বন্যা দূর্যোগ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে বাঁচতে হলে হাওর-বাঁওরসহ সকল প্রাকৃতিক জলাশয়-জলাভূমিকে রক্ষা করতে হবেঃ ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড

আপডেট: জুন ২০, ২০২২
0

ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)
সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি ও এতদসৃষ্ট জীবন ও জীবিকার অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতি ও জনগণের অবর্ণনীয় দূর্ভোগে গভীর দূঃখ প্রকাশ করছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। এই বন্যায় এই মূহুর্তে দূর্যোগ মোকাবেলায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতায় স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সাধারণ জনগণ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহ যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে আইপিডি।
এবারের বন্যায় বাংলাদেশসহ ভারতের আসাম, মেঘালয়, চেরাপুঞ্জির অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের বড় দায় রয়েছে, এটা অনস্বীকার্য। প্রবল বৃষ্টিপাতে ও উজানের পাহাড়ী ঢলের কারণে আমাদের দেশে উত্তরাঞ্চলে প্রায়শঃই বন্যা দেখা দিলেও এবারের বন্যার অস্বাভাবিক ব্যাপকতা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর পেছনে ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের প্রাকৃতিক হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী এলাকাসহ বিভিন্ন জলাশয়-জলাভূমির পানি ধারণ ক্ষমতা ক্ষমতা হ্রাস ও স্বাভাবিক পানি প্রবাহের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের দায়কে অস্বীকার করা যাবেনা।
একইসাথে বিগত দশকগুলোতে হাওর এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বন্যাসহ বিভিন্ন দূর্যোগ মোকাবেলার প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার উপাদানসমূহকে আমরা যেভাবে বিনষ্ট করে আমাদের সমূহ বিপদ ডেকে নিয়ে এসেছি, তাকে উপেক্ষা করলে সামনের দিনগুলোতে আরো বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবছর সারা দেশেই দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশংকা করা হচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী বছরগুলোতেও নিয়মিতভাবে দেখা দিতে পারে । আমাদের দেশ মৌসুমী বায়ুর অঞ্চল হওয়াতে বন্যার সাথে বসবাস করবার জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবার কথা ছিল, সেই মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে আমরা প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ও জলধারণ এলাকা নষ্ট করে চলেছি প্রতিনিয়ত। এই চিত্র শুধু ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের এলাকার নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাতে, এমনকি আমাদের শস্যভান্ডার ও মৎস্যের উৎস উত্তরাঞ্চলীয় হাওর এলাকাতেও আমরা প্রাকৃতিক জলাভূমি, যথা হাওর-বাঁওড়-খাল-বিল নির্বিচারে ধ্বংস করে সড়ক-অবকাঠামো ও বসতবাড়ি নির্মাণ করেছি। হাওর বা এধরনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাতে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ বা যে কোন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নে পরিবেশগত সমীক্ষা (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট) ও পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ প্রতিবেদন (প্ল্যানিং ইমপ্যাক্ট এনালাইসিস রিপোর্ট, যার মধ্যে ভৌত পরিকল্পনাগত-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ অন্তর্ভূক্ত) করবার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আদর্শগত পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী পরিকল্পনায় অনুসৃত হয়ে থাকে, তাকে অনুসরণ না করবার বড় দায় আছে। এমনকি আমরা প্রায়শঃই দেখে থাকি, কোন কোন প্রকল্পে এই ধরনের সমীক্ষা করা হলেও সেটা শুধুমাত্র প্রকল্পকে বৈধতা দেয়া ও পদ্ধতিগত অনুশাসন নিশ্চিত করবার জন্যই করা হয়ে থাকে। ফলে প্রকৃতঅর্থেই পরিবেশ-প্রতিবেশগত এবং জীবন-জীবিকার উপর এই ধরনের উন্নয়ন উদ্যোগ ও ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা ও তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করবার ফলে ভবিষ্যতের জন্য আসন্ন বিপদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়, যার শিকার হয়ে থাকেন সাধারণ মানুষ ও প্রকৃতি।
পাশাপাশি নগর এলাকাতে প্রাকৃতিক খাল, জলাধার ক্রমশঃ ধ্বংস করা এবং যথাযথ আইনের শাসনের অভাবে সারাদেশেই নদীদখল, জলাশয়-জলাভূমি ভরাট চলছে নির্বিচারভাবে। একইসাথে আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা সংকটের কারণে নদীগুলোর পানিধারণ ক্ষমতা ও কমেছে মারাত্মকভাবে। নদীগুলোতে ড্রেজিং প্রকল্পে সরকারী ব্যয়কৃত অর্থ প্রকৃত অর্থে নদীগুলোর নাব্যতো বাড়াতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে তার নির্মোহ কোন বিশ্লেষণ ও তদারকি ও নেই। কেবলমাত্র যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ এবং নির্বিচার নদীশাসন ও কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের বন্যা-জলাবদ্ধতা ও জনদূর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়।
আমাদেরকে বাঁচতে হলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের হাওর-বাঁওর, নদী-খাল, জলাশয়-জলাভূমি প্রভৃতি প্রাকৃতিক জল ধারণ এলাকা আমাদের সংরক্ষণ করতেই হবে, টেকসই উন্নয়নে এর কোন বিকল্প নেই বলে মনে করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) । আমাদের উচ্চ আদালত ঘোষিত এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ জীবন্ত সত্বাসমূহের দখল-ভরাটের সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় নিয়ে যথাযথ প্রতিবিধান করে এগুলো পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের ভূমি শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী পরিবেশ-প্রতিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহে যে কোন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প ও উদ্যোগ নেবার আগে পরিবেশগত সমীক্ষা ও পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ প্রতিবেদন তৈরি করা প্রয়োজন। এর অন্যথা হলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের বন্যা দূর্যোগের ভয়াবহতা আরো বাড়তে পারে, যা মোকাবেলা করা আমাদের রাষ্ট্র-সরকার ও সাধারণ জনগণের জন্য কোনভাবেই সম্ভবপর হবে না বলে মনে করে আইপিডি।
একইসাথে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বানভাসীদের সহযোগিতায় সরকারে তরফ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা বিপন্ন মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে মনে করে আইপিডি। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বাজেটের পরিমাণ অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় আর্থিক সহযোগিতার পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি এবং বন্যা দূর্গতদের উদ্ধার-আশ্রয় ও পূনর্বাসনে সমন্বিত কার্যক্রম আরো জোরদার করবার আহবান জানাচ্ছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ।