নিন্দের চোটে বাজার থেকে বই তুলে নিয়িছিলেন রবীন্দ্রনাথ

আপডেট: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১
0

কবি বা সাহিত্যিকের মধ্যে প্রায় সময়ই সুপ্ত থাকে সঙ্কলক বা সম্পাদক হওয়ার ইচ্ছে। আবার কোনও সঙ্কলনগ্রন্থে সম্পাদক বা সঙ্কলক হিসেবে যদি কোনও ভারী নাম থাকে, তবে তার কাটতি বাংলা বাজারে চির কালই বেশি। প্রকাশকদেরও উৎসাহ থাকে সে দিকেই। সে চল আজও আছে। সঙ্কলন বা সম্পাদনার মধ্যে প্রায় সময়ই মিশে থাকে স্বজনপোষণের চিহ্ন, ইচ্ছেমতো কবি বা লেখকদের তাতে অন্তর্ভুক্তি বা তা থেকে বহিষ্করণের ক্ষমতাপ্রদর্শন। কাজেই সঙ্কলনগ্রন্থ নিয়ে বাতাসে কানাকানিও ওড়ে বিস্তর। তীব্র সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি বাঙালির আইকন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।

‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ নামে একটি কবিতা সঙ্কলন বার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩৮ সালে। কিন্তু চার দিক থেকে এত নিন্দে হল এই সঙ্কলনের যে, রবীন্দ্রনাথ বইটি বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হলেন। দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করলেন অনেক আশা করে, কিন্তু ছাপা গেল না তাও।

এমন শোচনীয় বিপর্যয়ের অনেকগুলি কারণ ছিল। রবীন্দ্রনাথ সঙ্কলন শুরু করেছিলেন আলাওলের কবিতা দিয়ে, শেষ কবির নাম জনৈক মহীউদ্দিন। কোনও ক্রম মানেননি। এই দু’জনের মাঝখানে পর পর রয়েছেন কৃত্তিবাস ওঝা, কাশীরাম দাস, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস। এই পরিকল্পনায় যদি কোনও সচেতন কারণও থাকে, সেটা রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেননি কোথাও, শুধু ‘কাব্যসাহিত্যকে আমি ইতিহাসের গণ্ডি দিতে চাইনি’— এই নিরীহ লাইনটুকু ছাড়া। কিন্তু মজার কথা, পুরনো সময়ের কবিতা নিয়ে ততটা মাথা ঘামাননি কেউ, ঝড় উঠল নতুন কবিদের লেখা নিয়ে, লেখা না-নেওয়া নিয়ে। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের পরের শক্তিমান কবিদের পদধ্বনি জোরালো হয়ে উঠেছে। বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, এখানে এমন অনেকের কবিতা আছে, তাঁরা যে কবিতা লেখেন তা জানা গেল সঙ্কলনটি দেখে। কিন্তু এ তো নিছক পরিহাসের কথা। গুরুতর কয়েকটি অভিযোগও ছিল। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘নবীন লেখনী’ নামে একটি ‘বালককালের রচনা’ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অথচ তত দিনে বাংলা কবিতায় ‘অর্কেস্ট্রা’ আর ‘ক্রন্দসী’র কবি হিসেবে তাঁর জায়গা পাকা হয়ে গিয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় বিরূপ হয়েছিলেন।

অতুলপ্রসাদ সেনের লেখা না থাকায় প্রশ্ন তুললেন দিলীপকুমার রায়। অখুশি হয়েছিলেন জীবনময় রায়, প্রমথনাথ বিশী। বিষ্ণু দে-র কবিতাও ছিল না। বিষ্ণু দে নিজে কিছু লেখেননি, কিন্তু এটা নিয়ে ‘কবিতা’ পত্রিকায় বুদ্ধদেবের তীব্র সমালোচনামূলক প্রবন্ধ পড়ে বুদ্ধদেবকে চিঠিতে লিখেছিলেন ‘…আপনার সমালোচনা প্রয়োজন ছিল।’

আরও একটা মারাত্মক কাণ্ড হয়েছিল। জীবনানন্দ ‘দাস’-এর ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ‘কেটেছেঁটে’! হতবাক বুদ্ধদেব ‘কবিতা’-র ওই প্রবন্ধেই লিখেছিলেন ‘অঙ্গহানিতে কবিতাটির ক্ষতি হয়েছে।… সাহিত্যক্ষেত্রে কেউ কারুর কৃপাপ্রার্থী নয়।’ সংখ্যাটি বেরনোমাত্র ‘কবিতা’-য় বিশ্বভারতীর বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’-কে ‘নিকৃষ্ট সংকলনগ্রন্থ’ বলে রায় দিয়েছিলেন অশোক মিত্র, সেই সময়ের নতুন বাংলা কবিতার সঙ্গে যিনি আন্তরিক ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই সঙ্কলন তাঁর ‘সাময়িক রুচি বিপর্যয়’-এর পরিচয়। সঙ্কলনের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন: ‘এর থেকে আদিরসের কবিতা বাদ পড়েছে।’ কারণ? ‘…গৃহিণীর রন্ধনবিদ্যায় যথার্থ গুণপনা প্রকাশ পায় তাঁর নিরামিষ রান্নায়!’

রবীন্দ্রনাথ আসলে তাঁর কর্মচারীদের হাতে পুরো ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন বলেই এই ‘নিরামিষ’ সঙ্কলনটি ডুবেছে, এটা এত দিনে পরিষ্কার। সেই সময়ের রবীন্দ্রনাথ, লিখেছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও, বাংলা সাহিত্যের ‘…সব ধারার সহিত সম্যক পরিচিত নহেন…।’ নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, কাননবিহারী মুখোপাধ্যায় ও কিশোরীমোহন সাঁতরা— এই তিন জনের হাতযশই কাজ করেছিল সঙ্কলন তৈরিতে। নন্দগোপালের চারটি কবিতা ছিল সঙ্কলনে, অথচ রামপ্রসাদ, নজরুল আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের তিনটি করে লেখা, আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দু’টি। ‘দ্বিজেন্দ্রলালের চাইতে নন্দগোপাল সেনগুপ্ত বড় কবি?’— প্রশ্ন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। নন্দগোপাল সম্পর্কে সেই সময়ের তরুণ কবিদের ধারণা অবশ্য খুব উঁচু ছিল না। বুদ্ধদেব এবং বিষ্ণু দে-র অতিপরিচিত দু’টি সঙ্কলনের কোনওটিতেই নন্দগোপালের কবিতা ছিল না।

চার দিক থেকে বিরূপ সমালোচনায় বিচলিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। বাধ্য হলেন বাজার থেকে সঙ্কলনটি তুলে নিতে। কিন্তু বিব্রত হলেও অথবা বিব্রত হয়েছিলেন বলেই তিনি এ বার চেষ্টা করলেন ত্রুটিমুক্ত করে নতুন ভাবে তা বার করতে। এক বার এমনও ভেবেছিলেন, কবিদের দিয়েই তাঁদের নিজেদের কবিতা বাছাই করা হোক। জানা যায় যে, সেই সময় তাঁর কাছে কোনও কোনও কবি দাবি করেছিলেন, ‘এবারে যেন আমি ভালো কবিতা বাছাই করি অর্থাৎ তাঁদের মতের অনুসরণ করি।’ সঙ্কলককে কত চাপ সহ্য করতে হয়! রবীন্দ্রনাথ আর চাপ নিতে পারলেন না।

নিজে আর দায়িত্ব নিলেন না। আশ্চর্যের কথা, যাঁর হাতে দায়িত্ব দিলেন, তাঁর পছন্দ-অপছন্দের প্রতি তরুণ কবিদের আপত্তির কথা সবাই কিন্তু জানতেন। তিনি সজনীকান্ত দাস। কবিতা সঙ্কলন তৈরির স্পর্শকাতর কাজটি কেন সজনীকান্তর করা উচিত বলে মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার উত্তর পাওয়া কঠিন। জগদীশ ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ এই সংস্করণের জন্য সজনীকান্তের কাছে খানতিনেক কবিতা চেয়েছিলেন। সজনীকান্ত এতে শুধু খুশিই হননি, রীতিমতো গৌরব বোধ করেছিলেন। যাই হোক, সজনীকান্ত যথাসময়ে নতুন সঙ্কলন তৈরি করলেন বটে, কিন্তু সেটা দেখে আগের বারের তিক্ত অভিজ্ঞতায় পোড়খাওয়া রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে, এই সঙ্কলন সমস্যা আরও জটিল করবে। দ্বিতীয় সংস্করণ শেষ পর্যন্ত আর বেরোল না।

‘বাংলা কাব্য পরিচয়’-এর ধাক্কাতেই দু’বছর পর প্রকাশিত হয়েছিল আধুনিক বাংলা কবিতার সবচেয়ে মূল্যবান সঙ্কলনটি। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’। বলার কথা, বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকেই! প্রথম সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু নেপথ্যে আগাগোড়া প্রধান ভূমিকা ছিল বুদ্ধদেব বসুর। কিন্তু এই সঙ্কলনেরও শুরুতেই গন্ডগোল। সঙ্কলনের ভূমিকা লিখেছিলেন আইয়ুব। সেই লেখা এতটাই অপছন্দ হল হীরেন্দ্রনাথের যে, তিনি দ্বিতীয় আর একটি ভূমিকা লিখলেন। অপছন্দের মূল কারণ, আইয়ুব লিখেছিলেন ‘সাম্যবাদী’ কবিদের বেশির ভাগই ‘কবি নন’। তাঁরা যে তাগিদে ‘গোলদীঘি থেকে সুদূর পল্লীগ্রাম পর্যন্ত সভা-সমিতি করে বেড়ান, … জেল খাটেন,’ সেই তাগিদেই কবিতা লেখেন। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যেন রাগী প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন এ ভাবে জানিয়েছিলেন, তাঁরা যে সেই তাগিদে ‘কবিতা লিখতে পারবেন না, এমন কথা কেউ জোর গলায় বললে অন্যায় করবেন।’ এই মনোমালিন্য অনেক দূর গড়িয়েছিল। হীরেন্দ্রনাথের ‘অনধিকারচর্চা’-য় বুদ্ধদেব খুশি হননি।

‘কবিতা’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে অতুলচন্দ্র গুপ্ত রায় দিয়েছিলেন হীরেন্দ্রনাথের ভূমিকাটি ‘বাদ দিতে হবে।’ কারণ ‘কাব্য-কৌশলের মতো কবোষ্ণ বিষয়ের আলোচনা তাঁর কাছে আশা করা অন্যায়।’ বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠিতে সমর সেন অনুযোগ করেছিলেন, “হীরেনবাবু তাঁর ভূমিকায় আমাদের মতো ‘সাম্যবাদী’ কবিদের অরুণ মিত্রের ‘লাল ইস্তাহার’ থেকে বামপন্থী কবিতা সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে অনুরোধ করেছেন।” এই ‘লাল ইস্তাহার’ কবিতাটি বুদ্ধদেব সঙ্কলনের পরের সংস্করণে নিজে সম্পাদক হয়ে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। অনুযোগ ছিল আইয়ুবেরও। বুদ্ধদেবকে লেখা চিঠিতে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, হীরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন তিনি ‘স্লিপিং এডিটর’ থাকবেন।

আরও নানা কৌতুককর জটিলতা তৈরি হয়েছিল এই সঙ্কলন তৈরির সময়। কোন কবিকে কত পৃষ্ঠা এমনকি কত লাইন দেওয়া হবে, সেটা নিয়ে আইয়ুবের সঙ্গে বুদ্ধদেবের চিঠি চালাচালি হয়েছিল। একটা গোটা চিঠির বিষয়ই ছিল ‘লাইন গুণে’ কবিদের জায়গা ঠিক করা। দেখা গেল বুদ্ধদেব বসুর ‘মোট লাইন সংখ্যা হয়েছে ৩০৫, সুধীনবাবুর ৩৮৬।’ এখন বুদ্ধদেবকে এই ৮১ লাইনের দূরত্ব কী করে পার করানো যায় যায় তাই নিয়ে গবেষণা। বিষ্ণু দে-র কবিতার লাইন গোনা তখনও বাকি! সঙ্কলনে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা ছিল না, কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর কবিতা তিনি নিজে বেছে দেবেন। আইয়ুব রাজি হননি। তিনি বুদ্ধদেবকে চিঠিতে লিখছেন, ‘আশা করি তাঁর রচনা না পেয়ে আধুনিক বাংলা কবিতা-র পাঠকরা হতাশায় মুহ্যমান হবেন না।’

চোদ্দো বছর পরে সঙ্কলনের দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পাদনা করলেন বুদ্ধদেব বসু। আবার শুরু হল বিতর্ক। প্রথম সংস্করণের সম্পাদক দু’জনের নাম উল্লেখই করেননি তিনি। দুটো ভূমিকাও বাদ দিয়েছিলেন। নিজে একটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছিলেন, কিন্তু কবিতা নেওয়া আর বাদ-দেওয়া নিয়ে তাঁকেও কম কথা শুনতে হয়নি। তাঁর প্রিয় সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর সমর সেনের কবিতার সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেও একেবারে বাদ দিয়ে দিলেন নীরেন্দ্রনাথ রায় আর সুরেন্দ্র গোস্বামীকে। মনে পড়বে, প্রথম সংস্করণে ‘সমাজসচেতন’ কবিতা ‘প্রাধান্য’ পাওয়ায় তাঁর মন খারাপের কথা তিনি প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন। অরুণ মিত্র অখুশি হয়েছিলেন তাঁর কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেবের বিবেচনায়। বুদ্ধদেবের নির্বাচন মানতে পারেননি বিষ্ণু দে-ও। ১৯৬৩ সালে তিনি বার করলেন আর একটি সঙ্কলন, ‘একালের কবিতা’। খেয়াল করতেই হয় যে, অরুণ মিত্র আর সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার সংখ্যা তাঁর সঙ্কলনে বেড়ে গেল অনেকটাই।

শুরুতেই যে কথা বলা হয়েছিল, সঙ্কলনগ্রন্থের কিছু অসুবিধে থাকে। বাংলা সাহিত্যের অনতি-অতীত ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রায় সব সঙ্কলনের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্যি। নিজের কাজ পক্ষপাতশূন্য বা সর্বাঙ্গসুন্দর
হোক না হোক, সমালোচনার সুযোগ এলে কেউই কাউকে ছেড়ে দেননি। সম্ভবত একই বটবৃক্ষের তলায় তাঁদের এক সঙ্গে জড়ো করা সম্ভবই ছিল না। হবেই বা কী করে! তাঁদের বেশির ভাগই যে এক-এক জন স্বয়ংসম্পূর্ণ মহীরুহ।

আনন্দবাজার