বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং অভিশপ্ত জীবন

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩
0


ডা. জাকারিয়া চৌধুরী

প্রিয় ভাইজান,
আসসালামু আলাইকুম।

আমার নাম ফরিদ। আমার বন্ধুরা আমাকে ডিসি ফরিদ বলে ডাকে। কবে কখন কোন কুক্ষনে যে কার সাথে গরম দেখাতে গিয়ে বলে ফেছিলাম- দেখিস, বড় হলে আমি এ শহরের ডিসি সাব হব, দেখিস! তারপর থেকে বন্ধু মহলে আমি হয়ে গেলাম ডিসি ফরিদ। যতদিন পর্যন্ত আমি তাদের সম লেভেলের ছিলাম ততদিন পর্যন্ত এই বিশেষনের বিরুদ্ধে ফাইট করে গেছি। এখন আর কিছু মনে করিনা। এলাকার ছেলে বুড়ো থেকে শুরু করে বাজারের পান দোকানদারেরাও আমাকে এই নামে ডাকে, হাসি তামসা করে। আমার শৈশবের সেই সব অপদার্থ বন্ধুরা আজ একেকজন কোথায় কোথায় চলে গিয়েছে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। যাদের জীবনে কোন লক্ষ্য ছিল না, আবার যারা মাদ্রাসা থেকে দাখিল শেষ করে কলেজে এসে কমার্সে ভর্তি হয়েছিল তারা একেকজন আজ একেকটা মাল্টিলেভেল কোম্পানির হোমরা চোমড়া হয়ে বসে আছে। বছরান্তে একবার বাড়ি আসে। যে ঈদ করতে আসে সে হয়ত কুরবানী’র জন্যে বাজারের সবচে বাহারি গরুটা কিনে। এই গরু দেখার জন্য, দাম কত জানার জন্যে এলাকার লোকদের রীতিমত স্রোত নামে। গরুর দড়িটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বন্ধু দরাজ গলায় বলে, ‘যা গরুটা বাড়িতে রেখে আয়। বুঝলি দোস্ত, এই এলাকায় তুই ই একমাত্র মানুষ যার উপর আমি সব বিষয়ে ভরসা করি। গরু রেখে তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু’।

তারপর চোখ টিপে ঈশারা দেয় – বর্ডারে যেতে হবে। শতশত মানুষের সামনে তার একমাত্র দোস্ত বলে আমাকে যে সম্মান সে দেখায়, তাতে গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। অনুগত ভৃত্যের মত দৌড়ের উপর গরু নিয়ে যাই, একটা খালি ব্যাগ নিয়ে আবার ফিরে আসি। সে পকেট থেকে পাচটা কড়কড়ে হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে কানে কানে বলে- বিয়ার নীল বোতলেরটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করবি। ছোট বোতলের দশটা অরেঞ্জ ট্যাংগো’র জিন নিবি। আর শোন পারলে একটু কাচা সবজি আনিস।

তুই ত গরুর দুধের সাথে কাচা পাতা দিয়া দুনিয়ার সেরা ভাং এর শরবত বানাতে পারিস। মনে আছেরে ডিসি সব মনে আছে। এখন যা। তাড়াতাড়ি ফিরিস……. টাকা গুলো হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আমি বাতাসের বেগে হাটতে থাকি। মদ কিনে দ্রুত ফিরতে হবে। দেরি হলে বুলু’র মেজাজ ঠিক থাকে না। এই যা, এতক্ষন ধরে যার গীত গাইলাম তার নামই বলা হল না। সে বুলু। মনে আছে, ছোট বেলায় একবার তেতুল গাছে জ্বিন দেখে সে পাগল হয়ে গিয়েছিল? টানা তিন বছর স্কুলে যেতে পারল না। ঘরেই পেশাব পায়খানা করত। আমরা ত ভেবেছিলাম তার জীবনে আর কিছু হবে না। আমি যখন ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠলাম রেকর্ড মার্ক পেয়ে তখন তাকে নিয়ে আবার ক্লাস টু’তে ভর্তি করানো হল। তার মোগরা রোগ ছিল। মুখের ভয়ংকর দুর্গন্ধের কারনে কেউ তার সাথে বসত না। কান দিয়ে অনবরত পুজ পড়ত। চাচী প্রতিদিন তার কানে ছোট এক কনা কাপড় গুঁজে দিত। দুপুর পার হবার আগেই সেই কাপড়ে পুজ জমে ভেজা তেনায় পরিনত হত। সেই বুলু আজ পর্যন্ত একুশটা দেশে গিয়েছে বিজনেস প্রমোশন এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে…..


ওহাব কাকার ছেলে জুয়েলের কথা কি আপনার মনে আছে? সে তার স্কুল জীবনে কোনদিন ফার্স্ট হয় নাই, আবার কোন সময় থার্ডও হয় নাই। রোল নাম্বার দুই। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত তার রোল থাকল দুই। প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার সময় সে মাজারে যেত। কবরে সালাম করত। তারপর পকেট থেকে দুই টাকা সেখানে রেখে উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে এসে হলে ঢুকত। সে এখন গভ: উইমেন্স ডিগ্রী কলেজের নামকরা শিক্ষক। সারাদিন বাসায় টিউশনি করে। দুই হাতে টাকা কামায়। প্রতি কোর্স ফি নাকি পাচ করে নেয়। চিন্তা করেন, একেকজন স্টুডেন্ট দুই কোর্সের জন্য তাকে দশ হাজার টাকা দেয়। সপ্তাহে দুইদিন পড়ায়। দুইশ স্টুডেন্ট হলে বছরে টিউশনি বাবদ কত আয় করে চিন্তা করা যায় ?

পিচ্চি সেলিম সারা বছর শুধু কাঁদত। কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে আসত, কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরত। দিন শেষে ফাউন্টেন পেনের কালিতে মাখামাখি হয়ে বাড়ি ফিরে মার খেত। তার বাড়িটার কথা মনে আছে ? চতলে উঠার সামান্য আগে এক রুমের ছোট একটা ছনের ঘর ছিল তার বাবার। সেই সেলিম এখন সরকারী এপিপি। সরকারী মামলা দেখাশোনা করে। শুনেছি টাকা ছাড়া সে নাকি একটা নি:শ্বাসও ফেলে নে।

এই তিনজনের কেউই ইন্টারে ভর্তি হবার পরেও কখনো বলতে পারেনি, তাদের কে কি হতে চায়। আর আমি কিনা প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই বলে বসলাম- আমি কুমিল্লার ডিসি হব। ভাবলে এখনো হাসি পায়। এই তিনজনের গল্প কেন বললাম সেটা পরে বলব।

আমি যখন ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হই, আপনি ততদিনে সরকারের সচিব হয়ে গেছেন। সরকারী গাড়ি, বাড়ি, সার্বক্ষণিক পুলিশ আপনার সেবায় নিয়োজিত। আপনি বাড়ি আসলে আপনাকে এক নজর দেখার জন্য মানুষের লাইন লেগে যেত। আপনার স্ট্যাটাসে আমার অহংকারের কোন সীমা পরিসীমা ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হত, আব্বা বুঝি আপনাকে তুমি বলে সম্বোধন করতেও ভয় পায়। আপনার সে কি মেজাজ ! একে ধমক দেন, ওকে থাপ্পড় দেন। চারিদিকে আপনার কত যশ প্রতিপত্তি!! এদিকে ঘরের মানুষেরা মানে আমরা আপনার ভয়ে আতংকে সারাক্ষন কেঁচো হয়ে থাকি। কখন কি ভুল করে ফেলি, এই ভয়। দিনে দিনে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, আপনার ইচ্ছার বাইরে আমাদের পুরো পরিবারে এক ফোটা পানিও গড়ায় না। বন্ধু বান্ধব’রা যখন বলত আপনি আমার আপন ভাই না তখন কত যে তাদের সাথে মারামারি করেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। আপন পর আবার কি? আপনি আমার ভাই, কথা শেষ।

আপনার মনে আছে ভাইজান, একদিন হঠাত করে কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনি বাড়িতে এসে হাজির ! আপনার বয়স যখন পঞ্চান্ন তখন আমি কুড়ি বছরের অবুঝ প্রায় যুবক। মাথার উপরে ছাদ হিসেবে আপনি আছেন বলেই নিজে কোন কিছু চিন্তা করতাম না। যা করার ভাই করবে। আমার অত চিন্তার কি আছে? ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চলি। দুপুরে ভাত খেতে বসে আপনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আগামী শনিবার আমার ফ্লাইট। মেঝো দুলাভাই শুধুমাত্র জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেছিলেন, আমাকে কোথায় পাঠানো হচ্ছে ? আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। দুনিয়ার কোন কিছুই জানিনা, বুঝিনা। আপনি খাবার টেবিলেই দুলাভাইয়ের মুখের উপর প্লেট ছুড়ে মারলেন। পরের সপ্তাহে সত্যি সত্যিই আমাকে মালয়েশিয়াগামী বিমানে তুলে দেয়া হল। সেখানে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানীতে লেবার হিসেবে আমার নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল। আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বাবার কোল থেকে নিয়ে আমাকে যেন জ্বলন্ত কয়লার উপর ফেলা হল। প্রচন্ড গরমে সে কি ভয়াবহ পরিশ্রমের কাজ !! সেই অবস্থাতেই কিভাবে কিভাবে যেন পাচ পাচটি বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যেই একদিন আব্বা ফোনে জানালেন, আপনি এমপি ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। আমি বাক্স পেটরা গুছিয়ে সেই সপ্তাহেই দেশে ফিরে এলাম। জান প্রান উজাড় করে আপনার ইলেকশন করলাম। আপনি বিপুল ভোটে পাশ করলেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে আপনার স্থান হলো ক্যাবিনেটের অন্যতম প্রভাবশালী বলয়ে। আর আমার স্থান হলো একটা মেসে। মন্ত্রী হয়েই আপনি আমাদের সাথে খারাপ আচরন শুরু করলেন। আমাকে যখন বাসা থেকে চলে যেতে বললেন তখন আমার পকেটে একশ টাকাও নেই। আমার সকল সঞ্চয় ব্যায় করে বসে আছি ইলেকশনে। জীবনে দ্বিতীয়বারের মত মনে হল আমি বুঝি কোন ঘোরের মধ্যে আছি। যা হয়েছে বা হচ্ছে তা সত্য নয়। কোনও দু:স্বপ্ন দেখছি বোধহয়। জানামত কোন অপরাধ তো করিনি।
প্রিয় ভাইজান,

আমি এখনো বিশ্বাস করতে ভালোবাসি আপনিই আমাদের সবার বাবা মা। আপনার কি মনে আছে, আমাদের দুইজনের পিতা একজনই। একই রক্ত আমাদের দুজনের হৃদপিন্ডের ঝর্নায় বহমান? আপনার কি মনে আছে, আমাদের পিতার নাম কি ছিল ? আমার চেহারা দেখলে আপনি কি আমাকে চিনবেন? সম্ভবত, না। বয়স ত কম হল না। এখন আমার বয়সই প্রায় পয়তাল্লিশের কাছাকাছি। সব চুল পেকে গেছে। ডায়বেটিস আর অস্টিও আর্থাইটিস শরীরে স্থায়ীভাবে বাসা বেধেছে। রক্তে চিনির উপস্থিতি থাকে বিশের উপরে। দুইবেলা ইনসুলিন নেই।

ভাইজান,

নিজের জীবন নিয়ে এখন আর কোন রকম বোধ কাজ করেনা। আমার ত কোন পিছুটানও নেই। ভাগ্যে একটা লটারিও জুটল না। যে ছেলের টাকা নেই, সে ছেলের আইডেন্টিটিও নেই, তার দায় কে নেবে বলেন ? সংসার যেহেতু করতে পারিনি, তাই কোন ছেলে মেয়েও নেই। একা একাই আছি। ইদানিং মনে মৃত্যু ভীতি বাসা বেধেছে। প্রায়ই মনে হয়, কোন একদিন নি:সংগ অবস্থায় হয়ত মরে পড়ে থাকব। আমার মৃত্যু পরবর্তী সৎকার কে করবে? আমার খুব ইচ্ছা, আমি যেহেতু দেশ বা সমাজের কোন কাজে আসিনি কখনো, দেশের প্রতি আমার জন্ম ঋন শোধ করার উপায়ও আর নেই। আমার দেহটা যদি কোন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে দান করে যেতে পারি তবে কি তা দেশের কোনও কাজে আসবে ? চিকিৎসা বিজ্ঞানের সন্তানেরা আমার দেহ কেটেকুটে যদি কিছু শিখে তা হয়ত পরোক্ষভাবে হলেও দেশের উপকারে আসবে। ওরা ভাল ডাক্তার হলে, দেশের মানুষ ভাল চিকিৎসা সেবা পাবে। আমার পক্ষে হয়ত এটাই সবচে ভাল পথ হতে পারে, যদি আমি দেশের একজন সু সন্তান হয়ে জন্মে থাকি। আমি ত আর আপনাদের সাথে নিজেকে তুলনা করতে পারব না। সে সাহস বা যোগত্য কোনটাই আমার নেই। নেই শিক্ষাদীক্ষা। আপনারা সরকারী কর্মচারী হয়ে দেশের সেবা করেছেন আজীবন। আইন প্রনেতা হয়ে দেশের কাজ করেছেন, মন্ত্রী হয়ে এক হাতে সামলেছেন পুরো দেশ। আপনারা কত কত মহান। আপনারা আমাদের মত অর্ধেক বয়সেই বুড়ো হয়ে মরে যাবেন না। আপনাদের মৃত্যুতে দেশ জুড়ে শোক পালন হবে। রাষ্ট্র, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, সংসদের স্পিকার থেকে শুরু করে কত লক্ষ লক্ষ মানুষ শোক বইতে স্বাক্ষর করতে আসবেন। আপনারা কিভাবে তৈরী হন সে খবর আর কে রাখে, বলুন।

ও হ্যা, যে কারনে এই চিঠি লেখা তা হচ্ছে, আপনার সাথে আমার সত্যিই হয়ত আর কখনো দেখা হবেনা। আমার ইচ্ছার কথাটা জানানোর মত কাছের মানুষ হিসেবে দ্বিতীয় কেউ নেই। ফলে বাধ্য হয়ে আপনাকেই লিখতে হল। বিকল্প কেউ থাকলে হয়ত আপনাকে বিরক্ত করতাম না। আপনি দয়া করে চিঠিটা ফেলে দেবেন না। আমি বহুদিনের চেষ্টায় হাজার দশেক টাকা আলাদা করতে পেরেছি। চিঠির সাথে সেই টাকাটাও পাঠালাম। দয়া করে গ্রহন করবেন। শুনেছি ইদানিং আপনার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল যাচ্ছে না। ধানমন্ডিতে আপনার বাড়ির চাকরের সংখ্যা কমিয়ে এগারো থেকে সাতে নামিয়ে এনেছেন। আপনার অবস্থা ভাল যাচ্ছেনা শুনেও দু:খ পেয়েছি। আল্লার কাছে দোয়া করি, আপনার সমস্যা যেন দ্রুত কেটে যায়।

আর কি বলব। অনেক কথা বলে আপনার সময় নষ্ট করেছি। দয়া করে ক্ষমা করবেন। জীবনে প্রথম কাউকে কোন চিঠি লিখলাম। ভুলত্রুটি হলে আবারও ক্ষমা চাই।
বিনীত,
আপনার স্নেহের ছোট ভাই….
২৩/০২/১৭ ইং