ফিলিস্তিন প্রশ্নে পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত

আপডেট: মে ২১, ২০২১
0

– এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার

পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস, সভ্যতা সৃষ্টির ইতিহাস, সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে মানুষের বেচে থাকায় ইতিহাস অনেক অনেক বেদনাদায়ক, ফলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে মানুষ তার ভিন্ন ভিন্ন চিত্র অবলোকন করেছে। মোটাদাগে পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত। এক দিকে মুসলমান অন্যদিকে নন মুসলিম। বৌদ্ধরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে কথা বলে না, হিন্দুরা খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে না, খৃষ্টানরা ইহুদীদের বিরুদ্ধে কথা বলে না। কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে একবাক্যে সকলেই ঐক্যবদ্ধ। রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র মুসলামন হওয়ার কারণে মিয়ানমার থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয় এবং কার্যত: ভাবে ভারত, চিন ও বড় বড় নন-মুসলিম রাষ্ট্রগুলি রোহিঙ্গাদের পক্ষে এগিয়ে আসে নাই। জেরুসসালেম মুসলমানদের প্রথম কিবলা এবং ফিলিস্তিনিদের আদি নিবাস। ইহুদীরা হযরত মুহাম্মদ (সা:) সময় থেকেই মুসলমানদের চরম বিরোধীতা করে আসছে। অনেক নবীকে ইহুদীরা হত্যা করেছে। হিটলার পৃথিবীর অন্যতম রক্ত পিপাসু সন্ত্রাসী হওয়া স্বত্বেও কথিত আছে যে হিটলার বলেছেন যে, আমি ৬০ হাজার ইহুদীকে হত্যা করেছি, কিন্তু কিছু ইহুদী বাচিয়ে রেখেছি বিশ্বকে দেখানোর জন্য যে তারা কত নিম্মস্তরের মানুষ। রোজার দিনে আবাসিক এলাকায় বোমা নিক্ষেপ করে ইহুদীরা শুধু মানবাধিকার লঙ্গন করে নাই বরং চালাচ্ছে গণহত্যা। এ ক্ষেত্রে ইহুদীরা আন্তর্জাতিক সকল নিয়ম রীতি ভঙ্গ করে ফিলিস্তানের আবাসিক, হাসপাতাল ও স্কুলগুলির উপর নির্বিচারে বোমা হামলা চালাচ্ছে।

জাতিসংঘ ইহুদী সহ নন-মুসলিমদের একটি খেলার পুতুল। ইসরাইল বোমা হামলা শুরু করার পর তিনবার নিরাপত্তা পরিষদের সভা জাতিসংঘ আহবান করেও আমেরিকাসহ নন-মুসলিম রাষ্ট্রগুলির কারসাজিতে নিরাপত্তা পরিষদের সভা করতে পারে নাই। যে জাতিসংঘ জেরুসসালেম উপর অযাচিত হামলা বন্ধ করতে পারে না সেই জাতিসংঘের প্রয়োজন কি?

পৃথিবীতে ৫৬/৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। সৌদি আরব সকল মুসলমানের অধ্যাতিক রাজধানী। সৌদি আরব সহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলি ফিলিস্তানীদের যে ভাবে সাহায্য করা দরকার সে ভাবে সাহায্য করছে না। আল-আকসা মসজীদ সকল মুসলমানদের প্রাণের সম্পদ এবং মক্কা মদীনার পরেই এর আধ্যাতিক অবস্থান। এ ঐতিহ্যবাহী সম্পদকে রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব হিসাবে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব হবে ফিলিস্তানীদের শুধু মৌখিক বিবৃতি দিয়ে নয় বরং অস্ত্র ও সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করা। ইহুদীরা স্বীকার করেছে, ফিলিস্তানীরা পাল্টা আক্রমন করে ইসরাইলের উপর ঝাকে ঝাকে যে সেল নিক্ষেপ করেছে তা ইহুদীরা কল্পনা করতে পারে নাই।

বার বার প্রমান হয়েছে যে, আমেরিকা একটি বৃহত শক্তি হওয়ার কারণে জাতিসংঘকে নিয়ন্ত্রন করছে তাদের মর্জি মোতাবেক, কিন্তু বিশ্ব জনমতের প্রতি আমেরিকার কোন শ্রদ্ধাবোধ নাই। রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন, ডায়েছে ভোল, আল-জাজিরা প্রভৃতি মিডিয়ার ভাষ্যমতে “ইস্রায়েল-ফিলিস্তিন এলাকায় বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা করে গত ১৬/০৫/২০২১ ইং ভোররাত্র পর্যন্ত গাজার বিভিন্ন এলাকার উপর টানা হামলায় অর্ধশতাধিক নারী ও শিশু নিহত হয়েছে। এ নিয়ে এক সপ্তাহে ইস্রায়েলি হামলায় ফিলিস্তানের ২৫০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।” এমতাবস্থায়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলে যাচ্ছেন যে, “ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মানুষের বাচার অধিকার আছে। দ্রুত এই লড়াই বন্ধ হওয়া দরকার।” বাইডেন নিজেও জানে যে, তার সুরসুরি দেয়া এ বক্তব্যে ইসরায়েলী আক্রমন বন্ধ হবে না। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের জন্য তিনি বা আমেরিকা কার্যত কোন ভূমিকা রাখছেন না।

জেরুসসালেম ইস্রাইলীদের এ হামলা উদ্দেশ্য প্রনোদীত। গত বৎসর উষ্কানীমূলকভাবেই ইহুদীরা ফিলিস্তানের রাজধানী গাজা এলাকায় কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই বসতি স্থাপন করে। ইস্রাইলের পূর্ব পরিকল্পনা রয়েছে ফিলিস্তানকে ইস্রাইলের অন্তভুক্ত করে সেখানে তাদের রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করা। ফলে সহজেই বুঝা যাচেছ যে, ইহুদীদের পূর্ব ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে গাজায় তাদের এই নিসংস আক্রমন, এক কথায় যা বলা যায় একটি অমানবিক নির্মম গণ-হত্যা।

নন-মুসলিম রাষ্ট্রগুলি কেহ কেহ শান্তনামূলক বিবৃতি দিচ্ছেন। শান্তনামূলক গতানুগতিক বিবৃতিতে আক্রমন বন্ধ হবে না। গাজা শহরকে যে ভাবে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা পুন:গঠনও কষ্টকর ব্যপার হয়ে দাড়াবে। এখানে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির একটি ঐকান্তিত কার্যকর ভূমিকা থাকা প্রয়োজন, যে ভূমিকায় বাস্তবিক পক্ষেই ফিলিস্তান এবং সেখানের জনগণ উপকৃত হতে পারে। ইস্রাইলকে শায়েস্তা করার জন্য মুসলিম বিশ্বের কঠিন ঐক্যমত হওয়া আবশ্যক। ফিলিসতিনিদের এ দূর্যোগ মুহুর্তে যার যে শক্তি আছে তা দিয়েই তাদের পাশে দাড়াতে হবে, অন্যদিকে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাদের প্রস্তুতকৃত সকল প্রকার পন্য সামগ্রী ব্যবহার মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ করার ঘোষনা দিতে হবে এবং ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। কারণ ইহুদীরা সুযোগ পেলেই মুসলমান যে যেখানে আছে তাদের ক্ষতি করবে তার পূর্বাভাস পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহপাক বর্ণনা দিয়েছেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়ের এরদোগনকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের জন্য ইন্টারন্যাশনাল প্রটেকশন মেকানিজম নামে একটি বাহিনী গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছে তুরস্ক। পৃথিবীর সকল মুসলিম রাষ্ট্রগুলি তুরস্কের প্রস্তাবে ঐক্যমত হওয়া দরকার। কারণ বিবৃতি বা আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে ইস্রাইলকে দমানো যাবে না, দেয়া যাবে না ফিলিস্তিনের নাগরিকদের নিরাপত্তা। এমতাবস্থায়, ফিলিস্তিনিদের একান্ত প্রয়োজন সামরিক সাহায্য, অর্থাৎ অস্ত্র ও যোদ্ধা। আমি মনে করি মুসলিম প্রধান দেশ (রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম) বাংলাদেশ তুরস্কের প্রস্তাবে সমর্থন জানাবে। ১৯৭১ ইং সনে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে ভারত বাংলাদেশকে সামরিক সাহায্য প্রদান করেছে। তখন যদি ভারত বাংলাদেশের পক্ষে সামরিক সাহায্য প্রদান না করতো তবে হয়তো বাংলাদেশ এতো তাড়াতাড়ি স্বাধীন হতো না। রাষ্ট্রীয় ভাবে কিছু বিষয় রয়েছে যেখানে মানবতাকে রক্ষার জন্য, মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।

একটি মুসলিম প্রধান দেশ হিসাবে বাংলাদেশ আঘাত প্রাপ্ত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটেও বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যান্ত মানবিক। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জোড়ালো ভূমিকা জনগণ প্রত্যাশা করে। ফিলিস্তিনিদের উপর কুখ্যাত ইসরায়েলের হামলায় ঘটনার সূত্রপাত ৭২বৎসরের পূরানো। মিয়ারমারের মুসলমান রোহিঙ্গাদের উপর বৌদ্ধদের নির্মম নির্যাতন আরো বেশী পুরানো। ফিলিস্তানী ও রোহিঙ্গাদের পৃথক স্বাধীন ভূ-খন্ড ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না। ইহুদী রাষ্ট্রগুলি মূখে মূখে মানবতার কথা বলে, মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচার পত্র বিলি করে, অথচ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেশ ছড়ানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে। তাদের ধর্মীয় আগ্রাসন বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকা তথা অউন্নত এলাকায় প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে গরীব মুসলিম পরিবারকে ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে খৃস্টান ও ইহুদী ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে। বাংলাদেশে হালে প্রত্যক্ষ শিল্পপতি পাবনা নিবাসী মরহুম সামসেন চৌধুরীকে (স্কোয়ার হাসপাতালের মালিক) মুসলিম ধর্ম থেকে খৃস্টানে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। গোপনে গোপনে রিমোট এলাকায় মুসলমান ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত করার খবর পাওয়া যাচ্ছে যার সত্যতা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গভীর গুরুত্বসহকারে তদন্ত হওয়া আবশ্যক।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই এবং বিশ্ব মুসলিম একটি পরিবার। ইসলাম ধর্ম একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বিদায় হজ্জের ভাষনে হযরত মুহাম্মদ (সা:) নির্দেশনা জারী করেন। অথচ একটি শান্তি প্রিয় অসাম্প্রদায়িক ধর্ম ইসলাম তথা মুসলমানদের প্রতি ভিন্ন ধর্মের সকলেরই আক্রোশ। এর মূল কারণ পৃথিবীর সভ্যতা সৃষ্টিতে বিজ্ঞানের উন্নয়নের প্রতি মুসলিম মনষীদের অনেক অবদান রয়েছে, অন্যদিকে ইসলাম ধর্মই একমাত্র ধর্ম যা অনুশীলন ভিত্তিক এবং জবাবদিহিতার আওতাভুক্ত। এখানে একজনের অপরাধের জন্য অন্যকে দায়ী করা যায় না। নারীর অধিকার ইসলাম ধর্মই স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমা সভ্যতা নারীকে বানিয়েছে অশ্লীলতা ও ভোগের সামগ্রী।

বিশ্ব মুসলিম যদি একটি পরিবার হয়ে থাকে তবে সকল মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। ফিলিস্তিনি ও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য একটি স্বাধীন ভূ-খন্ড এখন সময়ের দাবী। এ দাবী পূরনে বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দকে স্বোচ্চার হওয়া আবশ্যক এবং এ জন্য প্রয়োজন জোরদার সামরিক প্রস্তুতি।

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)

মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬

E-mail: [email protected]