পরিবর্তন চাই

আপডেট: মার্চ ৫, ২০২১
0

রুদ্র অয়ন এর গল্প

হঠাৎ গোলমালের শব্দ পেয়ে কৌশিক বাড়ির চারতলার বেলকনিতে এসে ব্যাপারটা কি দেখতে লাগলো।
কৌশিকের পাশের বাড়িটি জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আহমেদ খানের। লোহার গেট ও রেলিং দেয়া বিশাল বাড়ি। এই জমিদার বাড়ির সামনেই কয়েকজন মানুষের হৈচৈ। ব্যাপারটা ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলো কৌশিক।

জমিদার বাড়ি

জমিদার বাড়ির সামনে প্রসস্থ জায়গায় বাড়ির কাজের লোকেরা দু’টো পোষা কুকুরকে খাওয়াচ্ছে। দু’টো কুকুরের সামনে অনেকগুলো বড় বড় মাংসের টুকরো। আর এসব মাংসের অপব্যবহার দেখেই অনাহারী ভিখেরীরা বাড়ির গেটের রেলিং টপকিয়ে আঙ্গিনায় ঢুকে পড়লে জমিদার বাড়ির লোকজনদের মধ্যে হৈ চৈ রব ওঠে ; সেদিকে ভিখেরিরা ভ্রুক্ষেপ না করে কুকুরগুলোর সামনে থেকে মাংসের টুকরোগুলো কুড়োতে থাকে। বিদেশি পোষা কুকুরগুলোও দাঁত বের করে ভিখেরিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। কুকুরের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত হয় কয়েকজন ভিখেরি, কিন্তু তাতে পিছপা হয়না ; ইটকেল- লাঠি যে যা পায় তা নিয়েই তারা কুকুরের সাথে লড়াই করে। কুকুরের চেয়ে তথাকথিত অসভ্য লোকেরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় তাদের শক্তির সামনে টিকতে না পেরে অবশেষে অন্দরমহলে প্রবেশ করে কুকুর দু’টো। অনাহারী, তথাকথিত অসভ্যরা তখন কুকুরের খাদ্য বড় বড় মাংসের টুকরোগুলো লুটপাট করতে লাগে!
এসব দেখে কৌশিকের শরীর শিহরিয়ে ওঠে! ছয় সাতজন অনাহারী লোকের সামনে জমিদার বাড়ির কুকুরের মাংস খাওয়ানোটা বিলাসিতা, বর্বরতা বলে মনে হয়।
হঠাৎ জমিদার বাড়ির লোকজন বুভুক্ষু লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
‘ডাকাত, ডাকাত। পুলিশে ফোন কর…..!’ বলে জমিদার বাড়িতে চিৎকার শোনা যায়।
কৌশিক আর ধৈর্য রাখতে না পেরে সেই দিকে ছুটে আসে।
বুভুক্ষু লোকজন গুলির শব্দ শুনে গেটের মুখে হুড়োহুড়ি করতেই গেট খুলে যায় আর ওরা গেটের বাইরে রাস্তায় এসে পড়ে। যে যেদিক পারে ছুটে পালাতে চেষ্টা করছিলো কিন্তু ওরা কেউ পালাতে পারলোনা। কয়েকদিক থেকে দলে দলে পুলিশ এসে সবাইকে ঘিরে ফেলে। পুলিশ ওদের ওপর লাঠিচার্জ করে।
কৌশিক অসহায় লোকদের বাঁচাতে ছুটে এসে পুলিশ অফিসারকে বলে, ‘প্লিজ থামুক আপনারা, অসহায় নিরস্ত্র মানুষদের ওপর লাঠি চালাবেন না।’

কৌশিককে পুলিশ অফিসার চিনতেন। তিনি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষের বাড়িতে এরা ডাকাতি করতে আসবে আর তাদের শাস্তি হবেনা! কি বলো তুমি?’

কৌশিক বোঝানোর চেষ্টা করে। শান্ত কণ্ঠে বললো, ‘এদের অপরাধ নিবেন না। আমি এদের লক্ষ্য করেছি। অভুক্ত গ্রাম্য মানুষজন। শহরে এসেছে ভিক্ষা করতে।’

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এতো লোক এক সাথে ভিক্ষা করতে কেন আসবে! এরা ডাকাতি করতে এসেছিলো।’

কৌশিক বললো, ‘ব্যাপারটা আমি লক্ষ্য করেছি বলেই বলছি। এরা গ্রাম্য অভুক্ত লোকজন শহরে এসেছে। খালি হাতে কি কেউ ডাকাতি করতে আসে?’

পুলিশ অফিসার বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘তুমি যাও। এদের ব্যাপারে আমি কিছু শুনতে চাইনা। পুলিশের কর্তব্যে বাঁধা দিলে তোমাকে এ্যারেষ্ট করতে পারি তুমি কি তা জানো?’

কৌশিক দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘তা পারেন বৈকি। আপনারা পুলিশের লোক, পারেন না এমন কোনও কাজ নেই। প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করতেও পারেন আবার নির্দোষ মানুষকে ফাঁসাতেও পারেন। এধরনের কত শত ঘটনা পত্রিকার পাতায় ওঠে এসেছে! তবে আফসোস, যারা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে, খুন-ধর্ষণ করে যাচ্ছে, চুরি-জোচ্চুরি দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে, যারা অসহায় জনগণের রক্ত চুষে খাচ্ছে তাদের আপনারা কিচ্ছুটি করতে পারেননা। খুব বেশি হলে ধরা পড়া পর্যন্তই! পরে থামাচাপা পড়ে যায় সবই। উপযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়না বলেই চারিদিকে খুন-ধর্ষণ আর দুর্নীতি চলে। তারাতো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। আর যত আইন দেখান অসহায় লোকজনদের বেলাতেই!’

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছে নেই, তুমি যেতে পারো।’

অভুক্ত লোকজন চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘আপনে চলে যান বাবু, আমরা গ্রেফতারই হমু। তাও জেলে গিয়ে দু’টা খাইবার পামু।’

কৌশিক আর কথা বলেনা। ওদের কথাশুনে অনেকটা নির্বাক হয়ে যায়।
অভুক্ত লোকজনকে নিয়ে পুলিশ বাহিনী প্রস্থান করে। কৌশিক বাড়ি ফিরে আসে।

গ্রামে তৃপ্তির সাথে দেখা

কৌশিক মাস্টার্স পড়ে। পাশাপাশি শখের বসে সাংবাদিকতা করে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রতিনিধি হিসেবে। এক সম্ভান্ত্র হিন্দু, ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে কৌশিক সান্যাল। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের উর্ধে আলোকিত চেতনার ছেলে কৌশিক, ভেতরে-বাইরে কুশিক্ষা, মন্দ যা কিছু তা বর্জন করে চলে আর সুশিক্ষা, যা কিছু ভালো তা হৃদয়ে ধারণ করে চলে সে। সবার আগে মানুষ, মানবতা-ই তার কাছে অগ্রজ। ধর্ম কর্ম যার যার তার তার, এই নিয়ে কোনও বিরোধ নেই তার অন্তরে।
কোশিকের বাবা ছিলেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী কাজে আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পথে দূর্বৃত্তের হাতে খুন হোন তিনি। তখন কৌশিক খুব ছোট। তবে বাবা ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেক কিছুই করে গেছেন। গ্রামের বাসায় বেশ কিছু জমিজমা আছে তার। শহরে বাড়ি, গাড়ি, ধন সম্পদ অনেক কিছুই বাবা রেখে গেছেন ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মা ও বেশ শিক্ষিত ও সম্ভান্ত্র পরিবারের মানুষ। মা সবকিছু আগলে রেখে একমাত্র অবলম্বন ছেলে কৌশিককে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছেন। মায়েরা সুশিক্ষিত হলে আর ছেলেদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করলে সন্তানরাও যে মানুষের মতো মানুষ হয় কৌশিক ও তার মা-ই তার উদাহরণ।

একদিন জমিজমা সংক্রান্ত কাজে কৌশিক গ্রামের বাড়িতে এলো। জমিজমা চাষাবাদ লোকজন দিয়ে করালেও পড়াশোনার ফাঁকে, অবসর সময়ে লোকজনের সাথে নিজেও মাঠে কাজের সহযোগিতা করে কৌশিক। মাটির সোঁদা গন্ধ আর ফসলের রঙ বেশলাগে তার। চাষাবাদ বা কৃষিকাজ মহৎ একটা পেশা বলেই মনে করে সে।
সহসা কাছেই একটা গোলমালের শব্দ পেয়ে ব্যাপারটা কি দেখতে সেদিকে এগিয়ে গেলো কৌশিক। ভিড় ঠেলে ভেতর যায় সে। বিষয়টা বুঝতে আর বাকি রইলো তার। কলেজ থেকে ফেরার পথে
যুবতী এক মেয়েকে কয়েকজন গুন্ডা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। দুইদিন পর গুন্ডাদের হাত থেকে কৌশলে মেয়েটি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে বাড়িতে ফিরে এলে তার বাবা গ্রামের ধর্মীয় নেতা ও মাতব্বরদের পরামর্শে মেয়েকে আশ্রয় দিতে চায়না!
বাবা মেয়েকে বলছেন, ‘যুবতী মেয়ে কয়দিন ধরে উধাও! তুই সমাজের কলঙ্ক। এই বাড়িতে তোর আশ্রয় হবেনা। আমার সামনে থেকে বিদায় হয়ে যা। আমাকে সমাজে দশটা মানুষের সাথে চলতে হয়, সমাজে বসবাস করতে হয়। তোর মতো নষ্টা মেয়ের কোনও দরকার নেই সমাজে কিম্বা আমার বাড়ি। তুই বিদায় হ’ আমার চোখের সামনে থেকে।’

মেয়েটি আর তার বাবার মাঝখানে এসে দাঁড়ায় কৌশিক। বোঝাতে চেষ্টা করে বলে, ‘অপরাধ নিবেননা কাকু। ধর্ম সমাজ মান ইজ্জত সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে মানুষের জন্যেই। মানুষ বাদ দিয়ে সমাজ নয়, মানুষের জন্যেই সমাজ; মানুষকে নিয়েই সমাজ। নিরপরাধ মানুষকে সমাজের কথা বলে, ধর্মের কথা বলে শাস্তি দেয়াটাও অপরাধ। মানুষের বানানো সমাজের চক্করে, ধর্মের নামে মনগড়া কথা বলে কারও প্রতি অবিচার করা একদমই ঠিক নয়। ধর্ম কোনও কিছু বিবেচনা না করে নিষ্ঠুর হতে শেখায় না। শান্তির জন্যে, সুষ্ঠু জীবনযাপনের জন্যেই ধর্ম। মানুষ- মানবতা বাদ দিয়ে ধর্ম নয়।’

মেয়েটির বাবা রাগত কণ্ঠে বললেন, ‘আমাকে কিছু শেখাতে এসোনা। তোমার থেকে আমার কিছু শিখতে হবেনা। সমাজ, ধর্ম আমি খুব ভালো জানি। আমাকে সমাজে চলতে হয়। আমার বাড়িতে এই মেয়ের জায়গা হবেনা।’

কৌশিক মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘ঘাবড়াবেন না দিভাই, ওপর ওয়ালা আছেন। তাঁর ওপর থেকে ভরসা হারাবেন না। তিনিই আপনার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিবেন বলেই হয়তো আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।’

মেয়েটির বাবাকে উদ্দেশ্য করে কৌশিক বললো, ‘মানুষের ভুল হতে পারে। ভুল মানুষের হয় আবার মানুষই শুধরায়। মানুষের ভুলগুলো বিশাল বড় করে দেখে তাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কোনও মানুষের কর্ম হতে পারেনা। সবার আগে মানবতা, মানুষই বড় কথা। যে সমাজের কথা বলে আপনার মেয়েকে ঠাঁই দিতে চাইছেন না, যে সমাজ বিচার বিবেচনা ছাড়াই অন্যায়ভাবে মানুষকে কষ্ট দেয় সেই অন্ধকার সমাজ থেকে বের হয়ে আলোর পথে চলুন। অন্ধকার দৃষ্টিহীন জ্ঞানহীন সমাজের কথা বলে নিরপরাধ মানুষকে কষ্ট দেয়াটা বর্বরতা ছাড়া কিছু নয়। যে সমাজ মানুষকে অন্ধকারের দিকে, অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়, যে সমাজ বিবেকহীন, যে সমাজ মানবতা বোঝেনা, মানুষের মূল্য দিতে জানেনা; আপনার সেই মরচেধরা সমাজকে ধিক্কার জানাই।’

তৃপ্তিকে নিয়ে কৌশিকের ফেরা

কৌশিক মেয়েটিকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে মাকে বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলে। মেয়েটির নাম তৃপ্তি। মা কিছুদিন আগে মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার কোনও ভাই বোনও নেই। নিরপরাধ, অসহায় মেয়েটির সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্যে মা কৌশিকের ওপর খুশিই হোন।
তৃপ্তিকে কাছে টেনে নেন তিনি।

কিছুদিন অতিবাহিত হলো। তৃপ্তি পড়াশোনায় বেশ ভালো। এখন অনার্সে পড়ে। সে এখন কৌশিকের স্ত্রী। শাশুড়ীকে নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসেন আর আচরণে, কথাবার্তায় নিজের মা-ই ভাবেন তাঁকে। আর মাও নিজের সন্তানের মতো দেখেন তৃপ্তিকে। স্বামী আর মাকে নিয়ে একটা সাজানো, সুখের সংসার তার।

ভন্ড ঠাকুরকে গণধোলাই

একদিন সকালে স্নান সেরে কৌশিক ড্রইং রুমে এসে বসলো। হকার পত্রিকা দিয়ে গেলো মাত্রই। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে চোখ বুলোতেই একটা খবর দেখে দৃষ্টি আটকে যায় তার! হেড লাইনে লেখা- ‘সঞ্জীব ঠাকুর গণধোলাইয়ের নিহত।’ এই সেই ধর্মীয় নেতা, যার পরামর্শ তৃপ্তি নিজের বাবার ঘরে আশ্রয় পায়নি। প্রতিবেদনটা পড়ে কৌশিক জানতে পারে- ধর্মীয় নেতা সঞ্জীব ঠাকুর দীর্ঘ দিন ধরে গ্রামে দাপটের সাথে বসবাস করে আসছিলেন। গতকাল গভীর রাতে মুখোশ পড়ে জনৈক মহিলার জোর পূর্বক ইজ্জত নেয়ার চেষ্টা করলে মহিলার চিৎকারে গ্রামের মানুষ ছুটে আসে এবং ক্ষিপ্ত হয়ে মুখোশের আড়ালে ভন্ড সঞ্জীব ঠাকুরকে অনবরত চড়, কিল, ঘুষি, লাথি মেরে উপুর্যুপরি আঘাত করতে থাকলে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।

কৌশিক মনে মনে ভাবলো, ন্যায় বিচার, আইনের যথাযথ প্রয়োগ আর অপরাধীর উপযুক্ত সাজা হলে দেশে এতো খুন ধর্ষণ হতোনা। আর জনতাও ক্ষুব্ধ হয়ে এভাবে অপরাধীর ওপর হামলে পড়তোনা। শুধু শুধু নতুন নতুন আইন তৈরি করলেই হবেনা। আইনের আওতায় অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দরকার আছে, সে যেই হোকনা কেন। অপরাধ করে কেউ পার পেয়ে যাবে, এটা হতে পারেনা। এই নীতিহীন ও ঝিমেধরা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।

আহমেদ খানের মুখোশ উন্মোচন

সহসাই তৃপ্তি ছুটে এসে ড্রইং রুমে প্রবেশ করে উত্তেজিত কণ্ঠে কৌশিকের হাত ধরে বললো, ‘বেলকনিতে এসে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখোতো। যে শয়তান লোকটা আমাকে বিদেশে পাচার করতে চেয়েছিলো তাকে দেখলাম।’

কৌশিক তৃপ্তি’র সাথে বেলকনিতে এসে বাইরের দিকে তাকায়। তৃপ্তি আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দেয়, ঐ লোকটা।

কৌশিক সেইদিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়েই চমকে ওঠে! এযে তার পাশের বাড়ির জমিদার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আহমেদ খান!

কোশিক বললো, ‘তুমি ভুল করছো না তো?’

তৃপ্তি দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘না না, আমার ভুল হয়নি। এই শয়তানটির লোকজনই আমাদের দশজন মেয়েকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে একটা বাড়িতে আটকে রেখেছিলো। এই শয়তাননের মুখটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সে এসে আমাদের দেখে বলেছিলো, ‘সবকয়টাকে দুই দিন পরেই চালান করে দেবো।’

তৃপ্তি বলতে থাকে, ‘ঘটনার দিন গাড়িতে ওঠার সময় অনেক কৌশল করে আমি পালাতে সক্ষম হই। কি বিভৎস সেই ঘটনা! মনে হলে এখনো আমার গা শিউরে ওঠে।’

কৌশিক বুঝতে পারে মুখোশের আড়ালে শয়তান লোকটি কতটা ভয়ানক।
কয়েক বছর আগে কৌশিকের বাড়িতে কীর্তনের আয়োজন হয়েছিলো। সে সময় পাশের বাড়ির জমিদার আহমেদ খান ও তার সঙ্গে কয়েকজন লোক উচ্চ স্বরে বলেছিলো, ‘ব্যাটা মালাউনদের জ্বালায় আর বাঁচা যাচ্ছে না! এই দেশ থেকে এসব মালাউনদের তাড়ানো দরকার।’

কৌশিক বলতে চেয়েছিলো, এই দেশ কি তোর বাপ দাদার সম্পত্তি! মানুষ নিয়ে, ধর্ম নিয়ে বিদ্রুপ করিস! কোনও ধর্মকে ছোট করে দেখা, বিদ্রুপ করা কোনও ধার্মিকের কাজ নয়। মুখে যারা ধর্ম নিয়ে দেশকে নিয়ে গলাবাজি করে বেড়ায়, অধর্ম আর দেশের ক্ষতি করে ওরাই বেশি।

সেদিন বলতে চেয়েও কিছু বলেনি কৌশিক। হিন্দু মুসলিম উভয়ধর্মেই কিছু সাম্প্রদায়িক, গোঁড়া ও অন্ধ মন মানসিকতার মানুষ আছে। আহমেদ খানকে কৌশিক সেই শ্রেণির লোক ভাবতো। কিন্তু সে যে নারী পাচারকারী, আস্ত একটা শয়তান এটা জানাছিলোনা।

গম্ভীর গলায় কৌশিক বললো, ‘হুম, বুঝেছি। দেখি কি করা যায়।’

ঝাঁঝাল গণ মিছিল

কৌশিক বেড়িয়ে গেলো। থানায় এসে দেখে পাঁচ ছয়জন যুবতী মেয়ে এসে ভীড় জমিয়েছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে ওরা বারবার বলছে, ‘আমরা এর বিচার চাই স্যার। আমরা জমিদার আহমেদ খানের শাস্তি চাই।’

ব্যাপারটা কিছুক্ষণে মধ্যে বুঝে ফেলে কৌশিক। মেয়েগুলোও আহমেদ খানের লালসার স্বীকার। বিদেশে পাচারের জন্যে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাদের। ভাগ্যক্রমে আহমেদ খানের বিষাক্ত ছোবল থেকে বেরিয়ে এসেই থানায় এসে পুলিশ অফিসারকে জানায়। কিন্তু আশ্চর্য! পুলিশ অফিসার কোনও রকম গুরুত্ব না দিয়ে উল্টে বলছেন, ‘আহমেদ খানের বিরুদ্ধে কথা? আহমেদ খান এই শহরের সম্মানিত ও বিশিষ্ট লোক। তার বিরুদ্ধে বললে আপনাদের কি শাস্তি হতে পারে জানেন?’

মেয়েগুলোর কোনও কথাই আমলে নিচ্ছেন না দূর্নীতিগ্রস্থ এই পুলিশ অফিসার! নিরুপায় হয়ে ক্ষোভ নিয়ে প্রস্থান করলো মেয়েগুলো। আইনের লোকেরাই আজকাল বেআইনি, অসৎ লোকদের, মূল অপরাধীদের মদদ দিয়ে যাচ্ছেন বেশি! এমনটা চলতে পারেনা।
এসবের শেষ দরকার।
অবশ্য পুলিশ, প্রশাসনের সবাই যে দূর্নীতিগ্রস্থ, ঘুষের টাকায় চোখে ছানিপড়া তা নয়। ভালো, সৎ অফিসারও রয়েছেন। তবে গুটি কয়েক অসৎ অফিসারদের কারণে এদের প্রতি সর্ব সাধারণ আস্থা হারাচ্ছে দিন দিন।

কৌশিক বুঝলো দূর্নীতিগ্রস্থ এই অফিসারকে এসব বলে লাভ হবেনা। ওপর মহলের সৎ, ভালো কোনও অফিসারের খোঁজ করে তাকে অভিযোগ জানালে কিছু হলেও হতে পারে।

বাড়ি ফিরে এসে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কি করা যায় ভাবতে থাকে কৌশিক।
হঠাৎই অসংখ্য লোকের গলার আওয়াজ শোনা গেলো। ভালো করে লক্ষ্য করতেই শোনা গেলো স্লোগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিল নিয়ে একদল লোক এগিয়ে আসছে! হ্যাঁ, এবার স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে মিছিলের সামনে সেই মেয়েগুলো, যাদের থানায় দেখেছিলো কৌশিক। মেয়েগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। যুবক যুবতী, তরুণ- বৃদ্ধ, কিশোর অনেকেই ধেয়ে আসছে আহমেদ খানের বাড়ির দিকে। এ যেন গণজাগরণ, এ যেন অন্ধকার ছিঁড়ে আলোর পথে হাত হাত রেখে এগিয়ে চলা। অন্যায়, অবিচার, অপশাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সম্মিলিত দাবী।
এমন করে গণজাগরণ জোয়ারে, ন্যায্য ঝাঁঝালো দাবী নিয়ে যদি সকল অন্যায় অবিচার দূর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো যায় তবে জনস্রোতের কাছে সকল অপশাসন, অনাচার ভেসে যেতে বাধ্য।
আহমেদ খান বাড়ি থেকে বের হয়ে তার প্রাইভেট কার গাড়িতে ওঠে গাড়ি স্টার্ট করতে যাবে এমন সময় যেন এক ক্ষুব্ধ জনস্রোত ছুটে আসে তার দিকে। টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করে এলোপাতাড়ি চর, কিল, ঘুষি মারতে থাকে বিক্ষুদ্ধ জনতা। এলোপাতাড়ি মারখেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে যায় আহমেদ খান। তবু ওরা ওকে মারতেই থাকে। এ বিচার জনতার।

এই দেশে উচ্চ পদস্থ দূর্নীতিবাজ, খুনি, ধর্ষকেরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়! কদাচিত দু’একজন ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে আসে আর অপরাধ করতে থাকে। কদাচিত দু’একজনের বিচার হয়, সাজা হয় বটে তবে বড় বড় হোতারা, রাঘোব বোয়ালরা ঘটনার আড়ালেই থেকে যায়! আইনের লোকেরাই বেআইনি, দূর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ যুগিয়ে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। এসবের পরিবর্তন দরকার। অভাগা এই দেশে অনেক সৎ, ভালো মানুষ শাস্তি ভোগ করে আর প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যায় এমন অনেক নজিরও রয়েছে। সর্ব সাধারণ মানুষের জন্যে যত কঠোর আইন আর মন্ত্রী, এমপি, আমলা,দালাল, সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্যে আইন শিথিল এমনটাই হয় অভাগা এই দেশে। এসবের পরিবর্তন জরুরী। শুধু ঘোষণা-ই নয়, আইন সবার জন্যে সমান এটার বাস্তবায়ন জরুরী।
সরকার যায় সরকার আসে। সরকারের লোকজন পুলিশ প্রটোকল নিয়ে কতশত গাড়ি বহর নিয়ে চলাচল করেন। অথচ সর্ব সাধারণের জানমালের কোনও নিশ্চয়তা নেই। খুন,ধর্ষণ, দূর্নীতি, অন্যায়, অবিচার এসব দিন দিন বেড়েই চলে! এভাবে চলতে পারেনা। ঘুনেধরা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। দূর্নীতি, অনিয়মগ্রস্থ প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের পরিবর্তন চাই।

কতশত সাগর, রুনি, তনু, নুসরত, রিফাত, বিশ্বজিত, তানিয়া,রিয়াদ,খাদিজা, বায়েজিদরা নির্মমভাবে মরছে রোজ রোজ! কোনও দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়না! পুরোনা ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায় নতুন ঘটনার অন্তরালে! এসবের পরিবর্তন দরকার, খুব দরকার। অন্যায়- অবিচার, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অপশাসনের আঁধার ভেদ করে ন্যায়, সুশাসন, বৈষম্যহীন ও মানবতার আলোকিত সূর্য একদিন উদিত হবে এই প্রত্যাশায় থাকে এইদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ।