নির্মাণের দুই মাস পরেই ভেঙে পড়ল সেতু :চরম দূর্ভোগে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ১৭ গ্রামের মানুষ

আপডেট: অক্টোবর ১২, ২০২১
0

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের চর পাত্রখাতা সাব-বাধ এলাকার একটি সেতু নির্মাণের দুই মাস পরেই বন্যায় ভেঙে গিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সহ গাইবান্ধা জেলার সতেরটি গ্রামের সহস্রাধিক মানুসের যোগাযোগ ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছে।

নির্মাণকৃত সেতুটি ভেঙে পড়ায় এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগে একটি সাঁকো তৈরি করে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এই নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে পারাপার হতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীরা।
জানা গেছে, উপজেলার রমনা ইউনিয়নের পাত্রখাতা ব্যাপারী পাড়া সাব বাধ এলাকায় সাইদ আলীর বাড়ির পূর্বপাশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু/ কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪০ ফিট সেতুটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের দুই মাস অতিবাহিত হলে বন্যার কবলে পড়ে ভেঙে যায় সেতুটি সহ সংযোগ সড়কের অানুমানিক চল্লিশ ফিট পর্যন্ত। পরে এলাকাবাসী ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের আর্থিক সহযোগীতা পেয়ে নিজেরাই সেতু লাগোয়া কাঠ ও বাশ দিয়ে তৈরী করেন সাকো। পরে তিন বছর ধরে সেতুটি ভেঙে পড়ে থাকায় দূর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়া স্থানীয়রা নিজেদের প্রচেষ্টায় সাকোটি পুনঃ সংস্কার করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন তারা। এলাকাটি গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন হওয়ায় ওই উপজেলার পাঁচপীর, মনতোলার চর, ডাংরার চর গো মাঠ, মাদারী পাড়া, চর মাদারী পাড়া সহ কাশিম বাজার এবং কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ঝাকুয়া পাড়া, গোয়ালপাড়া, জামের তল, দক্ষিণ খরখরিয়া, তেলীপাড়া, পাত্রখাতা সাব বাধ, পাত্রখাতা মাস্টারের হাট সহ মিনা বাজার এলাকার শত শত মানুষ প্রতিনিয়ত দূর্ভোগ ও ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করছেন। চলাচলকারীরা প্রতিনিয়তই হচ্ছেন দূর্ঘটনার শিকার। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও।

স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, গত ৭-৮ দিন আগে এই সাকোটি দিয়ে পারাপারের সময় হঠাৎ ভেঙে গিয়ে নিচে পড়ে যাই। নিচে থাকা ইটে পড়লে মাথায় আঘাত পেয়ে মাথা ফেটে যায়। পরে মেডিকেলে গেলে মাথার ক্ষত স্থানে ছয়টি সেলাই পড়ে।
সেতু সংলগ্ন বসত বাড়ির বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানান, এই এলাকায় আমাদেরকে সব সময় দূর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়। আমার বাড়ী সংলগ্ন এই ভাঙা সেতুর সাথে ঝুঁকিপূর্ণ সাকোটি দিয়ে পার হওয়ার সময় আমার ভাতিজি পানিতে পরে মৃত্যু হয়। কিছুদিন আগে স্থানীয় এক ব্যাক্তি দোকান ঘর নির্মানের জন্য ইট নিয়ে এই সাকোটি পার হওয়ার সময় নিচে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে যাওয়ায় সাতটি সেলাই পড়ে।

সেতু সংলগ্ন অপর এক বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, এই এলাকার রজ দেওয়ানী নামের এক ব্যাক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে মেডিকেল নিয়ে যাওয়ার পথে এই ঝুঁকিপূর্ণ সাকো পার হওয়ার অাগেই স্ট্রোক করে তার মৃত্যু হয়।

সেতু সংলগ্ন অারেক বসত বাড়ির বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, এখানে যে সাকোটি দাঁড়িয়ে অাছে এটি আমরা তিন বছর আগে স্থানীয়রা তৈরী করে প্রতি বছর সংস্কার করে চলাচল করে আসছি। এটি তৈরীতে উপজেলা প্রশাসন কিংবা সরকারি কোন আর্থিক সহযোগীতা আমরা পাইনি। সহায়তার জন্য লিখিত আবেদন সহ একাধিকবার মৌখিকভাবে জানিয়েও কোন কাজ হয়নি। তিনি বলেন, গত তিন মাস আগে স্থানীয় বাসিন্দা এরশাদুলের সন্তান আব্দুল কুদ্দুস সাকোটি থেকে পড়ে গিয়ে জখম হন।


গত শুক্রবার স্থানীয় বাসিন্দা আইয়ুব আলীর ছেলে হাবিবুর রহমান ইট নিয়ে সাকোটি পার হওয়ার সময় সাকো থেকে পড়ে গিয়ে পাঁচটি ইট মাথায় পড়ে গুরুতর আহত হয় সে। এছাড়াও কয়েকদিন আগে স্থানীয় বাসিন্দা আফসারের বাচ্চা এবং সাদ্দামের মেয়ে সাকো থেকে পড়ে আহত হয়।
গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের বৃদ্ধ হজরত ব্যপারী সাকোটি পারাপারের সময় নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর জখম হন।

পরে তিনি চিকিৎসা বাবদ ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই যে এখানে যে সেতুটি সরকার তৈরী করেছে, কি করেছে না করেছে! এখানে তো আমাদের সেতুর প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার রাস্তার। তিনি দাবী করে বলেন, এখানে যদি একটি রাস্তা তৈরী হয় তাহলে এ এলাকার বাসিন্দারা নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। রক্ষা হবে এলাকার ফসলি জমির। আমার সন্তানরা নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। গত তিন বছর আগে আমার এক ভাতিজি সাকো থেকে পানির স্রোতে পড়ে গিয়ে মারা যায়। যদি এখানে রাস্তা নির্মান না করা হয় তাহলে পানির স্রোতে এ এলাকার ৫-৭ টি বাড়ী ভাঙনে বিলীন হবে।
চরপাত্রখাতা এলাকার গৃহবধূ জোসনা বেগম জানান, সেতুটি ভেঙে পড়ে থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ সাকো দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। সাকোটি দিয়ে চলাচলের সময় পা পিছলে যায়। রাতে চলাচল করতে খুবই কষ্ট হয়। গতকাল রাতে উপুড় হয়ে সাকোটি পারাপার হয়েছি।

অন্যদিকে সেতুটি ভেঙে পড়ে থাকায় সাকো দিয়ে পার হয়ে ওই এলাকার পাত্র খাতা কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে দূর্ভোগে পড়ছেন স্থানীয় রোগীরা। এছাড়াও ইউনিয়নের ডাংরার চর সাব বাধ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাত্র খাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদরাসা, পাত্রখাতা তালিমুল কোরঅান নূরানী মাদরাসা, চর পাত্রখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ পূর্ব পাত্রখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীদের সাকোটি দিয়ে পারাপারের সময় নানা রকম ভোগান্তি সহ দূর্ভোগ পোহাতে হয়।

দূর্ভোগ নিয়ে চলাচলকারী পাত্র খাতা রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদরাসার সিনিয়র সহকারী মৌলভী মো: রফিকুল ইসলাম জানান, ‘এই সড়কটি হলো হরিপুর খেয়াঘাট থেকে প্রধান সড়ক। এই সেতুটির দক্ষিণে রয়েছে চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ গুলিই প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকরাই ভোগান্তি নিয়ে এই সেতুটি পারাপার হয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে যান।
হরিপুর খেয়াঘাট থেকে আসা কাশিম বাজার গামী যাত্রীরা অত্যন্ত ভোগান্তি নিয়ে এই সেতুতে চলাচল করেন। এই এলাকার মানুষের যোগাযোগের জন্য এই সেতুটি একটি নিত্য প্রয়োজনীয় মাধ্যম। যত দ্রুত সম্ভব এই ভেঙে পড়ে থাকা সেতুটির সুরাহা করা হলে এই অঞ্চলের মানুষজন উপকৃত হবেন।

সেতুর এই বেহাল দশার কারনে এর উপর দিয়ে কোন যানবাহন চলাচল করতে পারেনা। এ অঞ্চলের কৃষকদের চাষ করা ফসল এক সময় ঘোড়ারগাড়ীতে করে আনা নেয়া করতো। কিন্তু সেতু ভেঙে পড়ে থাকায় এ অঞ্চলের কৃষকরা কৃষি নিয়ে বিপাকে পড়ছেন নিয়মিত। এই সেতুটি কোন যানবাহন চলাচল করতে না পারায় এলাকার কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে জল চৌকিতে করে সাই সাজিয়ে ভোগান্তি নিয়ে চিকিৎসার জন্য শহরে নিয়ে যেতে হয়। যদি সেতুটি ভালো থাকতো তাহলে এ অঞ্চলের অসুস্থ মানুষদেরকে রিকশা কিংবা অটোরিকশায় করে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া যেত।

অপরদিকে সেতুটি ভেঙে পড়ে থাকায় ঝূকিপূর্ন সাকো দিয়ে কোন যানবাহন চলাচল করতে না পারায় নানা রকম ভোগান্তি নিয়ে শহর থেকে কাচামাল অানতে হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।
এতে করে তারা ভিন্ন পথ দিয়ে কাঁচামাল আনায় পরিবহন খরচ বেশী পড়ায় তা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে বিপাকে পড়ছেন। এবং কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল পরিবহন করতে না পারায় তা বাহিরে বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে তারা ফসল উৎপাদন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী জানান, আমরা জেলার চিলমারী উপজেলার শেষ প্রান্তে বসবাস করছি। এই সাকোটি আমরা এলাকাবাসী নিজ খরচে তৈরী করেছি।

কিন্তু সাকোটির উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে না পারায় উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলে নিতে নানা রকম দূর্ভোগ সহ ভোগান্তির সম্মুখীন হহচ্ছি। পরিবহন করতে না পারায় ফসল বাজারজাত করতে পারছিনা আমরা। ফলে আমরা ফসল উৎপাদন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তিনি আরো বলেন, আমি একজন স্টক ব্যবসায়ী। প্রতি বছর ধান, গম, সরিষা সহ বিভিন্ন ফসল কৃষকদের কাছ থেকে কিনে মজুদ করতাম। এবং বাহির থেকে ক্রেতারা এসে আমার সেসব কৃষি পন্য কিনে নিয়ে যেত। কিন্তু সেতু ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় বাহির থেকে ক্রেতারা আসছেনা। তাই বাধ্য হয়ে আমাদেরকে ব্যবসা বন্ধ করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে রমনা মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজগার আলী সরকার বলেন, কুড়িগ্রাম জেলার মধ্যে চিলমারী উপজেলা একটি বন্যা প্রবন এলাকা। গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে পাত্রখাতা সাব বাধ এলাকায় দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের অধীনে সেখানে একটি সেতু নির্মিত হয়। পরবর্তীতে একটি বন্যায় সেতুটি ভেঙে গিয়ে অচল হয়ে পড়ে। বিষয়টি আমি উপজেলার মাসিক মিটিংয়ে একাধিকবার উপস্থাপন করে কোন কাজ না হওয়ায় আমি নিজ অর্থায়নে একটি সাকো নির্মান করি। সেটিও স্থায়ী হওয়ার মতো নয়। স্থানীয়রা সেতুর পরিবর্তে সেখানে মাটি ভরাট করে রাস্তার নির্মানের জন্য আবেদন দিয়েছে। বিষয়টি উপজেলার মাসিক মিটিংয়ে উপস্থাপন করেছি।
ভেঙে পড়ে থাকা সেতুটি নিয়ে পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. কোহিনুর রহমান জানান, ‘জাইকা থেকে একটি প্রকল্প দেবে। সে প্রস্তাবটি অামরা প্রেরণ করব। প্রস্তাবটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যারের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে।আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে আমরা প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব’ ইনশাআল্লাহ।

স্থানীয়দের রাস্তা চাওয়ার বিষয়টির সম্পর্কে জানতে চাইলে, তিনি আরো বলেন, ‘স্থানীয়দের চাওয়ার বিষয় আমাদের মাথায় আছে। প্রকল্পটি পেলে সেখানে একটি রাস্তা এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি সেতুও নির্মাণ করা হবে’।
####