`নিজ ভুমি রক্ষা করতে আসুন, মা বোনের জিম্মাদার হয়ে আসুন’

আপডেট: নভেম্বর ২৪, ২০২২
0

কুমিল্লার মহাসমাবেশ এবং কিছু কথা-
Zakaria Chowdhury:

১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন তখন তুমুল জনপ্রিয়। এর সম্পাদক খোদ শফিক রেহমান। তিনি এই সাপ্তাহিক পত্রিকার শেষাংশে এসে মঈন – মিলার এক অদ্ভুত প্রেমের রসে পাঠককে যেন বেধে ফেলেন। তাদের কথোপকথনে আসে দেশের সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক কালচার সহ কত কত প্রসঙ্গ !! অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেখানে তিনি প্রকাশ করেন। আমার বয়েস কত ? এই মেরেকেটে ১৭ কি ১৮। মঈন – মিলার প্রেমাংশ পড়ি। ভালো লাগে। রাজনৈতিক আলোচনা প্রায়ই এড়িয়ে যাই। সব কথা মাথায় ধরে না।

সাপ্তাহিকটির উপ-সম্পাদক সম্ভবতঃ স্বদেশ রায়। তিনি সম্পাদকীয় আর্টিকেল লিখতেন। লোকটা ধর্মে হিন্দু। সে সময়ে আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম, আওয়ামী জমানায় কদ্দুর সাহস থাকলে এই রকম দ্বিধাহীন চিত্তে একজন হিন্দু লোক অবিরাম লিখে যাচ্ছেন !! বাব্বাহ, বাপের বেটা !!! সেই স্বদেশ রায় আজ জনকন্ঠে। বাপের বেটা। এখানেও বাপের বেটা। টোটাল রিভার্স একশনে আছেন। এটা তার বিষয়। ভাবি, একই মানুষ আজ যে কথা বলে সুনাম কুড়ালেন, সুনামের ব্যাগ ভর্তি হয়ে গেলে; কাল বেমালুম কিভাবে উলটো হয়ে যান !! সোজা কথা, সে সময়ের জনকন্ঠ আর যায়যায়দিনে’র নৈতিক ও মৌলিক পার্থক্য আসমান আর জমিন। এদের নিয়ে আর কিছু না বলি।

প্রেস নোটস নামে কয়েক পৃষ্ঠা লিখেন Shakhawat Hossain Sayanthaি।বাপ্রে বাপ ! পুরো সপ্তাহে দেশের যত নিউজ পেপারে যা কিছু ছাপা হত তার দাড়ি কমাও এই লোকের চোখ এড়ায় না। প্রয়োজনীয় সব নিউজকে তিনি ছুরি চালিয়ে হলেও এর সত্যাংশ মিথ্যাংশ আলাদা করে দিতেন। চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য কিভাবে, কোন যুক্তিতে আলাদা করে দেখতে হয়। অ্যানালাইসিস কিভাবে করতে হয় আমি সেই প্রাথমিক ধারনা লাভ করি সায়ন্ত ভাইয়ের চিন্তার সুত্র ধরে। জীবনে কিভাবে অবিরাম সয়ে যেতে হয় তা নিজ চোখে অন্তত দেড় যুগ ধরে দেখে আসছি একজন Maruf Kamal Khan’র সহনশীলতা, ক্ষুরধার সু-বুদ্ধির একটা পাথর যেন এই ভদ্রলোক। যে পাথরকে হয়ত ভেঙ্গে ফেলা যাবে, কিন্তু নড়ানো যাবে না। তো যা বলছিলাম ! সায়ন্ত ভাই চোখে আংগুল না কেবল, পারলে চোখ ছিড়ে বের করে বলে দিতেন কোন নিউজটা সত্য আর কোনটা ভুয়া কিংবা কোনটা সুগার ফ্লেভার্ড কুইনাইন সালফেট। কোন নিউজটা ঠিক কিভাবে কারসাজি করা হয়েছে ! কেন করা হয়েছে ! অথচ সত্যটা কি ! কি আড়াল করা হল, কি লেখা হওয়া উচিত ছিল, কেন আড়াল করা হলো। আমি শাখাওয়াৎ সায়ন্তকে চিনি না। ভাবি, কেবল ভাবি। অকুল পাথার ভাবি। এক লাইন পড়ে এক ঘন্টা জানালা ধরে তাকিয়ে থাকি। আশ্চর্যের ঘোর আমার কাটে না। নিজেকে মানুষ মনে হয় না। পাগল ছাগল মনে হয়। সবাই সব জানে, আমি কিচ্ছু জানিনা। ভাবি এই জীবনের মানে কি !! কোনো বিষয় অজানা থাকা ভাল। কিন্তু কম জানা লোকদের নিয়ে বড় বিপদ ! যে কোনো প্রসঙ্গ একটা উঠলে-ই হলো, এদের বকবকের চোটে কেউ আর দাড়াতে পারেনা। আমি এখন নানান ধরনের মিছিল, মিটিঙয়ে যোগ দেই। সবার কথা শুনে শুনে মাথাভর্তি জাংক ফাইল নিয়ে ডেরায় ফিরি। ভাবি, যারা বকবক করে তারা বেশিরভাগই ভুল বলে। যারা জানে , তারা কথাটা বলার সুযোগ পায় না। আজ ২৩ শে জুন ২০২২ সাল। পুরো পৃথিবী মাল্টিপল নেটওয়ার্কের আওতায়। এখনো এদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং শেখার আগে মানুষ শিখতে চায় রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং……… ইউনিভার্স কি জানেনা। কল্পনা করার বিদ্যেও যাদের ঘটে নেই তারা আসে প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে লেকচার দিতে। দিস ইজ বাংলাদেশ এন্ড ইট উইল নেভার চেঞ্জ ইটস হ্যাবিটস…………

যা বলছিলাম মেরে ভাই আউর বেহনোগন, এই তিন চ্যাপ্টার পড়ার পর পড়ি সাবেক মন্ত্রী ভোলার মোশাররেফ হোসেন শাহজাহানের ধারাবাহিক কলাম ‘জোনাকী মন’। এই লোক রাজনীতিবিদ ভাবতেও অবিশ্বাস লাগে। কোন মানুষের মন শিশুদের মত এতো পুত পবিত্র কিভাবে হয় ! প্রত্যেকের লেখায় তাঁর মেজাজের ছাপ পাওয়া যায় কখনো না কখনো। অথচ এই লোক !! জাহান্নামে ফেলে দিলেও ‘উহু’ শব্দটি করবে বলে মনে হয় না। যাই হোক প্রসংগে আসি। ‘জোনাকী মন’ চ্যাপ্টারে একদিন তিনি লিখলেন একজন জাপানী তরুনীর কথা। জাপানী তরুনী লঞ্চে করে ভোলা যাচ্ছেন। সারারাত তিনি লঞ্চের ডেকে হাটাহাটি করলেন, বলা চলে না ঘুনিয়ে-ই কাটালেন। কিছুক্ষন পরপর ব্যাগ থেকে এটা ওটা বের করে খাচ্ছেন। সেসবের প্যাকেট গুলো ভাজ করে জ্যাকেটের পকেটে রাখছেন। এ সময় কেউ একজন খালি পানির বোতল নদীতে ছুড়ে ফেলল। জাপানি মেয়েটি হায় হায় করে উঠল। এ কি করলেন ! এ কি করলেন !! নদী নষ্ট হয়ে যাবে। পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। তাঁর কথা শুনে সবার সে কি হাসি তামসা !! মেয়েটি মাথা নিচু করে তাঁর কেবিনে ফিরে গেল। এবার বরিশালে যাবার সময় খেয়াল করলাম নদী দুষন কোন পর্যায়ে যেতে পারে। দুনিয়ার সব বর্জ্য যেন নদীতে ফেলাই একমাত্র সমাধান। দিনকে দিন নদীগুলো মরে যাচ্ছে………….

আবার বলি, দিন পনেরো আগে বরিশাল যাচ্ছি। বরিশালে বিএনপি’র মহাসমাবেশ। এ জেলার সাথে পানিপথের যত সম্পর্ক, সড়ক পথের সম্পর্ক তত-ই কম। ভাবি, পানি পথ বন্ধ করে সড়কে অশান্তি লাগিয়ে দিলে মহাসমাবেশটা ছোটো হয়ে যেতে পারে। তাই যাবার জন্য আমি সবচে কমপ্লিকেটেড পথটা বেছে নিলাম। সকাল ৬ টায় বের হতে হবে। এটা আমার পক্ষে একেবারে-ই অসম্ভব ! সারারাত জেগে রইলাম। ৬ টায় বের হয়ে রিক্সা নিয়ে গেলাম জাংগালিয়া। সেখান থেকে বাসে হাজীগঞ্জে। বেবি টেক্সি করে তারপর রামগঞ্জ, মাইক্রো ধরে লক্ষীপুর হয়ে মজু চৌধুরীর হাট বা ঘাট। সেখানে থেকে ট্রলার টাইপ লঞ্চে চেপে পাতাইয়ার হাট-চরমোনাই-মেহেন্দীগঞ্জ হয়ে বরিশাল। এইভাবে এত ঘুরতি পথে যাওয়ার কারন একটা-ই। সুন্দরভাবে বরিশাল পৌঁছে লিখলাম ঠিক কিভাবে এসেছি ! বরিশাল বিভাগীয় জনগনকে উৎসাহ যোগাতে লিখলাম – চাইলেই সম্ভব। আপনারা আপনাদের মা বোন কন্যাদের নিয়ে আসুন। আপনারা আপনাদের শিশুদের নিয়ে আসুন। তাদেরকে দেখিয়ে দিন স্বাধীনতা অর্জনের পরেও কত শত অসম্ভবকে চ্যালেঞ্জ করে জিতে থেকে তাকে সমুন্নত রাখতে হয়। পরদিন এক অভুতপুর্ব ঘটনার স্বাক্ষী হলাম।জনগন কলা গাছের ভেলা, সিংগেল কলাগাছ কিংবা দীর্ঘ পথ সাঁতরে এসছে বরিশাল। আলহামদুলিল্লাহ্‌। কেউ ট্রলার থেকে নেমে হেটেছে ঘন্টার পর ঘন্টা, কেউ রিক্সা পেয়েছে, কাউকে নামিয়ে দিয়েছে তবু দমেনি বীরের দল।

পথিমধ্যে, হতে পারে সেটা বিজড়া বাজার……… যে জন্যে এই প্রসংগের অবতারণা। সুন্দুর জিন্স আর মিনি স্কার্ট পরা একজন হিজড়া উঠল। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি চেহারা। এই রাস্তাটা আজেবাজে লোকের আখড়া। আগেও দেখেছি। তো সে-ই মেয়েটি উঠার সময় এক বুড়ো না খুড়ো তাকে নিয়ে অশ্লীল একটা ইংগিত করে বসল। আর যায় কোথায় !! পুরো বাসের সবাইকে খুড়োর শয়তানে ধরেছে। সবাই আংগুল দিয়ে মেয়েটির এখানে সেখানে গুতো দিচ্ছে। আর হাসি তামসা তো লেগেই আছে। চুপচাপ বসে আছি। মেয়েটার জীবনে কোনো পেরেন্টাল মেমরি নেই, মাতৃস্নেহ পিতৃ প্রেম কি সে তা জানেনা। হয়তো পিতামাতার পরিচয়ও জানে না। এরা কোথাও স্বাভাবিক মানুষের মত কামলা খাটা/রিক্সা চালানো/কিংবা অন্য কোনো কাজের সুযোগ পায় না। এই সমাজ এখনো তাদেরকে মানুষ বলে ভাবে কিনা বুঝতে পারছি না। তাদের নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। এরা কারো স্ত্রী বা স্বামী হবার ভাগ্য নিয়েও জন্মায় না। এরা সমাজের ভেতরে-ই আত্মগোপন করে থাকে। মাঝে মাঝে শুনি এদের দিয়ে বিকৃত যৌনাচার করানো হয়। কেন এবং কিভাবে এসব হয়, কারা করে, কারা করায় সেসব শুনবার রুচিও আমার হয়না। আমি নিঃশব্দে বাসের সবার মুখে এক প্রকার থুথু দিয়ে প্যান্টের ডান পকেটে যত টাকা ছিল সেগুলো দিয়ে দিলাম। সবাই চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে………… এখন নিজেকে আমার খুব হালকা লাগছে। এইসব জানোয়ারদের মুক্তির জন্যই কি এই যুগ যুগ ধরে লড়ে যাওয়া ? মনে প্রশ্ন কিলবিল করে।

আসছে ২৬ শে নভেম্বর ২০২২ কুমিল্লা বিভাগীয় মহাসমাবেশ। গতকাল রাতে গিয়েছিলাম। চারদিকে হইহই রইরই উৎসবের আমেজ। সবাই কর্ম ব্যাস্ত। অবিরাম কাজ চলছে। তরুন নেতৃত্ব নিজেদের কাজ বুঝে নিচ্ছে। কাজ সেরে এসে রিপোর্ট করছে। ছবি তুলে এনে দেখাচ্ছে। আমার কোনো কাজ নেই। প্রায় সবগুলো মহাসমাবেশ কাভার করেছি। সিলেটে গিয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে ফিরে এসেছি। এখন কোন কাজ দিলেও আমি সুষ্ঠু সুন্দরভাবে করতে পারব না। এরচে ভাল, ঘুরে ঘুরে কাজ দেখি। মানুষের সাথে কথা বলি। সবার আগ্রহ এসে মিলিত হয়েছে একটা দিনকে কেন্দ্র করে। ২৬ শে নভেম্বর রোজ শনিবার কুমিল্লা মুক্ত হবে। এখনো দূর দুরান্তের মানুষ আসতে শুরু করেনি। আশা করছি, শুক্রবারের মধ্যেই কানায় কানায় ভরে যাবে কুমিল্লা টাউনহল মাঠ। এর চারদিকে চারটা রাস্তা আছে। সেগুলো-ও ভরে যাবে কানায় কানায়। আমি নিশ্চিত। কুমিল্লায় কোকো’র জন্ম হয়েছে। আরাফাত রহমান কোকো, বেগম জিয়ার দ্বিতীয় পুত্র। জিয়া এই সেনানিবাসের একজন ছিলেন। এই পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ বাংলাদেশীদের অনেক ঋন আছে। কুমিল্লা এ পরিবারকে মনেপ্রানে ধারনা করে। আর আমি বিশ্বাস করি কোকো’কে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে আজতক, ফ্রি ফেয়ার এন্ড ক্রেডেনশিয়াল কোনও ইলেকশনে এ জেলায় বর্তমান ক্ষমতাশীল সরকারী দলের প্রার্থীদের জয়ে’র রেকর্ড নেই বললেই চলে। এক মুরাদনগর থেকে যে পরিমান মানুষ আসতে পারে তা ধারনের ঠাই পুরো টাউনহলে হবে কিনা কে জানে ! এমন কি পরিমান মুরাদনগর নিয়ে কুমিল্লা বিভাগ ভাবতে পারেন !!

ধরুন, আপনি ভাবছেন সব মানুষ যাচ্ছে। আমি একা না গেলে কি আর এমন হবে ! দয়া করে এই অশুভ ভাবনাটা ভাববেন না। কে গেল আর কে গেল না সেসব ভাববেন না। চলছে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই। এ লড়াইয়ে হেরে গেলে কি হবে ভাবতে পারেন ? পারেন না, তাই না ! জেলা শহর ঝিনাইদহের কথা মনে আছে তো, নাকি সব ভুলে বসে আছেন। সেখানে একটা বাচ্চা মেয়েকে রেপ করা হবে। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কার আগে কে যাবে !! হাত পা বাধা অবস্থায় অক্ষম মা কোনও রকমে অনুনয় বিনয় করে বলেছিল- বাবা’রা আমার মেয়েটা ছোট মানুষ। আপনারা একজন একজন করে যান। মুক্তিযুদ্ধের যত বই পড়েছি, সেখানে এমন নির্দিষ্ট এবং বীভৎস গল্প এখনো আমার চোখে পড়েনি। তাছাড়া আমরা তো সবাই স্বাধীন দেশের লোক। আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। আমরা তবে কোন দানবকে ফেস করছি ? ভাবুন, স্বাধীন হয়েও আসলে আছেনটা কেমন !! আমার যা বলার তা বললাম। আপনারা কে ক’জন নিয়ে আসছেন বা আসবেন সে আপনাদের ব্যাপার। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, দেশ রক্ষার দিক নির্দেশনা এবং যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধ সবই করতে পারে রাজনীতিকেরা। কিন্তু জন সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো আন্দোলন সফল হয় না। তাই বলি, নিজ ভুমি রক্ষা করতে আসুন, মা বোনের জিম্মাদার হয়ে আসুন, সমাজের জন্যে হলেও আসুন। এদেশের জাতীয় নেতারা কিভাবে কোন দিক নির্দেশনা দেয় সেটা শুনতে হলেও আসুন। নিজের ভিটে বাটি বাঁচাতে হলেও হাতে হাত ধরে আসুন। এখন বিভেদের দিন আর নেই। এখন নিজ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার সাদা পদ্মকে রাঙ্গিয়ে তুলতে হলেও আসুন। মনে রাখবেন, এ দেশ আপনাদের। কারো বাপ দাদার জমিদারী নয়।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক ,দেশ জনতা ডটকম