন্নয়নের ধারায় অগ্রসর হতে হবে। আজকের দিনে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে তথ্যপ্রযুক্তিকে নারীমুক্তি ও জেন্ডার সমতার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ৫২.৫৮ মিলিয়নেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে যা আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১.৫ শতাংশ। উপরন্তু ৫৫.৮৯ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এবং তাদের বেশিরভাগই স্মার্টফোন ব্যবহার করে, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারের ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এ সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ডিজিটাল অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও বাড়বে। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ডিজিটাল বিশ্ব কে নারী-পুরুষ সকলের জন্য নিরাপদ, সহজলভ্য, সৃজনশীল, সহনশীল এবং মানবিক করে গড়ে তুলতে কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়: নারীর ক্ষমতায়নে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার এসডিজির ৫ নম্বর লক্ষ্য অর্জনে বাধাসমূহ দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; তথ্যপ্রযুক্তিতে গণনারীর সহজ অভিগম্যতা নিশ্চিতের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন পরিসেবাটিকে আরও গণনারীর কাছে পৌঁছানোর জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ব্যাপক প্রচার করা; নারীবান্ধব প্রযুক্তির বিকাশকে উৎসাহিত করতে সরকারকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। ইন্টারনেটের দাম কমাতে হবে; তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত ডিভাইজসমূহ সহজলভ্য করতে হবে। অনলাইনে গুজব, ভুলতথ্য ও মিথ্যা এবং নারী বিদ্বেষী, অপতৎপরতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং অনলাইনে হয়রানি ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারীরা যাতে সহজে অভিযোগ করতে পারে এবং প্রতিকার পেতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সামিনা চৌধুরী বলেন, কোভিডকালে টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে চারলক্ষ নারীকে সেবা দিতে সক্ষম হয়েছি। তরুণদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের কাজে লাগাতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স এবং মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. লাফিফা জামাল বলেন, প্রযুক্তি এখন মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর বিষয় নয়। এখন ব্যবহার কারীদের প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানের মত বিষয়ের পড়াশোনায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে তবে ছেলেমেয়েদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগে ক্ষেত্রে এখনো পারিবারিক বৈষম্য আছে। বিজ্ঞানে বায়োলজির মত শিক্ষায় নারীদের বেশি দেখা যায়, প্রকৌশল শিক্ষায় মেয়েদের উপস্থিতি কম। অনলাইন একসেস পাওয়ার ক্ষেত্রে জেন্ডার গ্যাপ আছে ২৯%। নিজেদের ভয়েজ রেইজ করতে হবে।

সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ডাটা সফট এর প্রতিষ্ঠাতা এ কে মাহবুব জামান বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং কোভিড পরি¯িথতি তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারকে আরো তরান্বিত করেছে। তথ্য প্রযুক্তিতে কাজের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আগে কম থাকলেও এখন বেড়েছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. নোভা আহমেদ বলেন, এখনো তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণে মেয়েদের উপস্থিতি কম। এর কারণ সামাজিক বাধা,প্রাতিষ্ঠানিক বাধা, নীতিগত পরিবর্তনের অভাব। সাইবার অভিযোগ ও সমস্যা সমাধানে থাকা জ্ঞানের ঘাটতি দূর করতে কাজ করতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধের জন্য নিজেদেরকে সচেতনভাবে মোকাবেলা করতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মূল ধারার সাথে যুক্ত করতে হবে।
ওয়েব ডেভেলপার আ.স.ম. হাবিবুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে যেয়ে দেখা গেছে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে লিঙ্গগত পরিচিতির চেয়ে কাজের দক্ষতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। অনলাইনে কাজের প্রসারের কারণে নারীদের বাইরে যাওয়ার বাধা নেই। নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ আছে কিন্তু তাদের উপস্থিতি কম। কেন নারীরা এখানে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন তা আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। গণনারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, আমরা একটা প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত বিশে^ বসবাস করছি। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের জন্য একটা আহ্বান। প্রযুক্তির সংকট ও সম্ভাবনা আছে , জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় প্রযুক্তির ব্যবহার কিভাবে হবে, নারীকে কিভাবে প্রযুক্তির সাথে যুক্ত করা যায় তা আলোচনার জন্য আজকের সভার আয়োজন করা হয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে। চাহিদার সাথে সাথে নারী আন্দোলনের স্লোগান বদলায়, করণীয় বদলায়। আজকে নারীরা এগিয়ে গেলেও অনেক সমস্যা আছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের নতুন দরজা উন্মোচিত হয়েছে। যখন কোন জিনিস পিছনে টানে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। ধর্মকে নারীর প্রতি বৈষম্যের টুলস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এজায়গায় করণীয় আছে। নারীর আন্দোলনের মূল কেন্দ্র নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তথ্য প্রযুক্তির ভ’মিকা নিয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে যে অমিত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তাকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান তিনি।
মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী নাবিল, আইটি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুর রহমান, তিলপা পাড়া কমিটির সদস্য মো ফাহিম, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী স্বর্ণ ও ইফতি ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইন্স সোসাইটির সহ-সভাপতি সানজিদা আফরিন; রিফা তাসনিয়া, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ফাহমিদা নাজনীন; ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাইরি জামান নিশু , ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষক সংগীতা আহমেদ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ড. সিউতি সবুর;
উক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দ. ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী, রোবোটিক্স এবং মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ; বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রাকের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী, প্রিন্ট ওইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক এবং সংগঠনের কর্মকর্তা সহ ১২০ জন উপস্থিত ছিলেন ।
সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের তথ্য ও প্রযুক্তি উপপরিষদ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম।