পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানীতে যাবে স্বরূপকাঠির আমড়া পেয়ারা আর বানারীপাড়ার বালাম চাল

আপডেট: জুন ২৫, ২০২২
0

রাহাদ সুমন,বিশেষ প্রতিনিধি॥
আগামীকাল ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে বরিশালের বানারীপাড়া ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিসহ গোটা দক্ষিনাঞ্চল জুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা। উদ্বোধনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য সবাই আবেগঅপ্লুত চিত্তে উন্মূখ হয়ে আছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে নতুন স্বপ্নের জাল বুনছে বানারীপাড়া ও স্বরূপকাঠির ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। পদ্মা সেতুর কারনে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে উন্মোচিত হবে এক নতুন দিগন্ত। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। বদলে যাবে মানুষের জীবমানের চালচিত্র। এলাকার কৃষিপণ্য সহজেই ঢাকায় পৌঁছে যাবে। শিল্প-কলকারখানা বেড়ে যাবে। সব শ্রেণির মানুষের উপকার হবে। জেলায় বৃদ্ধি পাবে জমির মূল্য। বিশেষ করে স্বরূপকাঠির পেয়ারা,আমড়া,সুপারি,নারকেল.কাঠ,নার্সারীর বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ,বনজ,ঔষধী গাছের চারা ও ফুল এবং বানারীপাড়ার বিখ্যাত বালাম চাল ও আমড়া,পেয়ারা,নারকেল সহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে সহজে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাবে। এতে দারুন খুশি কৃষক,ব্যবসায়ীরা। আগে স্বরূপকাঠি ও বানারীপাড়া থেকে রাজধানী ঢাকায় যেতে সময় লাগত ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। কখনও তার চেয়েও বেশী সময়। এখন সেখানে ৩-৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে। সড়কপথে দূরত্ব কমছে প্রায় একশ’ কিলোমিটার। স্থানীয় ব্যবসীয়রা জানান, এসব পণ্য এতদিন নদী ও সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে আসছিল। এতে সময়ক্ষেপণ, ফেরিতে আটকা পড়া ও পণ্য পচে যাওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মাধ্যমে সব প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটবে বলে সবার মুখে হাসির ফোঁয়ারা।
স্বরূপকাঠি উপজেলার ২২টি গ্রামের প্রায় ৬৫৭ হেক্টর জমিতে পেয়ারার বাগান রয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১০টন পেয়ারা হয়। প্রতি বছর প্রায় ৭/৮ হাজার টন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এসব বাগানে প্রতিবছরই প্রায় ৮/১০ কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদিত হয়। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় প্রতিমন পেয়ারা মাত্র একশ থেকে দেড়শ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। চাষিরা মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে পেয়ারা ঢাকা পাঠাতেন যাত্রীবাহী লঞ্চে। তরতাজা ফলটিও অনেক সময় পেকে যেত। পদ্মা সেতু হলে দ্রুত পচনশীল এ পণ্যটি ঢাকায় পৌঁছাতে পারবেন। সড়কপথে তাদের খরচও কমে যাবে। স্বরূপকাঠির আমড়া দেশব্যাপী বরিশালের আমড়া নামে পরিচিত। আমড়া চাষ এ অঞ্চলের মানুষের অনেক পুরনো পেশা। উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের বাড়ির সামনে কমপক্ষে একটি দুইটি আমড়া গাছ রয়েছে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় আটঘর-কুড়িয়ানাতে বাণিজ্যিকভাবে আমড়া চাষ শুরু হয়। পরে উপজেলার জলাবাড়ী,বলদিয়া, দৈহারী ও সমুদয়কাঠি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে শুরু হয় আমড়া চাষ। বাংলা ভাদ্র আশ্বিন ও কার্তিক এই তিন মাস আমড়ার ভরা মৌসুম। প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকাগামী লঞ্চ ও ট্রাকে করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে এই বরিশালের আমড়া বিক্রির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। চাষিরা আমড়া পেড়ে নৌকায় ভরে ব্যবসায়ীদের কাছে নিয়ে আসেন। আবার কোনো চাষী আগাম আমড়া ক্ষেত বিক্রি করেন ব্যবসায়ীদের কাছে। ব্যবসায়ীরা আমড়া কিনে ক্যারেট ও বস্তায় ভরে নৌ ও স্থলপথে পাঠান দূরদূরান্তে। সেখান থেকে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা আমড়া কিনে ছড়িয়ে দেন সারা দেশে। মৌসুমে প্রতিদিন ৪৫-৫০ টন আমড়া যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আর আমড়া সংরক্ষনের অভাবে তাদের অনেক আমড়া নষ্ট হয়ে যায়।

স্বরূপকাঠির ( নেছারাবাদ) আমড়া লাভজনক হওয়ায় কৃষকরাও ঝুঁকছেন এ ফল চাষে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আমড়া পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কৃষক পর্যায়ে প্রতিমন আমড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। পদ্মা সেতু চালুর ফলে চাষিরা নিজেরাই আমড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে বড় বাজারগুলোতে বিক্রি করতে পারবেন। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে না, লাভও বেশি হবে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে কৃষিবিদরা আশা প্রকাশ করছেন। এদিকে ধান-চালের বিক্রি ও প্রক্রিয়াজাতকরনের জন্য ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই বানারীপাড়া দক্ষিন অঞ্চলেরর অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। বরিশালকে বালাম চালের জন্য যে বিখ্যাত বলা হয় সেই বালাম চাল বানারীপাড়ায়ই প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। প্রায় দু’শত বছর পূর্বে বানারীপাড়ায় ধান-চালের ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়। কালক্রমেই এর বিস্তুৃতি ঘটে।

বরিশালের বালাম চালের সুনাম দেশের সর্বত্র এমনকি পাশ্ববর্তী দেশগুলোতেও। বালাম চাল বানারীপাড়ায়ই প্রক্রিয়াজাতকরন হয়। বালাম ছাড়াও অন্যান্য চালের চাহিদা ও সুনামের জন্য ঢাকা,রংপুর,দিনাজপুর,খুলনা, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার শতশত ফরিয়া এখানে এসে চাল ক্রয় করে নিয়ে যেত। সিলেট, ভৈরব, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ভোলা, ঝিনাইদহ, যশোর প্রভৃতি স্থনের ব্যবসায়ীরা তাদের এলাকায় উৎপন্ন ধানের প্রচুর চাহিদার কারনে ধানবিক্রি করতে বানারীাড়ায় আসত। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধানচালের ব্যবসার উপর বানারীপাড়ার অন্যান্য ব্যবসা নির্ভরশীল ছিল।

এ উপজেলায় ৭০ ভাগ মানুষ একসময় এ ব্যবসার সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত ছিল। অত্র অঞ্চলে চাল উৎপাদনকারীদের স্থানীয় ভাষায় কুটিয়াল বলা হয়। কুটিয়ালদের সংখ্যা একসময় ছিল প্রায় ২৫ হাজার। উপজেলায় শতাধিক রাইচ মিল ছিল। বানারীপাড়ায় ধান-চালের হাট বসে শনি ও মঙ্গলবার।

তবে রবি ও বুধবারেও ধান চাল বেচাকেনা হয়। সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় ভাসমান হাটে মুলত ধান-চাল বিক্রি হয়। একসময় বানারীপাড়া বন্দর বাজার, পশ্চিমপাড় দান্ডয়াট,থেকে শুরু করে রায়েরহাট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার জুড়ে সন্ধ্যা নদী ও এর শাখা নদী-খালে ভাসমান অবস্থায় হাজার হাজার নৌকায় ধান -চালের হাট বসত। বর্তমানে বানারীপাড়ার লঞ্চঘাট সংলগ্ন সন্ধ্যা নদীতে ভাসমান চালের হাট এবং নদীর পশ্চিমপাড় দান্ডহাটে ভাসমান ধানের হাটটি বসে ।

রবি ও বুধবারের হাটকে বলা হয় গালার হাট। কালের পরিক্রমায় ধান চালের ব্যবসা সংকুচিত হলেও পদ্মা সেতু চালুর ফলে এ ব্যবসা আবারও প্রসারতা লাভের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বানারীপাড়ার বালাম চাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে আবারও দেখা মেলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া স্বরূপকাঠির মত বানারীপাড়ায় উৎপাদিত পেয়ারা,আমড়া ও নারকেলসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ সহজতর হবে। সব মিলিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য আর্শীবাদে পরিণত হয়েছে। ###
রাহাদ সুমন,বানারীপাড়া
তারিখ.২৪-০৬-২০২২ইং